রক্তের প্রয়োজনে

শিরিন বেগম

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে প্রায়ই তাঁর পোস্ট নজরে আসে রক্তের আহ্বানে। নিজের ফেসবুক আইডির পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে রক্তদানের আহ্বান করেন তিনি। আহ্বানে নিরাশ হন না। মুমূর্ষু রোগীর জন্য রক্ত জোগাড় করার পরই তিনি হাঁপ ছাড়েন। তাঁর এ নিরলস প্রচেষ্টায় প্রায়ই মুমূর্ষু রোগীরা রক্ত পেয়ে বেঁচে যান। শুধু রক্ত জোগাড় করাই নয়, অসহায় মানুষের জন্য খাবার, কাপড়, ঘরবাড়ি, চিকিৎসা, দরিদ্র শিশুদের জন্য পড়াশোনার খরচ জোগাড় করে দেওয়া সবই করে থাকেন তিনি। অসহায় ও দরিদ্র মানুষের কাছে তিনি এক মানবতার প্রতীক। এ উদ্যোগ যাঁর, তিনি সানজানা শিরিন। পেশায় মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট।

সানজানা শিরিনের এ মানবসেবী কাজগুলো নিয়ে প্রথম আলোর ছুটির দিনে গত ৬ এপ্রিল ২০১৯ প্রকাশিত হয় ‘রক্তের প্রয়োজনে সানজানা’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন। এরপর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হতে থাকে তাঁকে নিয়ে প্রতিবেদন, সাক্ষাৎকার ইত্যাদি। সানজানা সেই জায়গায়ই থেমে থাকেননি। পত্রিকায় নাম আসার পর সানজানা আরও বেশি কাজ শুরু করেন।

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার ৫০ শয্যাবিশিষ্ট ক্যামেলিয়া ডানকান ফাউন্ডেশন পরিচালিত হাসপাতালে কাজ করছেন সানজানা। ১৭টি চা–বাগানের শুধু চা–শ্রমিকদের চিকিৎসার জন্য কাজ করে এ হাসপাতাল। রোগীর সেবা করাই সানজানার কাজ, তবে পেশাগত দায়িত্বের বাইরেও নিজেই কাঁধে তুলে নিয়েছেন এ বাড়তি দায়িত্বগুলো।

সানজানার প্রিয় কাজ গর্ভবতী মায়ের স্বাভাবিক প্রসব করানো। ১৬ ডিসেম্বর ২০২০ পর্যন্ত ৫৭৬ জন মায়ের স্বাভাবিক প্রসব করিয়েছেন সানজানা শিরিন।

এ বাড়তি দায়িত্ব নেওয়ার ঝোঁকটা ছোটবেলার। সানজানার বাড়ি হবিগঞ্জ জেলায়। তাঁর বেড়ে ওঠা অনেকটা প্রতিকূল পরিবেশে। সানজানা বলছিলেন, ‘মা-বাবা কেউ পড়াশোনা করেননি। আমরা ৬ বোন ২ ভাই। বড় বোনের বিয়ে হয়েছে। পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। তারপরও আমরা বোনেরা চেয়েছি পড়াশোনা চালিয়ে যেতে।’

রীতিমতো যুদ্ধ করেই পড়াশোনা করতে হয়েছে সানজানাকে। পড়াশোনার ফাঁকেই পাশে দাঁড়িয়েছেন অসহায় মানুষের। মাধ্যমিক শেষে হবিগঞ্জের বৃন্দাবন কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। তারপর থমকে যায় পড়াশোনা। কিন্তু সানজানার ইচ্ছার কাছে হেরে যায় পরিবার। ভর্তি হন মৌলভীবাজারের মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুলে (ম্যাটস)। সেখান থেকেই পাস করে বিভিন্ন ক্লিনিকে কাজ করেছেন।

স্বল্প বেতনের চাকরি থেকে মাস শেষে যা হাতে আসে, তা দিয়ে নিজে চলেন, বোনের পড়াশোনার খরচ চালান। আর রক্ত নিয়ে কাজ তো আছেই। সানজানার রক্তদান শুরু হয় যখন তিনি মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালে কাজ করতেন, সে সময়। সেটা ২০১৪ সালের কথা। সানজানা শিরিন বলছিলেন, ‘দরিদ্র রোগীরা যখন বিনা মূল্যে রক্ত পেয়ে সুস্থ হয়ে ওঠেন, তাঁদের হাসিমুখ দেখার মতো প্রশান্তির কিছু নেই।’