রাজনৈতিক পরিচিতি বিচার থেকে দায়মুক্তি দিতে পারে না

বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ফাইল ছবি
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ফাইল ছবি
>

• জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ
• পূর্ণাঙ্গ রায়টি সোমবার সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়
• গত বছরের ৩০ অক্টোবর এই মামলার রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট
• রায়ে খালেদা জিয়ার সাজা বাড়িয়ে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেন হাইকোর্ট

কোনো ব্যক্তির রাজনৈতিক পরিচিতি থাকলেও তিনি যদি অপরাধ করে থাকেন তাহলে বিচার থেকে দায়মুক্তি পেতে পারেন না। অভিযুক্ত ব্যক্তির সামাজিক বা রাজনৈতিক অবস্থান বিবেচনায় নিয়ে ক্ষমাশীল দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দণ্ড দেওয়ার কোনো অবকাশ নেই।

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায়ে এই পর্যবেক্ষণ এসেছে। গত বছরের ৩০ অক্টোবর এই মামলায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাজা বাড়িয়ে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেন হাইকোর্ট। তবে ১৭৭ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি গতকাল সোমবার সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।

রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, বর্তমানে দুর্নীতি দেশে সুশাসনের ধারণার জন্য বড় হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এটি গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি, সামাজিক ন্যায়বিচার ও আইনের শাসনের জন্য হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। দুর্নীতি মানবাধিকারকে অবমূল্যায়ন করে, উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। এটি বিচার, স্বাধীনতা, সমতা, ভাতৃত্বকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এ ক্ষেত্রে আদালতের দায়িত্ব দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইকে জোরদার করা।

এই মামলায় গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি বিচারিক আদালতের দেওয়া রায়ে খালেদা জিয়ার পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল। এর বিরুদ্ধে খালেদা জিয়া হাইকোর্টে আপিল করেন। আর তাঁর সাজা বৃদ্ধি চেয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন একটি আবেদন করে। এ ওপর গত বছরের ৩০ অক্টোবর রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ওই রায় দেন। পূর্ণাঙ্গ রায়টি লিখেছেন বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম।

দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত হয়ে গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে খালেদা জিয়া নাজিমুদ্দিন রোডের পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি, হত্যা, নাশকতা, রাষ্ট্রদ্রোহ, মানহানি, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিসহ ৩০টির বেশি মামলা রয়েছে বলে তাঁর আইনজীবীরা জানান। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা ছাড়াও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় বিচারিক আদালতে খালেদা জিয়ার সাত বছরের কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা জরিমানা হয়েছে। 

যে কারণে দণ্ড বাড়ল
রায়ে বলা হয়, খালেদা জিয়াকে দণ্ড দেওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ জজ আদালতের বিচারক তাঁর বয়স, সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থান এবং তছরূপ হওয়া অর্থের পরিমাণ বিবেচনায় নিয়েছেন। মূল অভিযুক্ত খালেদা জিয়ার সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থান বিবেচনায় অন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিদের তুলনায় তাঁকে কম দণ্ড দেওয়ার আইনি যৌক্তিকতা খুঁজে পাননি উচ্চ আদালত।

রায়ের সিদ্ধান্তে বলা হয়, খালেদা জিয়াকে সর্বোচ্চ সাজা (দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারায় বর্ণিত) দেওয়া হলে সঠিক বিচার প্রতিষ্ঠা হবে, যার ফলে রাষ্ট্রের কোনো অঙ্গ বা সরকারি কার্যালয়ের সর্বোচ্চ পদে দায়িত্বরত ব্যক্তিরা ভবিষ্যতে এ ধরনের অপরাধ করার আগে দুইবার ভাববেন। দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা অর্থদণ্ডসহ ১০ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। এই মামলায় বিচারক অন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিদের যথাযথভাবে অর্থদণ্ডসহ ১০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন। উচ্চ আদালতের বিবেচনায় একই দণ্ড খালেদা জিয়াকে দেওয়া হলে তা হবে আইনসিদ্ধ, যথাযথ ও ন্যায়সংগত।

পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর খালেদা জিয়ার অন্যতম আইনজীবী জয়নুল আবেদীন প্রথম আলোকে বলেন, রায়ের প্রত্যায়িত অনুলিপির জন্য আবেদন করেছেন তাঁরা। প্রত্যায়িত অনুলিপি পেয়ে তা পর্যালোচনা করে নিয়মিত লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করা হবে।

খালেদা জিয়ার জ্ঞাতসারেই ট্রাস্ট
রায়ে বলা হয়, খালেদা জিয়ার দুই ছেলে ও এক নিকটাত্মীয় তাঁর জ্ঞাতসারেই ওই ট্রাস্ট গঠন করেন। এটা বিশ্বাসযোগ্য নয় যে, খালেদা জিয়ার অজ্ঞাতে ও তাঁর অনুমোদন না নিয়ে অন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিদের অ্যাকাউন্টে তহবিল স্থানান্তর করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে ওই মামলাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলার তকমা দেওয়ার এবং তাঁর দোষ স্খলনের চেষ্টা করা হয়েছে। 

ভুয়া ট্রাস্ট গঠন
রায়ে বলা হয়, এতিম কল্যাণ তহবিলের অর্থের নিরাপত্তা এবং যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করার দায়দায়িত্ব খালেদা জিয়ার ছিল। কিন্তু সরকারের সর্বোচ্চ দপ্তরে থাকা অবস্থায় তিনি তাঁর ছেলে, আত্মীয় ও দলীয় লোকজনকে ভুয়া ট্রাস্ট গঠনের মাধ্যমে ওই তহবিলের অপব্যবহারের সুযোগ করে দিয়েছেন। দেশের প্রধানমন্ত্রীর আসনে থেকে তিনি তখন ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। এটি রাষ্ট্রযন্ত্রের মর্যাদার ওপর নিষ্ঠুর আঘাত। এর মাধ্যমে বিশ্বের কাছে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। 

মামলার পূর্বাপর
এতিমদের সহায়তা করার উদ্দেশ্যে বিদেশ থেকে পাঠানো ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করার অভিযোগে খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই দুদক মামলা করে। এই মামলায় গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫ রায় দেন। রায়ে খালেদা জিয়া ছাড়াও তাঁর বড় ছেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক সাংসদ কাজী সালিমুল হক কামাল, সাবেক মুখ্য সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ ও খালেদা জিয়ার আত্মীয় মোমিনুর রহমানকে ১০ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ছয় আসামির মধ্যে পলাতক তারেক রহমানসহ অপর তিনজন আপিল করেননি।

আরও পড়ুন: