যে শূন্যতা পূরণ হয়নি

মিজানুর রহমান খান

গত ৩১ ডিসেম্বর বাংলাদেশের ২৩তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীকে নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। তাঁর এই নিয়োগে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করা হয়েছে কি না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘প্রধান বিচারপতি নিয়োগে জ্যেষ্ঠতার কোনো নিয়ম নেই, সুতরাং নিয়ম লঙ্ঘনের প্রশ্নই ওঠে না।’ এদিকে সার্চ কমিটির মাধ্যমে আইন ছাড়াই আরেকটি নির্বাচন কমিশন গঠনের তোড়জোড় চলছে। এভাবে প্রধান বিচারপতি নিয়োগে নিয়ম না থাকার দোহাই দেওয়া কিংবা বারবার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে আইন ছাড়াই নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে সমালোচনামূলক কলাম, উপসম্পাদকীয় বা মন্তব্য প্রতিবেদন পত্রিকার পাতায় খুব একটা দেখা যায়নি। একইভাবে গত এক বছরে আইন-আদালত-বিচার বিভাগ-সংবিধান নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী তেমন কোনো লেখাও চোখে পড়েনি। এর কারণ কী? এর কারণ হলো সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান এখন আর আমাদের মাঝে নেই।

‘কারও জন্য কোনো কাজ থেমে থাকে না’—এ রকম একটি বহুল প্রচলিত কথা আছে। মিজানুর রহমান খানের ক্ষেত্রে এ কথা যে ভুল প্রমাণিত হয়েছে, ওপরের উদাহরণ থেকেই তা স্পষ্ট। কিন্তু কেন তিনি অপরিহার্য ছিলেন, আর কেনই–বা তাঁর অনুপস্থিতি অপূরণীয়? এসব প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয়, সংবিধান ও আদালতের মতো ‘স্পর্শকাতর’ এবং আইনের মতো ‘জটিল’ ও ‘কঠিন’ বিষয়কে তিনি সহজবোধ্যভাবে পাঠকের কাছে উপস্থাপন করতে পেরেছিলেন, এগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্র ও রাজনীতির সম্পর্ককে সাবলীল লেখনীর মাধ্যমে তুলে ধরতে পেরেছিলেন, সর্বোপরি এ বিষয়গুলোর নানা অসংগতি, সীমাবদ্ধতা বা স্ববিরোধিতাকে সাহসিকতার সঙ্গে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন এবং তিনি এগুলো পেরেছিলেন আইন, বিচার বা সংবিধান নিয়ে কোনো একাডেমিক লেখাপড়া ছাড়াই।

মিজানুর রহমান খান একজন কৃতী সাংবাদিক ছিলেন—এ কথা বলার মধ্যে নতুন কিছু নেই। নাতিদীর্ঘ এই লেখায় সামগ্রিকভাবে তাঁর সাংবাদিকতা বা লেখালেখির পর্যালোচনা করার সুযোগও নেই, বরং নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে তাঁর সাংবাদিকসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি এবং এ ক্ষেত্রে কেন তিনি অন্যদের চেয়ে স্বতন্ত্র, সাহসী ও দূরদর্শী ছিলেন, সে আলোচনাই মনে হয় সমীচীন।

একটা বিষয় লক্ষণীয়, শুধু বাংলাদেশ নয়, ‍দীর্ঘ সময় ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে থাকা যেকোনো দেশের আইনকানুনগুলো সাধারণের জন্য কিছুটা ‘দুর্বোধ্য’ হয়, একইভাবে আদালত বা বিচার বিভাগের সঙ্গেও জনগণের একধরনের ‘দূরত্ব’ থাকে। এর কারণ হলো ঔপনিবেশিক শাসকেরা তাদের প্রয়োজনে, তাদের নিজস্ব স্বার্থে এবং তাদের ভাষাতেই আইনগুলো প্রণয়ন করে; আদালত বা বিচার বিভাগও তৈরি হয় একই পদ্ধতিতে। উপনিবেশ থেকে মুক্ত হওয়ার পর এবং পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক রূপান্তরের ধারাবাহিকতায় কোনো কোনো দেশ তাদের জাতীয় স্বার্থ এবং সাধারণের প্রয়োজনকে প্রাধান্য দিয়ে সংবিধান, আইন, বিচার বিভাগের অনেক পরিবর্তন ঘটিয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশ সে পথে হাঁটেনি। বাংলাদেশের জন্য আরেকটি সত্য হলো এখানে জাতীয় সংসদ নামে পরিচিত ‘আইনসভা’ আইন পাস করলেও আইনের খসড়া তৈরি করে আইন মন্ত্রণালয়, অর্থাৎ আমলারা; ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির উপস্থিতি এখনো তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান বলে অভিযোগ রয়েছে।

