যোগাযোগে নতুন দিন আনবে পদ্মা সেতু

আগামীকাল শনিবার পদ্মা সেতু চালু হলে শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ির ফেরি পারাপারও ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নেবে। সম্প্রতি মুন্সিগঞ্জের মাওয়ায়
ছবি: সৈয়দ জাকির হোসেন

সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের হিসাবে, তেঁতুলিয়া থেকে কুয়াকাটার দূরত্ব ৮০০ কিলোমিটারের কাছাকাছি। ঢাকা হয়ে পদ্মা নদীর ওপর দিয়ে এই পথ যেতে একসময় আটটি ফেরি পাড়ি দিতে হয়েছে। যমুনা নদীতে বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হওয়ার আগে ফেরি ছিল নয়টি। আগামীকাল শনিবারের পর কেউ তেঁতুলিয়া থেকে এই পথে যাত্রা করলে কোনো ফেরিই পাড়ি দিতে হবে না।

পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়া হচ্ছে দেশের সর্ব উত্তরের উপজেলা। আর কুয়াকাটা পটুয়াখালীর শেষ সীমানায়, সাগরকূলে। যেখানে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রসৈকত রয়েছে।

পদ্মা সেতু চালু হলে ফেরি পারাপারের ভোগান্তি থাকবে না দেশের উত্তর-পূর্ব প্রান্তের জেলা সিলেটের জাফলং থেকে খুলনায় যাতায়াতের ক্ষেত্রেও। এই পথের দূরত্ব প্রায় ৫৬৫ কিলোমিটার। ২০০৩ সালে ভৈরব ও আশুগঞ্জের মধ্যে সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতু চালুর পর সিলেট থেকে ঢাকায় সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হয়। শনিবার পদ্মা সেতু চালু হলে শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ির ফেরি পারাপারও ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নিতে পারে।

ফেরি মানেই ঘাটে ভোগান্তি, ধীরগতির নদী পারাপার, ঘন কুয়াশা, ঝড় ও দুর্যোগে যাত্রা বাতিল এবং বেশি স্রোত অথবা নদীর নাব্যতাসংকটে ফেরি অচল। ঈদ কিংবা বড় কোনো ছুটিতে ভোগান্তি বাড়ে কয়েক গুণ।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কগুলোতে একে একে সেতু হয়েছে। মানুষের যোগাযোগ সহজ হয়েছে। পণ্য পরিবহন গতি পেয়েছে। বড় বাধা ছিল পদ্মা পারাপার। এই নদী পাড়ি দিয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৯টি জেলায় যাতায়াতে ফেরিঘাটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতো মানুষকে, পণ্যবাহী ট্রাককে।

পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করা হবে আগামীকাল। সেতুটি দিয়ে ঢাকা থেকে মাওয়া হয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হবে। এর মাধ্যমে দেশের প্রধান ১০টি মহাসড়কের ৯টিই ফেরি পারাপারের ভোগান্তিমুক্ত হবে (ঢাকা থেকে পাটুরিয়া হয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যাতায়াত বাদে)। দেশের যোগাযোগব্যবস্থায় নতুন দিগন্ত নিয়ে আসবে পদ্মা সেতু।

বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক রুস্তম আলী খান এই খাতের সঙ্গে যুক্ত ১৯৬৭ সাল থেকে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পদ্মা পাড়ি দিতে ফেরিঘাটে ট্রাককে সাধারণত পাঁচ-সাত ঘণ্টা অপেক্ষায় থাকতে হয়। মাঝেমধ্যে লাগে দুই থেকে তিন দিন। তিনি আরও বলেন, ‘অপেক্ষা মানেই চালক-সহকারীর বাড়তি খরচ। পণ্যের মালিকের ক্ষতি। এখন শুনছি ৬ মিনিটে পদ্মা নদী পার হওয়া যাবে। পরিবহন খাতের মানুষ হিসেবে এটা বড় পাওয়া।’

পদ্মা, যমুনা ও মেঘনা—এই তিন নদী বাংলাদেশের ভূখণ্ডকে মূল তিনটি ভাগে ভাগ করেছে। ঢাকা ঘিরে মধ্যাঞ্চল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগ নিয়ে পূর্বাঞ্চল এবং রাজশাহী, রংপুর, খুলনা ও বরিশাল নিয়ে পশ্চিমাঞ্চল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পর্যায়ক্রমে সড়ক যোগাযোগ বিস্তৃত হয়েছে। মেঘনা, মেঘনা-গোমতী, বঙ্গবন্ধু ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতু (ভৈরব) নির্মাণের ফলে মধ্য, পূর্বাঞ্চল এবং উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর সরাসরি সড়ক যোগাযোগ সম্ভব হয়। সারা দেশকে সড়ক যোগাযোগে এক সুতায় বাঁধার কাজটি আটকে থাকে পদ্মা নদীর কারণে। পদ্মা নদীর এই দুই পাড়কে জুড়ে দিতে ১৯৯৯ সালে প্রাক্‌-সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের মাধ্যমে স্বপ্নের শুরু। ২৫ জুন পদ্মা সেতু চালুর মাধ্যমে এর পূর্ণতা পেতে যাচ্ছে।

