যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিম বিদ্বেষ বাড়ছে

১৫ বছর আগে, ১১ সেপ্টেম্বর ২০০১ সালে, নিউইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে ও আরও দুটি শহরে যে অভাবিত সন্ত্রাসী হামলা হয়, এই দেশের মানসিক মানচিত্রে তা এক গভীর দাগ ফেলে গেছে। সেই ঘটনার সূত্রে আফগানিস্তান ও ইরাকে দুটি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে আমেরিকা। অনেকের বিশ্বাস, বিশ্বজুড়ে যে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেছে, তা এই দুই যুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত।

৯/১১-এর ঘটনার ফলে আমেরিকার ভেতরে মুসলিম-বিদ্বেষী যে মনোভাবের জন্ম হয়, তা-ও পুরোপুরি মিলিয়ে যায়নি। সাম্প্রতিক সময়ে, রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘মুসলিম আগমন নিষিদ্ধ’ করার যে আহ্বান দিয়েছেন, তার ফলে এই বিদ্বেষ আরও বেড়েছে।

মাত্র এক মাস আগে নিউইয়র্কে একটি বাংলাদেশিদের পরিচালিত মসজিদের ইমাম ও তাঁর সহকারীর মৃত্যু বাংলাদেশি-আমেরিকানদের মধ্যে ভীতি ছড়িয়েছে। গত সপ্তাহে ৬০ বছরের এক প্রবীণ বাংলাদেশি নারী ছুরিকাঘাতে নিহত হয়েছেন। ঘটনাটি যদিও বিদ্বেষ-প্রসূত কি না, তা সুনিশ্চিতভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি, স্থানীয় বাংলাদেশিদের ভেতর অনেকেই একে মুসলিমদের বিরুদ্ধে আরেকটি হামলা বলেই বিবেচনা করছেন।

গত সপ্তাহে ইলিনয়ের রোসমন্টে অনুষ্ঠিত ইসলামিক সোসাইটি অব নর্থ আমেরিকার জাতীয় সম্মেলনেও মুসলিম-বিদ্বেষের বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রে ছিল। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা থেকে কয়েক শ ডেলিগেটের উপস্থিতিতে এই সম্মেলনে প্রথমবারের মতো হোমল্যান্ড সিকিউরিটি দপ্তরের প্রধান জেহ জনসন বক্তব্য দেন। তিনি স্বীকার করেন, বিদ্বেষ-প্রসূত ঘটনা বাড়ছে, কিন্তু এসব ঘটনা ‘মার্কিন-চরিত্রবিরোধী’। আমেরিকান মুসলিমদের ভূমিকার প্রশংসা করে তিনি বলেন, যারা মুসলিমদের ধর্মের নামে সমালোচনা করে, তারা মার্কিন-চেতনার বিপক্ষে। ‘আপনারা এই দেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ, এর নির্মাণ ও প্রতিরক্ষায় আপনাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।’

জেহ জনসন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথা উল্লেখ করেননি, তবে উপস্থিত ডেলিগেটদের মনে কোনো সন্দেহ ছিল না, কারা এই চেতনার বিপক্ষে। ইসলামিক সোসাইটির সহসভাপতি হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আলতাফ হোসেন নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, ‘আমরা এখন এমন এক রাজনৈতিক সময়ে বাস করি, যখন ইসলাম-বিরোধিতা স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে।’

সাম্প্রতিক সময়ে মুসলিম-বিদ্বেষী ঘটনা কতটা বৃদ্ধি পেয়েছে, তার একটি পরিসংখ্যান দিয়েছেন জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক। তাঁদের হিসাব অনুসারে, গত বছরের মাঝামাঝি মার্কিন নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হওয়ার পর থেকে এসব ঘটনা নাটকীয়ভাবে বেড়ে গেছে। এই গবেষণায় তাঁরা মোট ১৮০টি সুনির্দিষ্ট ঘটনা উল্লেখ করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে ১২টি হত্যাকাণ্ড, ৩৪টি শারীরিক আক্রমণ ও ৩৬টি লুটপাটের ঘটনা।

কয়েকটি উদাহরণ বিবেচনা করা যাক। হিউস্টনে একজন মুসলিমকে হত্যার আগে এক শ্বেতকায় মার্কিন চিৎকার করে বলে, ‘যাও, এবার ইসলামে ফিরে যাও।’ ওয়াশিংটনে স্টারবাকস কফি শপে এক শ্বেতকায় মহিলা হিজাব পরিহিত আরেক মহিলার উদ্দেশে গরম কফি ছুড়ে মারেন। নিউইয়র্কের ব্রঙ্কসে এক স্কুলছাত্রীর হিজাব টেনে খুলে ফেলে তারই সহপাঠীরা। ডালাসে মসজিদে ঢুকতে যাওয়ার সময় খুন হন এক চিকিৎসক। এসব ঘটনা বিচ্ছিন্ন হলেও তাদের মধ্যে কোনো যোগসূত্র নেই, তা বলা যাবে না।

ওজোন পার্কের ইমাম আলাউদ্দিন আখঞ্জি ও তাঁর সহকারী তারা মিয়া হত্যার ঘটনাটি নিউইয়র্কের বাঙালিদের মধ্যে স্পষ্ট উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। এই এলাকায় বাস করেন এমন একাধিক বাসিন্দা জানিয়েছেন, তাঁদের এখন প্রতিদিন হামলার আশঙ্কা মাথায় নিয়ে ঘর থেকে বেরোতে হয়। তবে শুধু ধর্ম নয়, সাম্প্রদায়িকতাও এই উদ্বেগের একটি কারণ। ইমাদ হোসেন নামের ২৬ বছরের এক যুবক বলেন, এই এলাকায় কৃষ্ণকায় ও হিস্পানিকদের সঙ্গে বাঙালিদের আগে থেকেই কিছুটা রেষারেষি ছিল। ১০ বছর আগেও এখানে বাংলাদেশিদের সংখ্যা ছিল নাম মাত্র, এখন তাদের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতির কারণে কেউ কেউ অস্বস্তি ভোগ করছে। তাঁর দাবি, এই এলাকায় পুলিশের পাহারা আরও বাড়ানো দরকার।

এই হত্যার পরদিন বাঙালিদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করতে এসেছিলেন কুইন্স বরোর প্রেসিডেন্ট মেলিন্ডা কাতস। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘটনার পেছনে সত্যি সত্যি কোনো ধর্মীয় বিদ্বেষ কাজ করেছে কি না, পুলিশ তা অবশ্যই খুঁজে বের করবে। ‘এখন একে অপরের দোষ না খুঁজে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, যেকোনো ধরনের বিদ্বেষকে পরাস্ত করতে হবে।’

আখঞ্জির জানাজায় এসেছিলেন নিউইয়র্কের মেয়র বিল ডি ব্লাজিও। তিনি ট্রাম্পের নাম উচ্চারণ না করে সেখানে উপস্থিত বাঙালিদের উদ্দেশে বলেন, ‘যখনই কেউ আমাদের বিভক্ত করতে চাইবে, আমরা তার বিরুদ্ধে দাঁড়াব। যারা ইমাম আখঞ্জিকে হত্যা করেছে, তার বিচার আমরা করবই, সেটাই হবে বিদ্বেষের বিরুদ্ধে সেরা উত্তর।’

জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন মেয়র ডি ব্লাজিওর সঙ্গে একমত। তিনি মনে করেন, এসব ঘটনা স্বাভাবিকভাবেই উদ্বেগের সৃষ্টি করে। তবে একযোগে কাজ করলে এসব বিদ্বেষ-প্রসূত ঘটনা মোকাবিলা করা সম্ভব।

ইমাম কাজী কাইয়ুম দীর্ঘদিন থেকে নিউইয়র্কে বিভিন্ন ধর্মের মানুষকে নিয়ে কাজ করছেন। তিনি ‘মোহাম্মদি সেন্টার’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন, যার লক্ষ্য একদিকে সন্ত্রাসবাদের বিপক্ষে জনমত গড়া, অন্যদিকে মুসলিমদের সঙ্গে অন্য ধর্মের মানুষের মৈত্রীবন্ধন সৃষ্টি। তাঁর ধারণা, আমেরিকায় ঘরের ভেতর যদি সন্ত্রাসী লুকিয়ে থাকে, তার মোকাবিলায় মুসলমানদের আরও তৎপর হতে হবে। তিনি দুঃখ করে বলেন, কোনো কোনো মসজিদের ইমামের কথা থেকে সন্ত্রাসের পক্ষে কাজ করার ইঙ্গিত মেলে। তাঁর অভিযোগ, এখানে বাংলাদেশিদের এমন কিছু মসজিদ রয়েছে, যেখানে খোলামেলাভাবে ‘মওদুদীবাদে’র পক্ষে প্রচারণা হয়। একাত্তরের অনেক ঘাতক-দালালও এখানে লুকিয়ে আছে। তিনি প্রস্তাব রাখেন, আমরা যে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে, প্রতিটি মসজিদের সামনে বড় বড় অক্ষরে তা লিখে রাখা উচিত।

নিউইয়র্কে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত আছেন আনোয়ার হোসেন। তিনিও মনে করেন, বাংলাদেশি-আমেরিকানরা যেকোনো ধরনের সন্ত্রাসের বিপক্ষে, সে কথা এ দেশের মানুষকে জানানোর প্রয়োজন আছে। তিনি এ দেশের আইন ও বিচারব্যবস্থার প্রতি নিজের আস্থার কথা প্রকাশ করে বলেন, মাওলানা আখঞ্জির হত্যাকারীকে চিহ্নিত করতে নিউইয়র্ক পুলিশের মাত্র দুই দিন লেগেছে। নিউইয়র্কের জ্যামাইকায় ৬০ বছর বয়সের এক বাঙালি মহিলা ডাকাতির শিকার হয়েছিলেন, তাঁর হত্যাকারীকে ধরতে এক দিনও লাগেনি।

