রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে মানব পাচারের ঝুঁকি বেড়েছে

বিআইআইএসএসের সেমিনারে বক্তারা বলেন, আফগানিস্তান, সিরিয়ার মতো যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের নাম মানা যায় না।

  • পাচারের শিকার ভুক্তভোগীদের ৪৬% নারী।

  • ৫০% যৌন নির্যাতনের শিকার।

  • ভূমধ্যসাগর দিয়ে অবৈধভাবে ইউরোপে পাড়ি দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশিদের অবস্থান এখন তৃতীয়।

মানব পাচার

করোনাভাইরাস, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ বিশ্বজুড়ে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মানব পাচারের ঝুঁকি বাড়ছে। এর সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে চলমান অস্থিরতার কারণে বাংলাদেশ থেকে পাচার বাড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে পাচারকারীরা। বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া ৫১ শতাংশ মানুষ পাচারের ফাঁদে পা দিচ্ছেন জীবিকার প্রয়োজনে।

জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধবিষয়ক সংস্থা (ইউএনওডিসি) প্রকাশিত ২০২০ সালের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য জানিয়েছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস)। গতকাল বুধবার রাজধানীতে সংস্থাটির কার্যালয়ে আয়োজিত এক সেমিনারে উপস্থাপন করা নিবন্ধে বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরা হয়। মানব পাচার ও অভিবাসনের নামে পাচার প্রতিরোধে সমন্বিত সহযোগিতায় গুরুত্বারোপ শিরোনামে এ সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।

বিদেশে কাজের খোঁজে যেতে কঠোর নিয়ম, অর্থনৈতিক চাপ, শ্রমবাজারে নানা অসংগতি ও যৌন পর্যটন বাড়তে থাকায় অভিবাসনের নামে মানব পাচার বাড়ছে বলে নিবন্ধে জানিয়েছে বিআইআইএসএস। আর মানব পাচারের ভুক্তভোগীদের ক্ষেত্রে বলা হয়, পাচারকারীদের নজরের শীর্ষে থাকেন জীবিকার তাগিদ থাকা মানুষ। এরপর তাদের শিকার হয় ভঙ্গুর পরিবার, যাঁদের অভিভাবক নেই তাঁরা। ২৯ শতাংশ ভুক্তভোগী এমন পরিবারের। আর পাচারকারীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ও নানা কারণে পাচারের শিকার হন বাকিরা।

‘মানব পাচার এবং অভিবাসনের নামে পাচার; বৈশ্বিক ও বাংলাদেশ পরিপ্রেক্ষিত’ শিরোনামে উপস্থাপিত এই নিবন্ধে বলা হয়, ভুক্তভোগীদের ৫০ শতাংশ যৌন নির্যাতনের শিকার হন। আর ৩৮ শতাংশ জোরপূর্বক শ্রমের শিকার হন। ৬ শতাংশ বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে এবং দেড় শতাংশ ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়েন। এতে আরও বলা হয়, অভিবাসনের নামে পাচার হওয়া অধিকাংশই পুরুষ। তবে মানব পাচরের শিকার ভুক্তভোগীদের ৪৬ শতাংশ নারী। আর ১৯ শতাংশ মেয়েশিশু ও ১৫ শতাংশ ছেলেশিশু।

ঢাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি সেমিনারে বলেন, মানব পাচার প্রতিরোধে বেশ কিছু উদ্যাগ নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। দোষী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা এবং অন্য দেশগুলোর সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে তারা কাজ করছে। বাংলাদেশের উন্নতির বিষয়টি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ২০২১ সালে প্রকাশিত মানব পাচারবিষয়ক প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে।

সেমিনারে বক্তারা বলেন, জলবায়ু পরির্তনের কারণে বিশ্বজুড়ে মানব পাচারের ঝুঁকি বাড়তে থাকে। এর সঙ্গে করোনা মাহামারি যুক্ত হয়ে মানুষের অসহায়ত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। সর্বশেষ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক আরও কিছু সংকট যুক্ত হয়েছে। প্রতিবেশী মিয়ানমারে রোহিঙ্গা সংকট আগে থেকেই চলছিল, নতুন করে সেখানে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণের মধ্য দিয়ে তৈরি হয়েছে নতুন অনিশ্চয়তা। আফগানিস্তানে সরকার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক সংকট থেকে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয়েছে। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে সব দেশের সহযোগিতার সম্পর্ক ছাড়া মানব পাচার প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়।

সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন বিআইআইএসএসের চেয়ারম্যান কাজী ইমতিয়াজ হোসেন। স্বাগত বক্তব্য দেন সংস্থাটির মহাপরিচালক মোহাম্মদ মাকসুদুর রহমান। আর সংস্থাটির গবেষক বেনুকা ফেরদৌসী নিবন্ধ উপস্থাপন করেন। এ ছাড়া বিভিন্ন দিক নিয়ে আরও তিনটি নিবন্ধ উপস্থাপন করা হয় সেমিনারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক মো. ওবায়দুল হক, জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) অভিবাসন ও সুরক্ষা বিভাগের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক ইউজিন পার্ক ও অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর এসব নিবন্ধ আলাদাভাবে উপস্থাপন করেন। সেমিনারে নিবন্ধ উপস্থাপন ও অংশীজনদের মুক্ত আলোচনার পর্বটি সঞ্চালনা করেন অভিবাসন খাতের বেসরকারি গবেষণা সংস্থা রামরুর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার তাসনিম সিদ্দিকী।

এসব নিবন্ধে বলা হয়, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পররিকল্পনায় পাচার প্রতিরোধের বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়েছে সরকার। পাচারসংশ্লিষ্ট দুই দেশের মধ্যে সমান গুরুত্ব দিয়ে সহযোগিতা তৈরি করতে হবে। ২০১২ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত ৭১ হাজার ভুক্তভোগীর ওপর চালানো জরিপের ভিত্তিতে আইওএম বলেছে, পাচারের শিকার হওয়া মানুষের মধ্যে ৭১ শতাংশ নারী ও মেয়েশিশু। সমন্বিতভাবে পাচার প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রটোকলে দেশগুলোর স্বাক্ষর করা এবং প্রতিশ্রুতির বাধ্যবাধকতার বিষয়গুলো তুলে ধরা হয় এসব নিবন্ধে।

মুক্ত আলোচনায় বক্তারা বলেন, ভূমধ্যসাগর দিয়ে অবৈধভাবে ইউরোপে পাড়ি দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশিদের অবস্থান এখন তৃতীয়। আফগানিস্তান, সিরিয়ার মতো যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের নাম মানা যায় না। এর কারণ খুঁজে বের করা দরকার। অভিবাসনের নামে দেশ থেকে কর্মীরা পাচার হয়ে যাচ্ছেন। শ্রমিক পাচার মানব পাচারের মতোই অপরাধ। কিন্তু মানব পাচার নিয়ে আইন থাকলেও শ্রমিক পাচার নিয়ে বাংলাদেশে কোনো আইন নেই।