রায় শোনানো হলো দণ্ডিতদের
ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন খারিজ করে আপিল বিভাগের দেওয়া পূর্ণাঙ্গ রায় গতকাল বৃহস্পতিবার রাতেই সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদকে পড়ে শোনানো হয়েছে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষ এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
তবে দণ্ডপ্রাপ্তরা রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করার আগ্রহ ব্যক্ত করেছেন কি না, সে বিষয়ে কিছু জানাতে রাজি হয়নি কারা কর্তৃপক্ষ। নিয়মানুযায়ী, রায় পড়ে শোনানোর পরই দণ্ডিত ব্যক্তির কাছে তা জানতে চাওয়া হয়।
গতকাল রাত নয়টার দিকে রায়ের অনুলিপি কারা কর্তৃপক্ষের হাতে হস্তান্তর করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কর্মকর্তারা। কারা প্রশাসনের ডিআইজি গোলাম হায়দার প্রথম আলোকে জানান, ‘রায় হাতে পেয়ে তা দণ্ডিতদের পড়ে শোনানো হয়েছে। এ সময় নিয়মানুযায়ী দুই আসামি প্রাণভিক্ষা চাইবেন কি না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে।’ তবে জবাবে তাঁরা কী বলেছেন, তা প্রকাশ করতে রাজি হননি এই কর্মকর্তা।
এর আগে গতকাল সকালে দুই বন্দীর পরিবারের সদস্যরা কারাগারে গিয়ে তাঁদের সঙ্গে দেখা করেন। তাঁরা প্রাণভিক্ষা চাইবেন কি না—এ বিষয়ে পরিবারের সদস্যরাও সুনির্দিষ্ট করে কিছু গণমাধ্যমকে জানাননি। প্রসঙ্গত, জামায়াতের দুই নেতা আবদুল কাদের মোল্লা ও মোহাম্মদ কামারুজ্জামান ফাঁসির রায় কার্যকরের আগে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমার আবেদন করেননি।
মানবতাবিরোধী অপরাধী জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার রিভিউ আবেদন যেদিন (২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর) খারিজ হয়েছিল, সেদিনই তাঁর ফাঁসি কার্যকর হয়। দলটির আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করা হয় রিভিউ আবেদন খারিজ হওয়ার পাঁচ দিনের মাথায়, চলতি বছরের ১১ এপ্রিল।
গতকাল রাত ১০টায় এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদের ফাঁসির রায় কার্যকর করার জন্য কোনো উদ্যোগের তথ্য জানা যায়নি।
কারাগার সূত্র জানিয়েছে, সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদ—দুজনকেই পাশাপাশি দুটি কনডেমড (রজনীগন্ধা) সেলে রাখা হয়েছে। ওই সেলের অন্য সব বন্দীকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
আদালতের চিত্র: গতকাল সকালে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের চার সদস্যের বেঞ্চে দিনের কার্যক্রম শুরু হলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদের সংক্ষিপ্ত আদেশের বিষয়টি আদালতের নজরে আনেন। তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, সংক্ষিপ্ত আদেশ নয়, শিগগির পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হবে। বেঞ্চের অপর বিচারপতিরা হলেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। এই বেঞ্চই গত বুধবার সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদের দুটি রিভিউ আবেদন খারিজ করে আদেশ দেন।
সর্বোচ্চ আদালত সূত্রে জানা যায়, গতকাল বিকেল পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ রায় লেখার কাজ চলে। বিকেল ৫টা ৫০ মিনিটের দিকে সাকা চৌধুরীর পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপি আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জমা দেওয়া হয়। সন্ধ্যা ৬টা ৩৫ মিনিটে মুজাহিদের পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপি ওই একই দপ্তরে জমা পড়ে। এরপর দুটি রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারের দপ্তর হয়ে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে পৌঁছায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রারের দপ্তরে। এক ঘণ্টা পর রায়ের অনুলিপি নিয়ে নাজিম উদ্দিন রোডে কেন্দ্রীয় কারাগারের উদ্দেশ্য রওনা হন ট্রাইব্যুনালের কর্মকর্তারা। রাত নয়টায় তা কারা কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
সাকা চৌধুরীর রিভিউ খারিজের রায় লিখেছেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। ১৩ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ে একমত হয়েছেন বেঞ্চের অপর তিন বিচারপতি। আর মুজাহিদের রিভিউ খারিজের রায় লিখেছেন বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। ২৯ পৃষ্ঠার এই পূর্ণাঙ্গ রায়ে একমত হয়েছেন বেঞ্চের অন্য সদস্যরা।
সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘রায়ের অনুলিপি রাতেই কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। এরপর দণ্ড কীভাবে কার্যকর হবে, তা সরকারের সিদ্ধান্ত।’ প্রাণভিক্ষার আবেদন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ আবেদন আসামিকে নিজ হাতে লিখতে হয়। এখানে আইনজীবীদের কোনো কাজ নেই।
দেখা করলেন পরিবারের সদস্যরা: গতকাল সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদের সঙ্গে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে দেখা করেন তাঁদের পরিবারের সদস্যরা। পরিবারের করা আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কারা কর্তৃপক্ষ তাঁদের সঙ্গে স্বজনদের সাক্ষাতের অনুমতি দেয়।
গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সাকা চৌধুরীর স্ত্রী ফারহাত কাদের চৌধুরী, বড় ছেলে ফজলুল কাদের চৌধুরী, ছোট ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী, মেয়ে ফারজিন কাদের চৌধুরী, ভাই গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামালউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ পরিবারের ২২ জন সদস্য কারাগারে যান। তাঁদের আবেদনে ১৫ জনের নাম থাকায় দেখা করতে আসা (২২ জনের মধ্যে) সাতজনকে সাক্ষাতের সুযোগ দেওয়া হয়নি।
সাক্ষাৎ শেষে বেলা দেড়টার দিকে সাকা চৌধুরীর পরিবারের সদস্যরা কারাগার থেকে বের হন। এ সময় গণমাধ্যমকর্মীরা সাকা চৌধুরীর পরিবারের সদস্যদের মুখোমুখি হলেও তাঁরা কিছু বলতে রাজি হননি। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য, গণমাধ্যমকর্মী ও উৎসুক মানুষের ভিড়, হইচইয়ের মধ্যে তাঁরা দ্রুত গাড়িতে উঠে চলে যান।
কারাগার সূত্র জানায়, সাক্ষাতের সময় সাকা চৌধুরী ছিলেন ভাবলেশহীন। তবে ওই সময় তাঁর পরিবারের এক নারী সদস্য অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। অন্যরা তাঁর শুশ্রূষা করেন।
সাকা চৌধুরী প্রাণভিক্ষার আবেদন করবেন কি না, জানতে চাইলে গতকাল রাতে মুঠোফোনে হুম্মাম কাদের চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ বিষয়ে পরিবারের সঙ্গে তাঁর কোনো কথা হয়নি। বিষয়টি নিয়ে তিনি আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলবেন।’
সাকা চৌধুরীর পরিবার চলে যাওয়ার পর বেলা ১টা ৫০ মিনিটে কারাগারে যান মুজাহিদের পরিবারের সদস্যরা। মুজাহিদের স্ত্রী তামান্না ই জাহান, ছেলে আলী আহমেদ তাজদীদ, আলী আহমেদ তাহকীক ও আলী আহমেদ মাবরুর, মেয়ে তামান্না বিনতে জান্নাতসহ ১২ জন সদস্য কারাগারে যান। তাঁদের মধ্যে কয়েকটি শিশুও ছিল। আধা ঘণ্টা পর তাঁরা বেরিয়ে আসেন।
সাক্ষাৎ শেষে মুজাহিদের মেজো ছেলে আলী আহমেদ মাবরুর সাংবাদিকদের বলেন, ‘এটা নিয়মিত সাক্ষাৎ ছিল। তিনি স্বাভাবিক রয়েছেন। তিনি দৃঢ়ভাবে বলেছেন, তিনি নির্দোষ। রিভিউ সাবমিশনে এটা আরও সুস্পষ্ট হয়েছে যে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি।’ মাবরুর বলেন, ‘এরপরও যদি তাঁকে (মুজাহিদ) ফাঁসি দেওয়া হয়, তবে এটা হবে একজন নিরীহ, নির্দোষ মানুষকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা। রিভিউ আবেদন খারিজের খবর তিনি শুনেছেন। তবে কারা কর্তৃপক্ষ কোনো রায় তাঁকে পড়ে শোনায়নি।’
মুজাহিদ রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবেন কি না, জানতে চাইলে মাবরুর বলেন, ‘এ বিষয়ে তিনি (মুজাহিদ) কিছু বলেননি। তিনি রাষ্ট্রপতিকে দেশের সাংবিধানিক অভিভাবক মনে করেন। সে জন্য আইনজীবীদের সঙ্গে পরামর্শ করে তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে একটি বিষয়ে আবেদন করতে চান। তবে সে বিষয়টি কী, তা তিনি খোলাসা করেননি।’
মুজাহিদের আইনজীবী সাইফুর রহমান রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুক্রবার (আজ) সকালে তাঁর (মুজাহিদ) সঙ্গে দেখা করার জন্য কারা কর্তৃপক্ষের কাছে আমরা আবেদন করেছি। এখনো কারা কর্তৃপক্ষ আমাদের কিছু জানায়নি।’
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে কীভাবে দণ্ড কার্যকর হবে, তা বিস্তারিত বলা আছে জামায়াতের নেতা আবদুল কাদের মোল্লার রিভিউ খারিজের রায়ে। আপিল বিভাগের ওই রায় অনুসারে, আদালতের আদেশ পাওয়ার পর আসামির পরিবারের সদস্যরা তাঁর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাবেন। কারা কর্তৃপক্ষ আসামির কাছে জানতে চাইবে, তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমার আবেদন করবেন কি না। যদি আসামি ক্ষমার আবেদন করতে না চান, তবে কারা কর্তৃপক্ষের দেরি না করে দণ্ড কার্যকর করবে। এ ক্ষেত্রে জেল কোডের ৯৯১ বিধি অনুসারে রায়ের কপি পাওয়ার সাত দিন পরে ও ২১ দিনের মধ্যে দণ্ড কার্যকরের নিয়ম প্রযোজ্য হবে না।