রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে বেশি মন্তব্য

প্রথম আলোর উদ্যোগে পরিচালিত তারুণ্য জরিপ-২০১৭ নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে অতি সম্প্রতি। দেশের তরুণদের ভাবনা জানতে প্রথম আলোর উদ্যোগে ওআরজি-কোয়েস্ট গত মার্চে সারা দেশে জরিপ করে। প্রথম আলোর ওয়েবসাইটে পাঠকদের আনুষ্ঠানিক মতামত দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। এতে মন্তব্য করেছেন অনেকেই। প্রাথমিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে মন্তব্য পড়েছে বেশি। এর বাইরে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা ও চাকরির বাজার নিয়ে নিজেদের মতামত জানিয়েছেন তরুণেরা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়েও মন্তব্য করেছেন অনেকে।
তারুণ্য জরিপে দেখা যায়, ভবিষ্যৎ কর্মক্ষেত্র নিয়ে ভরসা করতে পারছেন না ৮২ শতাংশের বেশি তরুণ। এ নিয়ে মন্তব্যও পড়েছে বেশি। মুহাম্মদ আরিফুর রহমান লিখেছেন, ‘তরুণেরা, আসুন সবাই চুরি করি, পাপ হবে না। আমিসহ বাংলাদেশের সব বেকার যুবক চাকরির আবেদন দেখলেই ঢুঁ মারি। সেই চাকরির আবেদনেই যদি টাকা লাগে, তবে আমি টাকা কোথায় পাব? তাহলে কি আমার চুরি করা বাধ্যতামূলক নয়?’ তাঁর অভিযোগ, টাকা দিয়ে আবেদন করলেও সাক্ষাৎকার বা নিয়োগ পরীক্ষায় ডাক পাওয়া যায় না।
অন্যদিকে কাজী আলম কর্মসংস্থানভিত্তিক শিক্ষা চালু করার ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি বেকার ভাতা চালু করার দাবি জানিয়েছেন।
পবিত্র চাকমার মতে, এখন লাখ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে সরকারি চাকরি পাওয়ার কথা শোনা যায়। তিনি লিখেছেন, ‘তখন আমার মাথা ঘুরে যায়। চিন্তা করতে থাকি আমি কি চাকরি পাব? আমার বাবার তো এত টাকা নেই। যত দ্রুত সম্ভব এই ঘুষ-দুর্নীতি দমন করতে হবে।’
জরিপে অংশ নেওয়া তরুণদের ৫১ দশমিক ২ শতাংশ রাজনীতি নিয়ে তাঁদের অনাগ্রহের কথা সরাসরি জানিয়েছেন। কেফায়েত শাকিল লিখেছেন, ‘একজন তরুণ হিসেবে আমি মনে করি, এর জন্য আমাদের রাজনীতির পরিবেশ, রাজনৈতিক দল ও ছাত্রসংগঠনগুলো দায়ী।’
শামসুল হক লিখেছেন, ‘আমাদের দেশে রাজনীতি করার মতো কোনো পরিবেশ নেই। সত্যিকারের রাজনীতির উদ্দেশ্য হলো সাধারণ মানুষের কল্যাণ করা। কিন্তু এ দেশে হচ্ছে উল্টোটা। বর্তমান প্রজন্ম মনে করে, রাজনীতি মানে বিরোধী পক্ষের ওপর হামলা, খুনোখুনি এবং রাষ্ট্রে নৃশংসতা সৃষ্টি করা।’
তানভীর আহমেদ লিখেছেন, ‘আজকে আমরা জানি না যে পড়াশোনা শেষ করে কী করব। অনেক বেশি হতাশায় ভুগি। আর এর কারণ রাজনৈতিক পরিবেশ।’
রাজনীতি করার জন্য দেশের নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদারের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন বি এম রুমি। তিনি লিখেছেন, ‘মতের গুরুত্ব না থাকলে এটা করা প্রায় অসম্ভব। আমি রাজনীতি পছন্দ করি। কিন্তু রাজনীতির কারণে জীবনের ওপর হুমকি আসায় সাধারণ মানুষ রাজনীতিতে আসছে না।’