মুসলিমদের ব্যাপারে মার্কিনদের বিদ্বেষ অথবা অসন্তোষের এক বড় কারণ, এদের অধিকাংশই ব্যক্তিগতভাবে কোনো মুসলিমকে চেনে না। গত ১৫ বছরে তাদের মধ্যে এই ব্যবধান বেড়েছে বৈ কমেনি। ২০০১-এর অক্টোবরে গৃহীত এবিসি টিভির এক জরিপ অনুসারে ৪৭ শতাংশ আমেরিকানের মুসলিমদের ব্যাপারে মনোভাব ইতিবাচক। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে গৃহীত আরেক জরিপ অনুসারে মুসলিমদের সন্দেহের চোখে দেখে এমন আমেরিকানের সংখ্যা ৬১ শতাংশ। এই নাটকীয় বৃদ্ধির অন্যতম কারণ ৯/১১। অন্য কারণ সাম্প্রতিক সময়ে ইউরোপে ও আমেরিকায় মুসলিমদের হাতে একাধিক সন্ত্রাসী ঘটনা। এর সঙ্গে যুক্ত করুন ট্রাম্প ও দক্ষিণপন্থী রাজনীতিকদের অহর্নিশ মুসলিমবিরোধী বক্তব্য।

তা সত্ত্বেও আমেরিকায় মুসলিম সম্প্রদায় উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক অগ্রগতি অর্জন করেছে। ২০০১ সালের আগে মার্কিন কংগ্রেসে একজন মুসলিম প্রতিনিধিও ছিলেন না, এখন সেখানে রয়েছেন দুজন। মিনেসোটার রাজ্য আইনসভায় ডেমোক্রেটিক প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছেন ৩৩ বছর বয়স্ক সোমালীয় এক নারী। এই প্রথমবারের মতো মুসলিম-আমেরিকানদের রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেট—উভয় রাজনৈতিক দলের জাতীয় সম্মেলনে মুসলিমদের বক্তব্য প্রদানের সুযোগ দেওয়া হয়েছে, সে কথা তাদের রাজনৈতিক গুরুত্ব প্রমাণ করে। মাত্র গত সপ্তাহে প্রেসিডেন্ট ওবামা একজন পাকিস্তানি-আমেরিকানকে এ দেশের ফেডারেল আদালতের বিচারক পদে মনোনয়ন দিয়েছেন। এ দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় কমেডিয়ানের একজন আসিফ মান্দভি, নিজেকে মুসলিম বলে পরিচয় দিতে তাঁর কোনো দ্বিধা নেই। এ দেশে জাতীয়ভাবে প্রচারিত একটি জনপ্রিয় রেডিও শোর হোস্ট দীন ওবায়দুল্লাহ, প্রতিদিন তাঁর রেডিও শো তিনি শুরুই করেন এই বলে, ‘আমি আপনার মুসলিম বন্ধু।’

৯/১১-এর ঠিক এক সপ্তাহ পরে প্রেসিডেন্ট বুশ ওয়াশিংটন ডিসিতে একটি মসজিদে এসেছিলেন শুধু এ কথা বলতে, ইসলাম আমেরিকার শত্রু নয়। যারা সন্ত্রাসী তারা কেবল আমেরিকার শত্রু নয়, তারা ইসলামেরও শত্রু। যেসব আমেরিকান এই সন্ত্রাসী ঘটনার জন্য মুসলিম-আমেরিকানদের ওপর প্রতিশোধ নিতে চায়, তারা এ দেশের প্রকৃত চেতনার সঙ্গে পরিচিত নয়। প্রেসিডেন্ট ওবামা, পিতার নামানুসারে যাঁর মধ্য নাম হুসেন, তিনিও বলেছেন, ‘আমাদের আসল লড়াই ইসলাম বা মুসলিমদের সঙ্গে নয়। ইসলাম বিশ্বসভ্যতাকে সমৃদ্ধ করেছে, আমেরিকাকে ঐশ্বর্য দিয়েছে।

৯/১১-এর পরের একটি ঘটনা উল্লেখ করা যাক। সেই সন্ত্রাসী হামলার এক সপ্তাহ পরে আমরা নিউইয়র্কের বাঙালিরা ইউনিয়ন স্কয়ারে মোমবাতি হাতে নিয়ে এক নীরব প্রতিবাদ মিছিলে অংশ নেই। আমার সঙ্গে ছিল আমার হাইস্কুল-পড়ুয়া কন্যা শর্মি, নিজের মোমবাতিটি জ্বালাতে সে খুব চেষ্টা করছিল। যতবারই জ্বালায়, দমকা বাতাসে তা নিভে যায়। হঠাৎ দর্শকদের ভেতর থেকে শর্মির বয়সী এক শ্বেতকায়া কিশোরী এসে সে মোমবাতির দুধারে হাত দিয়ে আগলে ধরে বলল, এই তো, এবার জ্বালাও।

ঘৃণা ও বিদ্বেষ কাটাতে হলে আলোর এই শিখাকে আগলে রাখতে হবে, সবাইকে।