আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের (আইএমও) চূড়ান্ত প্রতিযোগিতা এবার হওয়ার কথা ছিল রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরে। কিন্তু করোনার সংক্রমণ এই আয়োজনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাই বলে প্রতিযোগিতা থেমে থাকেনি। সিদ্ধান্ত হয়, অংশগ্রহণকারী দেশগুলো নিজ নিজ দেশেই পরীক্ষার আয়োজন করবে। আর রাশিয়া থেকে অনলাইনে পরীক্ষা গ্রহণ পর্যবেক্ষণ করা হবে। অনেক ভেবেচিন্তে আইএমও কর্তৃপক্ষ শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য পরীক্ষাকেন্দ্র হিসেবে নির্বাচন করে প্রথম আলো কার্যালয়ের প্রশিক্ষণকক্ষকে।
এর আগে ২০ সেপ্টেম্বর অনলাইনে আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। আর গতকাল দুপুরে হয়ে গেল প্রথম দিনের পরীক্ষা। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ের প্রশিক্ষণকক্ষে এ জন্য সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ছয়টি চেয়ার-টেবিলের ব্যবস্থা করা হয়। বেলা একটা নাগাদ হাজির হন ঢাকার আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের শিক্ষক কেন এডলার। তাঁকে বাংলাদেশের জন্য পরিদর্শক (কমিশনার) নির্বাচন করেছে আইএমও।
পরীক্ষাকেন্দ্রের সব সুবিধা ঠিক আছে কি না, তা শুরুতেই ভালোভাবে যাচাই করে নেন কেন এডলার।
এরপর চালু হয় ওয়েব ক্যামেরা। রাশিয়া থেকে এই ওয়েব ক্যামেরা দিয়ে পরীক্ষা পর্যবেক্ষণ করা হয়। ক্যামেরা সংযোগ সচল হওয়ার পর হাজির হন বাংলাদেশের ছয় প্রতিযোগী। ঠিক বেলা দুইটায় শুরু হয় ৬১তম আইএমওর প্রথম দিনের সাড়ে চার ঘণ্টার পরীক্ষা। আর এভাবে বিশ্বের ১০০টির বেশি দেশে হয়ে গেল এবারের আইএমওর প্রথম দিনের পরীক্ষা। জ্যামিতি, অসমতা ও কম্বিনেটরিক্সের তিনটি সমস্যার সমাধান করেছেন প্রাক্বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা।
বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের গাণিতিক মেধার উত্কর্ষ বৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে (আইএমও) বাংলাদেশের প্রতিনিধি পাঠানোর উদ্দেশ্য নিয়ে জাতীয় অধ্যাপক (সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন) জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে ২০০৩ সালে গঠিত হয় বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি। ২০০৪ সালে পৃষ্ঠপোষক হিসেবে এই আয়োজনে যুক্ত হয় ডাচ্-বাংলা ব্যাংক লিমিটেড। আর গণিত অলিম্পিয়াডের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নেয় প্রথম আলো। এই দুই প্রতিষ্ঠান মিলে ২০০৪ সাল থেকেই শুরু করে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক-প্রথম আলো গণিত উত্সব।
প্রাক্বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণিতের এই মেধার লড়াইয়ে ২০০৫ সাল থেকে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা অংশ নিচ্ছে। এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে (আইএমও) বাংলাদেশ ১টি স্বর্ণ, ৬টি রৌপ্যপদক, ২৩টি ব্রোঞ্জপদক ও ৩১টি সম্মানজনক স্বীকৃতি লাভ করেছে। ২০১৮ সালে দেশের পক্ষে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট ইংলিশ স্কুলের শিক্ষার্থী আহমেদ জাওয়াদ চৌধুরী দেশের জন্য প্রথম স্বর্ণপদক জয় করেন।