এতে দেখা গেছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের ৯৫ শতাংশের কাছে ফেসবুক প্রথম পছন্দ। বয়স, পেশা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, ছেলেমেয়ে—সবার পছন্দের তালিকায় এক নম্বরে আছে ফেসবুক। এর মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম গৃহবধূরা। এই শ্রেণির ৬৫ শতাংশের কাছে ফেসবুক জনপ্রিয়।
জরিপের তথ্য বলছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ইন্টারনেটে বেশি সময় দেওয়ার কারণে তরুণদের পড়ালেখার সময় কমে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীরা ক্লাসের বাইরে পড়ালেখায় গড়ে সময় দেয় মাত্র ৩৯ মিনিট। এর মধ্যে ৫৬ শতাংশ ৩০ মিনিট বা তারও কম সময় পড়ালেখা করে ক্লাসের বাইরে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে পারিবারিক বন্ধন দিন দিন শিথিল হয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন তৌহিদ আহমেদ। তিনি লিখেছেন, ‘এ কারণে আমাদের মন বিদ্বেষে ভরে যাচ্ছে। সামাজিক মূল্যবোধের দাম নেই এখন। আমরা অসামাজিক হয়ে যাচ্ছি।’
প্রথম আলোর উদ্যোগে পরিচালিত তারুণ্য জরিপের দ্বিতীয় কিস্তিতে গত সোমবার প্রকাশিত হয়। তাতে দেখা গেছে, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে তরুণেরা, দূরত্ব বাড়ছে মা-বাবার সঙ্গে। জরিপে অংশ নিয়ে ৭২ দশমিক ৬ শতাংশ তরুণই বলেছেন যে পরিবার ও মা-বাবার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে না পারাটাই তাঁদের জন্য সবচেয়ে চিন্তার বিষয়। ভবিষ্যৎ লক্ষ্য নিয়েও তরুণদের দুশ্চিন্তা রয়েছে। জীবনের লক্ষ্য খুঁজে পেতে পরিবার থেকেও খুব বেশি সহায়তা পাচ্ছেন না তাঁরা।
তারুণ্য নিয়ে এ ধরনের জরিপ বা গবেষণাকে ‘ইতিবাচক’ বলে মন্তব্য করেছেন কাজী মফিজুর রহমান। তিনি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তিনি লিখেছেন, ‘প্রায় প্রত্যেক সেমিস্টারের প্রথম ক্লাসে জিজ্ঞেস করতাম, কেন বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছ? দেখা যেত সুনির্দিষ্ট কারণ সম্পর্কে অধিকাংশেরই সুস্পষ্ট ধারণা নেই। চাকরি পাওয়া, ডিগ্রি পাওয়া, কিংবা ভালো থাকা গোছের উত্তর দিত। আমার মনে হয়, পরিবার তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারেনি। তাঁরা শিক্ষার্থীদের মুখস্থ করিয়ে পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করাকেই সার্থকতা ভেবেছে। আমাদের ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষা কারিকুলাম ও সৃজনশীল শিক্ষকের অভাবও এর জন্য দায়ী। নিজের খেয়ালে শেখা বা ভালোবেসে লেখাপড়া করা আমাদের সংস্কৃতিতেই নেই।’
