যে হাতে লাঙল, সে হাতে কি-বোর্ড

ভোর থেকেই রহিদুল মাঠে চাষ করেন
ভোর থেকেই রহিদুল মাঠে চাষ করেন

ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে রহিদুল মিয়া কাঁধে লাঙল তুলে রওনা দেন খেতের উদ্দেশে। হাল জোড়েন, জোয়াল চাপান গরুর কাঁধে। লাঙলের খুঁট নিজ হাতে ধরেন। জমি চাষ করেন। চষা জমিতে মই দেন, তা-ও নিজ হাতে। যেদিন হালচাষ থাকে না, পুরো খেত নিজে ঘুরে দেখেন। ১০টায় বাড়ি ফিরে আসেন। এবার তাঁর চিন্তা, কী লিখবেন। কোথায় কী ঘটল এলাকায়। ঘটনাস্থলে যেতে হবে। যান। খোঁজখবর করেন। তারপর বাড়ি ফিরে কম্পিউটারে বসেন। নিজ হাতে লেখেন প্রতিবেদন। পাঠিয়ে দেন প্রথম আলোর ই-মেইল ঠিকানায়।
মাটির সন্তান—সান অব দ্য সয়েল, কথাটা শুনি। এই প্রথম কাছে থেকে দেখি। আমার পাশে বসে আছেন রহিদুল মিয়া। প্রথম আলোর তারাগঞ্জ (রংপুর) প্রতিনিধি। তাঁদের এলাকার মহাসড়কের পাশে ১৯ অক্টোবর ২০১৩ সকালে একটা জিলিপির দোকানে বসে আমরা গল্প করি। আমি আর ফটোসাংবাদিক জিয়া ইসলাম। আমরা তারাগঞ্জে গেছি একটা সরেজমিন প্রতিবেদন করতে।
কিন্তু রহিদুলের নিজের জীবনের কাহিনি শুনে মনে হয়, আরে, স্টোরি তো আমার সামনে বসে আছে!

সকাল ১০টা থেকেই ব্যস্ত থাকেন সাংবাদিকতায়
সকাল ১০টা থেকেই ব্যস্ত থাকেন সাংবাদিকতায়

রহিদুল মিয়া কৃষকের ছেলে। চাষবাসকে তিনি গৌরবের কাজ মনে করেন। পাশাপাশি তিনি ভীষণ নিষ্ঠাবান সাংবাদিকতার ব্যাপারে। তারাগঞ্জ একটা ছোট্ট উপজেলা। এই ছোট্ট এলাকায় কাজ করেও এই পর্যন্ত প্রথম আলোর শনিবারের বিশেষ প্রতিবেদন সবচেয়ে বেশি লিখেছেন এই রহিদুল মিয়াই। প্রায় ৩৫টি শনিবারের প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে রহিদুলের।
এগুলোর মধ্যে তাঁর নিজের সবচেয়ে পছন্দ ‘বিন্দু বিন্দু তেল, ফোঁটা ফোঁটা ঘাম’ নামের কাহিনিটি। একদিন তিনি তেল কিনতে গেছেন পাশের গ্রামে। দেখেন, এক কলুর পিঠে অনেক দাগ। ‘ভাইজান, এত দাগ কিসের?’ ‘গরু নাই বাহে, নিজেই তো ঘানি টানি।’ মকসুদার নামের সেই কলুর কাহিনি ছাপা হলো প্রথম আলোয়। দেশ-বিদেশ থেকে মানুষ বাড়িয়ে দিল সাহায্যের হাত। ১৯টি গরু, লক্ষ টাকা পেলেন তিনি। জীবন বদলে গেল ওই ঘানিটানা মানুষটার। শুধু তা-ই নয়, ওই এলাকার ৬০টি তেলি পরিবারের প্রত্যেকে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পেল গরু।
৩৩ বছরের রহিদুল বিবাহিত, তাঁর স্ত্রী সীমা আক্তার গৃহকর্ম করেন, দুই মেয়ে অনামিকা (৮) ও অনন্যা (১)। বাবা বেঁচে আছেন। তাঁর কিছু জমি আছে। রহিদুল আবাদ করেন অন্যের জমি, চুক্তিভিত্তিক বর্গা নিয়ে। গত বছর আলু আবাদ করে ১০ লাখ টাকা লোকসান দিয়েছেন, হাসেন, ‘কোনো দুঃখ নাই, তার আগের বছর ২৮ লাখ টাকা লাভ যে করেছিলাম!’

‘আপনার সাংবাদিকতা জীবনের বড় পাওয়া কী? বড় কষ্ট কী?’ রহিদুল একটাই ঘটনা বলেন। গত বছর ৭ নভেম্বর তারাগঞ্জেই আহমদিয়া সম্প্রদায়ের এবাদতখানায় আগুন দিয়েছিল উন্মত্ত জনতা। খবরের সন্ধানে ছুটে গেছেন সেখানে তিনি। দেখেন, জ্বলন্ত ঘরের মধ্যে দুটো শিশু। নির্ঘাত পুড়ে মারা যাবে। তিনি ছুটে গিয়ে তাদের বের করে আনেন। তখনই তাঁর ওপর হামলে পড়ে মত্ত নৃশংস জনতা। লাঠি দিয়ে পিটিয়ে তাঁকে মুমূর্ষু অবস্থায় ফেলে রেখে যায় তারা। হাসপাতালে ২১ দিন ছিলেন, এখনো রহিদুলের দাঁত ভাঙা, চোয়াল ফাটা। ভুলতে পারেন না তিনি সেই দুঃসহ স্মৃতি। তবে সান্ত্বনা এই, ওই গ্রামের মানুষ পরে এসে তাঁর কাছে ক্ষমা চেয়ে গিয়েছিল।

রহিদুলের সবচেয়ে বড় সান্ত্বনা হলো, ওই শিশু দুটো সে যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিল।

শুনে আমার চোখ ছলছল করে। গত জানুয়ারিতে আমরা একটা সিরিজ শুরু করেছিলাম, ‘আমিই বাংলাদেশ’। রহিদুলরাই তো বাংলাদেশ!

আনিসুল হক: সহযোগী সম্পাদক