এই আয়োজনের মাধ্যমে দেশে মেধাভিত্তিক আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা আয়োজনের সক্ষমতা বাড়ছে বলে জানান বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ। এই শিক্ষাবিদ বলেন, গণিত অলিম্পিয়াড শিক্ষার্থীদের মেধা ও সক্ষমতা আন্তর্জাতিক পরিসরে তুলে ধরছে। একই সঙ্গে এই আয়োজনে অংশ নেওয়ার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মেধা বিকাশে আগ্রহ তৈরি হচ্ছে।
এই করোনাকালেও শিক্ষার্থীদের আন্তর্জাতিক অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ দেশের মানুষকে অনুপ্রাণিত ও আশাবাদী করে তুলবে বলে মনে করেন ডাচ্-বাংলা ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম মো. শিরিন। তিনি অংশগ্রহণকারীদের শুভকামনা জানান এবং আশা করেন, তাদের ফল আগের চেয়ে ভালো হবে।
আইএমওতে এবার ষোড়শবারের মতো অংশ নিচ্ছে বাংলাদেশ গণিত দল। ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের পৃষ্ঠপোষকতায় ও প্রথম আলোর সার্বিক ব্যবস্থাপনায় দেশব্যাপী অনলাইন গণিত অলিম্পিয়াড আয়োজনের মাধ্যমে ছয় সদস্যের বাংলাদেশ গণিত দল নির্বাচন করা হয়।
গণিতভীতি কমিয়ে সারা দেশের শিক্ষার্থীদের উৎকর্ষ বাড়াতে কয়েক বছর ধরে দেশের সব জেলায় গণিত উৎসবের আয়োজন হচ্ছে। এর ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে গণিতের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে বলে মনে করেন শিক্ষাবিদেরা। গণিত উৎসব ও আইএমওতে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ এরই মধ্যে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিজেদের মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন। বিশ্বখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, এমআইটি, কেমব্রিজ, ওয়াটারলু, স্ট্যানফোর্ড, ক্যালটেকসহ বিশ্বমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে গণিত উৎসবে মেধার স্বাক্ষর রাখা শিক্ষার্থীরা। গণিত অলিম্পিয়াডে যেভাবে শিক্ষার্থীদের গণিতের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়, সেটি সরকারও এখন গ্রহণ করেছে। দেশের ৬৫ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১ লাখ ৩০ হাজার শিক্ষককে সরকারিভাবে গণিত অলিম্পিয়াডে শেখানো কৌশল সম্পর্কে জানানো (প্রশিক্ষণ) হচ্ছে।
আইএমওতে এবার বাংলাদেশ গণিত দলের সদস্য হিসেবে অংশ নিচ্ছে আদনান সাদিক (কুষ্টিয়া জিলা স্কুল), রাইয়্যান জামিল (নটর ডেম কলেজ, ঢাকা), মো. মারুফ হাসান রুবাব (আনন্দ মোহন কলেজ, ময়মনসিংহ), সৌমিত্র দাস (সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ, ফরিদপুর), এম আহসান-আল-মাহীর (এসওএস হারম্যান মেইনার কলেজ, ঢাকা) ও আহমেদ ইত্তিহাদ হাসিব (ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ)। এবার দলনেতা হিসেবে আছেন বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড দলের কোচ মাহবুব মজুমদার, উপদলনেতা বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসান। এ ছাড়া পর্যবেক্ষক হিসেবে আছেন বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির একাডেমিক কাউন্সিলর মির্জা তানজীম শরীফ, একাডেমিক টিমের সদস্য জয়দীপ সাহা, সাদ বিন কুদ্দুস ও সমন্বয়ক মো. বায়েজিদ ভূঁইয়া।
আইএমওতে এবার ষোড়শবারের মতো অংশ নিচ্ছে বাংলাদেশ গণিত দল। ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের পৃষ্ঠপোষকতায় ও প্রথম আলোর সার্বিক ব্যবস্থাপনায় দেশব্যাপী অনলাইন গণিত অলিম্পিয়াড আয়োজনের মাধ্যমে ছয় সদস্যের বাংলাদেশ গণিত দল নির্বাচন করা হয়। আজ মঙ্গলবার বাংলাদেশ সময় বেলা দুইটায় দ্বিতীয় দিনের পরীক্ষা হবে। বিশ্বজুড়ে অনলাইনে ফলাফল ঘোষণা করা হবে ২৮ সেপ্টেম্বর।