মো. রওনক খান নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা জানিয়ে মতামত দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘ক্যারিয়ারের জন্য নিজের শখকে বিসর্জন দিয়েছি। চাপে থাকতে থাকতে প্রেশার কুকার হয়ে গেছি। একঘেয়ে এই শিক্ষাব্যবস্থায় আমি কোনো আগ্রহ পাই না। শুধু গ্রেডের জন্য লড়াই করি। ভালো একটা চাকরি দরকার। তা না হলে সামাজিকভাবে নির্যাতনের শিকার হতে হবে আমাকে।’
বসির আহমেদ লিখেছেন, ‘জরিপটি নিয়ে সরকারকে গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে এবং ব্যবস্থা নিতে হবে। সমস্যা মহামারি আকার ধারণ করার আগেই সমাধান করার উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।’
সামগ্রিক জরিপ নিয়ে মো. ফরহাদ কবির চৌধুরী লিখেছেন, আরও বেশি লোকের ওপর এই জরিপ চালানো উচিত ছিল। সাঈদ আজাহার পুরো জরিপের সঙ্গেই একমত নন। তিনি লিখেছেন, ‘দেখে মনে হচ্ছে জরিপটা শহরভিত্তিক। শহরে মানুষ মিলেমিশে থাকার সুযোগ পাচ্ছে না বললেই চলে। কিন্তু গ্রামে এ অবস্থা শহরের চেয়ে ভিন্ন। তাই পুরো পরিসংখ্যানের সঙ্গে আমি একমত নই।’
এই জরিপে শ্রমজীবী তরুণদের কোনো ভাষ্য নেই মন্তব্য করে আনিস রায়হান প্রশ্ন করেছেন, ‘এই তরুণেরা আসলে কোন শ্রেণির? দেশে কি মধ্য ও উচ্চবিত্তের তুলনায় শ্রমজীবীরা কমে গেছে, নাকি তাদের বাদ দিয়েই এই জরিপ করা হয়েছে? নইলে ৭৩.৮ শতাংশ তরুণের অর্থনীতি নিয়ে সন্তুষ্ট হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’
অন্যদিকে সাজ্জাদ হোসেইন লিখেছেন, ‘উদ্যোগটা ভালো। এটা আরও বড় পরিসরে করা উচিত। সবার কাছে যেন এটি পৌঁছায়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।’
তারুণ্য জরিপ চালানোর জন্য প্রথম আলোকে ধন্যবাদ জানিয়ে শাহ্ আসিফ আবদুল্লাহ লিখেছেন, ‘একজন বাংলাদেশি তরুণ হিসেবে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এই জরিপ খুবই কার্যকর হবে এবং দেশের নীতিনির্ধারকদের কাছে যথাযথ বার্তা দেবে।’
দেশের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে অনেকেই মন্তব্য করেছেন। মো. আনিসুর রহমান লিখেছেন, ‘প্রশ্ন ফাঁস, বাজে গ্রেডিং ব্যবস্থা, কোচিংয়ের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা এবং সবকিছুর ওপর দুর্নীতি শিক্ষাব্যবস্থার দুরবস্থার কারণ।’
কুমার দীপ একজন শিক্ষক। তাঁর মতে, তরুণদের খুব ছোট্ট একটি অংশ অসাম্প্রদায়িক চেতনা হৃদয়ে লালন করে। তিনি লিখেছেন, ‘তরুণদের কাছে বই বলতে দু-চারটে সিলেবাসের বই। বাকিটা ফেসবুক।’
জঙ্গিবাদ একটি বৈশ্বিক সমস্যা বলে উল্লেখ করেছেন এস আলম। তিনি লিখেছেন, ‘সারা পৃথিবীতে যা ঘটছে, বাংলাদেশে তার বাতাস লেগেছে মাত্র। তবে শুধু ৭৫ শতাংশ তরুণ নয়, আমি মনে করি, ৯৯ শতাংশ বাংলাদেশিই এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন।’
মুহম্মদ ফজলুল করিম লিখেছেন, ‘চাইলেই তরুণদের মধ্যে দেশীয় শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিস্তার ঘটানো যায়। মূল্যবোধের মৌলিক পরিবর্তন আনার এটাই সবচেয়ে সহজ উপায়।’
(প্রতিবেদন তৈরি: অর্ণব সান্যাল)