এ রকম প্রেক্ষাপটেই আইন, আদালত ও বিচার বিভাগের অনেক ‘কঠিন’ ও ‘জটিল’ বিষয় নিয়ে মিজানুর রহমান খান দৈনিক পত্রিকায় লেখালেখি করেছেন, এই বিষয়গুলোর প্রতি সাধারণ পাঠকের আগ্রহ তৈরি করেছেন এবং এগুলো কীভাবে রাষ্ট্র ও রাজনীতিকে প্রভাবিত করে, জনগণকে সে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। আদালত অবমাননার মামলার খড়্গ মাথায় নিয়েই তিনি বিচার বিভাগের নানা অনিয়ম-অসংগতিকে তুলে ধরেছেন, যা সাহসী সাংবাদিকতার এক অনন্য নজির। তিনি বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সংকটের জন্য শুধু রাজনীতিকে নয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংবিধান, আইন ও আদালতের সীমাবদ্ধতা এবং স্ববিরোধী অবস্থানকে চিহ্নিত করেছিলেন। দূরদর্শী এই সাংবাদিক তাঁর লেখালেখির মাধ্যমে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, শুধু বল প্রয়োগ করেই কর্তৃত্বপরায়ণ শাসন জারি রাখা যায় না, এর পাশাপাশি আইন, আদালত ও বিচার বিভাগকেও তার অধীন করতে হয়। এই বিষয়গুলো নিয়ে তিনি যা লিখেছেন এবং যে ভাষায় লিখেছেন, প্রথাগত সাংবাদিকতার জগতে তা এক নতুন এক দিক উন্মোচন করেছে।

আইন, আদালত ও বিচার বিভাগ নিয়ে মিজানুর রহমান খানের বোঝাপড়া একজন আইনজ্ঞ বা সংবিধান বিশেষজ্ঞের চেয়ে কোনো অংশেই কম ছিল না, পত্রিকার পাতায় লেখাগুলোই এর প্রমাণ। কিন্তু তিনি এটা অর্জন করেছিলেন একাডেমিক লেখাপড়ার মাধ্যমে নয়, বিষয়গুলোর প্রতি তাঁর তীব্র আগ্রহ (প্যাশন) ও অঙ্গীকারের (কমিটমেন্ট) জায়গা থেকে। মিজানুর রহমান খানের মৃত্যুর পর তাঁর এক সহকর্মী বলেছিলেন, লেখালেখি বা কাজ নিয়ে তিনি মাঝেমধ্যে এতটাই মগ্ন হয়ে থাকতেন, পাশের টেবিলে কী ঘটছে, কে কী বলছে, সেগুলোও পর্যন্ত খেয়াল করতেন না। বিষয়ের প্রতি আগ্রহ ও অঙ্গীকার এবং কাজের প্রতি মগ্নতা ও একাগ্রতাই সাংবাদিক হিসেবে তাঁকে অসামান্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে।

মিজানুর রহমান খান যে পত্রিকায় কাজ করতেন, সেই প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন, তিনি নাকি ১৯৯৫ সালে ভোরের কাগজ–এ কাজ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কোনো কারণে তখন সেই সুযোগ হয়নি। এর ১০ বছর পর ২০০৫ সালে তিনি প্রথম আলোয় যোগ দেন। এ ঘটনা নিয়ে মিজানুর রহমান খান প্রথম আলোর সম্পাদককে মাঝেমধ্যে বলতেন, ‘মতি ভাই, আমার ১০টি বছর ফিরিয়ে দিন।’ মিজানুর রহমান খান হয়তো তাঁর দক্ষতা, যোগ্যতা ও কর্মতৎপরতা দিয়ে সেই ১০ বছরের ‘ঘাটতি’ পূরণ করে নিতে পেরেছিলেন। কিন্তু তাঁর অকালমৃত্যুতে স্বতন্ত্র ও সাহসী সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তা কোনোভাবেই পূরণ হওয়ার নয়। তাঁর এভাবে চলে যাওয়া বাংলাদেশে আইনের শাসন, গণতন্ত্র এবং জনস্বার্থের পক্ষে সাংবাদিকতার এক অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবেই বিবেচিত হবে।

মিজানুর রহমান খান আজ নেই, সেই না থাকার কোনো সান্ত্বনাও নেই, কিন্তু আইন-আদালত-বিচার বিভাগে অসংগতি, অসামঞ্জস্য ও অনিয়ম এখনো রয়ে গেছে। সাংবাদিক হিসেবে পাঠকের কাছে, জনগণের কাছে সেগুলো তুলে ধরার দায়টাও তাই আমাদের রয়ে গেছে। সেই দায় মেটানোর ক্ষেত্রে মিজানুর রহমান খান একজন অনুকরণীয় আদর্শ হিসেবেই চিরকাল বেঁচে থাকবেন—তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।