পদ্মা সেতু যেভাবে যাতায়াত সহজ করবে

মাওয়া হয়ে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যেতে ঢাকা থেকে বের হওয়ার মূল পথ বুড়িগঙ্গার ওপর রয়েছে দুটি সেতু। একটি বাবুবাজারে, অন্যটি পোস্তগোলায়। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ ঢাকার যানজট ঠেলে এই দুটি সেতুতে উঠতে পারলেই অনেকটা নিশ্চিন্ত হতে পারবেন। কারণ, ২০২০ সালে ঢাকা থেকে মাওয়া পর্যন্ত ৫৫ কিলোমিটারের প্রবেশ নিয়ন্ত্রিত চার লেনের মহাসড়ক বা এক্সপ্রেসওয়ে চালু হয়েছে। এর নাম জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাসড়ক।

পোস্তগোলা সেতু ধরে এক্সপ্রেসওয়েতে যেতে পারলে যাত্রাটা আরও কিছুটা সহজ। কারণ, মেয়র হানিফ উড়ালসড়ক এবং জুরাইনে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথের ওপর নির্মিত উড়ালসেতু দ্রুতগতির মহাসড়কের সুবিধা ঢাকার ভেতরে পৌঁছে দিয়েছে। যেমন চানখাঁরপুল, গুলিস্তান, টিকাটুলী, সায়েদাবাদ ও শনির আখড়া—এই পাঁচ স্থানের যেকোনো একটি দিয়ে হানিফ উড়ালসড়কে উঠলে তা একপ্রকার চার লেনের মহাসড়কে যুক্ত করে দেয়।

ঢাকার একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আলিমুজ্জামানের গ্রামের বাড়ি যশোর। এবার পবিত্র ঈদুল আজহায় পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার তর সইছে না তাঁর। তিনি বলেন, ‘এত দিন বাড়ি যাওয়ার জন্য আকুল হয়ে থাকতাম। কিন্তু ফেরিঘাটের ভোগান্তির ভয়ে অনেক সময় যেতে পারতাম না। এখন এই দুঃখ ঘুচবে মনে হয়।’

পদ্মা সেতু চার লেনের, চওড়া ২২ মিটার। এর একেক পাশ দিয়ে দুটি করে চারটি যানবাহন আসা-যাওয়ার পরও ফাঁকা জায়গা থাকবে। এই সেতুর সদ্ব্যবহার করতে হলে আগে-পরের মহাসড়কও চওড়া করা জরুরি ছিল। এ লক্ষ্যে বুড়িগঙ্গার ওপার থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ৫৫ কিলোমিটার প্রবেশ নিয়ন্ত্রিত দ্রুতগতির মহাসড়ক নির্মাণ প্রকল্প নেয় সরকার। এই সড়কের বিশেষত্ব হচ্ছে, চার লেনের মূল সড়কে বাইরে থেকে যখন-তখন যানবাহনের প্রবেশের সুযোগ নেই। নির্দিষ্ট কিছু স্থান দিয়ে মহাসড়কে প্রবেশ ও বের হওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এই ব্যবস্থা এমনভাবে করা হয়েছে, যাতে যানবাহনের চলাচল বাধাগ্রস্ত না হয়। বাসে যাত্রী ওঠানামার জন্য ছাউনিসহ কিছু স্থানে বাসস্টপেজ আছে।

পুরো মহাসড়কে পাঁচটি উড়ালসেতু, ১৯টি পাতালপথ এবং প্রায় ১০০টি ছোট-বড় সেতু ও কালভার্ট আছে। এগুলোর নকশা বেশ নান্দনিক, উঁচু-নিচু করে তৈরি করা। ফলে রাতে সড়ক বা সেতুর বাতি সৌন্দর্য ছড়ায়। মাঝখানে বেশ চওড়া সড়ক বিভাজক আছে। এতে ফোটে নানা রঙের ফুল। স্থানীয় মানুষের ব্যবহারের জন্য দুই পাশে ১৮ ফুট চওড়া সড়ক (সার্ভিস রোড) আছে, যা মূল মহাসড়ক থেকে অনেকটা নিচু। দুই পাশের সার্ভিস রোডে পারাপার হয় পাতালপথে। এর ফলে ঢাকা থেকে ভাঙ্গার যাতায়াত এখন এক ঘণ্টায় নেমে এসেছে। এই মহাসড়ক নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১১ হাজার ৪ কোটি টাকা। সওজের তত্ত্বাবধানে নির্মাণ করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।

ভাঙ্গা ‘ক্লোভারলিফ ইন্টারচেঞ্জ’

পদ্মা সেতু ১৯ জেলার মানুষকে যুক্ত করবে—এমনটাই বলা হয়েছে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি)। তবে কেউ কেউ বলছেন, আসলে সড়কপথে যোগাযোগ স্থাপিত হবে ২১ জেলার সঙ্গে, অর্থাৎ পুরো খুলনা ও বরিশাল বিভাগ এবং ঢাকা বিভাগের বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চল। পদ্মা সেতু পার হয়ে এই জেলাগুলোতে যাতায়াতের মূল কেন্দ্র হচ্ছে ভাঙ্গা। সেখানে চারটি মহাসড়ক গিয়ে মিশেছে। এসব মহাসড়কের যানবাহন চলার পথ নির্বিঘ্ন করতে ভাঙ্গায় নির্মাণ করা হয়েছে বহুমুখী উড়ালপথ, যা প্রকৌশলীদের ভাষায় ‘ক্লোভারলিফ ইন্টারচেঞ্জ’ নামে পরিচিত। এটি চারটি মূল মহাসড়কে উড়ালপথে যুক্ত করেছে।

ইন্টারচেঞ্জটির নির্মাণকৌশল ঘোরানো-প্যাঁচানো। এর যেকোনো একটি পথ ধরে আসা যানবাহন অন্য যেকোনো তিনটি পথে চলে যেতে পারবে। কোনো যান চলার পথে অন্য যানের জন্য বাধা হবে না। অক্সফোর্ড ডিকশনারি অনুসারে, ক্লোভারলিফ হচ্ছে একটি ছোট বন্য গাছের পাতা। এই গাছের প্রতিটি কাণ্ডে তিনটি পাতা থাকে। অর্থাৎ চার মুখওয়ালা পথ বিভিন্ন স্তরে মিলিত হয়ে ক্লোভারলিফের আকৃতি ধারণ করেছে।

ভাঙ্গা ইন্টারচেঞ্জের ঢাকামুখী মহাসড়কটি পদ্মা সেতুতে মিশেছে। অন্য তিনটি পথ হচ্ছে: ১. ভাঙ্গা-মাদারীপুর-বরিশাল-কুয়াকাটা। ২. ভাঙ্গা-গোপালগঞ্জ-বাগেরহাট-খুলনা-সাতক্ষীরা। ৩. ভাঙ্গা-ফরিদপুর-রাজবাড়ী-গোয়ালন্দ।

ঢাকাসহ সারা দেশের যানবাহন পদ্মা সেতু হয়ে ভাঙ্গায় গিয়ে বিভিন্ন দিকে যাবে। মাদারীপুর, বরিশাল ও পটুয়াখালী হয়ে একটি মহাসড়ক কুয়াকাটায় গিয়ে শেষ হয়েছে।

গোপালগঞ্জ হয়ে খুলনামুখী মহাসড়কটির বেশ কিছু বিকল্প পথ আছে। একটি পথ গোপালগঞ্জের ভেতর দিয়ে নড়াইল হয়ে যশোরে সংযোগ স্থাপন করবে। যশোর সংযুক্ত হওয়া মানে হলো সেখান থেকে উত্তরবঙ্গের সঙ্গেও সংযুক্তি। তবে এর জন্য গোপালগঞ্জ ও নড়াইলের মধ্যে নির্মাণাধীন কালনা সেতু চালু হতে হবে। সেতুটির নির্মাণকাজ শেষের পথে। গোপালগঞ্জ হয়ে বাগেরহাট, মোংলা বন্দর এবং পিরোজপুরের সহজ যোগাযোগ রয়েছে।

ভাঙ্গা থেকে একটি মহাসড়ক গোয়ালন্দের দিকে গেছে। সেটি পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া হয়ে খুলনাগামী মহাসড়কে সংযুক্ত হয়েছে। অর্থাৎ এই পদ্মা সেতু সারা দেশের সঙ্গেই সড়কপথে এক যোগসূত্র স্থাপন করে দিয়েছে।

১৯৯৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যখন পদ্মা সেতুর সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু হয়, তখন থেকেই স্বপ্ন দেখছে মানুষ। তাদের অপেক্ষা ঘুচবে মাত্র এক দিন পর।