রাস্তায় বের হলে মামলার ভয়, খরচও ওঠে না

আট বছর ধরে সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালিয়ে আসছেন গাইবান্ধার ইউনুস আলী। তবে লকডাউনে আয় কমে গেছে।
ছবি: আসাদুজ্জামান

গাইবান্ধার ৪০ বছর বয়সী ইউনুস আলী আট বছর ধরে ঢাকায় সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালিয়ে সংসার চালাচ্ছেন। থাকেন ডেমরার স্টাফকোয়ার্টার এলাকার একটি মেসে। আর তাঁর স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলে থাকে গ্রামে। প্রতিদিন কাকডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠে হালকা নাশতা সেরে অটোরিকশা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন রাস্তায়। তবে গত বুধবার থেকে কঠোর লকডাউন কার্যকরের পর টানা পাঁচ দিন ঘরে ছিলেন।

ফেসবুক আর পরিচিত সিএনজিওয়ালা বন্ধুদের কাছে খবর পান, রাস্তায় বের হতে হলে লাগবে ‘মুভমেন্ট পাস’। আর রাস্তায় রাস্তায় পুলিশের চেকপোস্ট। রাস্তায় অটোরিকশা পেলেই ধরছে পুলিশ। জরিমানা করছে। পরিচিত মানুষদের কাছ থেকে এমন খবর পেয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন ইউনুস আলী। গাড়ি নিয়ে রাস্তায় বের হবেন, না ঘরে বসে থাকবেন, আবার বসে থাকলে টাকাই বা আসবে কোথা থেকে। বসে থেকে থেকে জমানো টাকাও ফুরিয়ে আসছে। তাই বাধ্য হয়ে মঙ্গলবার ভোরবেলা গ্যারেজ থেকে অটোরিকশা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন ইউনুস।

প্রথম আসেন যাত্রাবাড়ী মোড়ে। দেখতে পান, পুলিশ অটোরিকশা আটকাচ্ছে। তখন ইউনুস বিকল্প রাস্তা দিয়ে চলে আসেন সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে। দুই ঘণ্টা অপেক্ষার পর একটি ভাড়া পান। আয় হয় মাত্র ২০০ টাকা। এরপর বেলা দুইটা পর্যন্ত আর কোনো যাত্রীর দেখা পাননি তিনি। অথচ ইউনুসকে সিএনজির মালিককে দিনশেষে হাতে তুলে দিতে হবে কমপক্ষে ৭০০ টাকা। গাড়িতে গ্যাস ভরেছেন ২০০ টাকার।

সেলিম অটোরিকশা নিয়ে মঙ্গলবার ভোরবেলা বাসা থেকে বের হন। সকাল নয়টার দিকে দুজন যাত্রী নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসেন। এরপর থেকে তিনি বসা। পরে দুপুর ১২টার দিকে শাহবাগ মোড়ে আসেন। বেলা তিনটার সময়ও তিনি কোনো যাত্রী পাননি।

আয় না থাকায় হতাশ চালক ইউনুস প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন কঠিন লকডাউন। গাড়ি বের করলেই মামলা। ছয় দিন পর রাস্তায় বাইর হইছি। রোডেঘাটের পরিস্থিতি ভালো না। যেখানেই যায় সেখানেই পুলিশের টহল। রাস্তায় ব্যারিকেড। এহন গাড়ি না চালাইলে আমরা খামু কী?’

কঠোর লকডাউনের প্রথম চার দিন ঢাকার ফাঁকা রাস্তায় হাতে গোনা কিছু অটোরিকশা চলাচল করেছে। তবে দুই দিন ধরে রাস্তায় অটোরিকশার পরিমাণ কিছুটা বেড়েছে। অনেকে আবার জরিমানার মুখোমুখি হয়েছেন। বেশির ভাগ সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক বেকার ঘরে বসে আছেন। লকডাউন আরও সাত দিন বাড়ার খবর এসেছে। এই খবরে তাঁদের উদ্বেগ আরও বেড়েছে। এভাবে আয়শূন্য হয়ে দিনের পর দিন ঘরে বসে থেকে সংসার খরচ কীভাবে জোগাড় করবেন—এটাই এখন বড় প্রশ্ন তাঁদের কাছে।

রাস্তায় বের হতে ভয়, আয়ও কম

চল্লিশ বছর ধরে ঢাকায় সিএনজি চালিয়ে সংসার চালিয়ে আসছেন ৭০ বছর বয়সী পটুয়াখালীর মোহাম্মদ সেলিম। তাঁর দুই ছেলে, দুই মেয়ে। স্ত্রী–সন্তানদের নিয়ে খিলগাঁওয়ের ভাড়া বাসায় থাকেন। মাসে ভাড়া দিতে হয় ছয় হাজার টাকা। বড় ছেলে বিয়ে করে আলাদা সংসার পেতেছে। বড় মেয়েরও বিয়ে হয়েছে। ছোট ছেলে ও মেয়ে পড়াশোনা করছে। জরিমানার ভয়ে করোনায় কঠোর লকডাউনে গত কয়েক দিন অটোরিকশা নিয়ে তিনি বের হননি। ঘরেই ছিলেন। এক টাকা আয় না থাকায় সংসার খরচ জোগাতে প্রতিবেশীর কাছ থেকে ধার করতে হয়েছে। তাই বাধ্য হয়ে আতঙ্কের মধ্যেও বৃদ্ধ সেলিম অটোরিকশা নিয়ে মঙ্গলবার ভোরবেলা বাসা থেকে বের হন। সকাল নয়টার দিকে দুজন যাত্রী নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসেন। এরপর থেকে তিনি বসা। পরে দুপুর ১২টার দিকে শাহবাগ মোড়ে আসেন। বেলা তিনটার সময়ও তিনি কোনো যাত্রী পাননি।

লকডাউনের মধ্যেও অটোরিকশা নিয়ে বের হন মো. সেলিম।
ছবি: আসাদুজ্জামান

বৃদ্ধ সেলিম বললেন, ‘অটোরিকশা নিয়ে বের হলে একজন সিএনজিওয়ালার খরচ আছে কমপক্ষে ১ হাজার ৪০০ টাকা। এখন লকডাউন। ছয় দিন ঘরে বসে ছিলাম। এক পয়সা আয় নেই। তাই তো বাধ্য হয়ে গাড়ি নিয়ে রাস্তায় বের হয়েছি। কিন্তু রাস্তায় মানুষজন তেমন নেই। যাত্রীও পাওয়া যাচ্ছে না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় বসে থাকতে হচ্ছে। এর সঙ্গে আছে মামলা–জরিমানা দেওয়ার ভয়।’

বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) হিসাবে, ঢাকা নগরে নিবন্ধিত সিএনজিচালিত অটোরিকশার সংখ্যা ১৩ হাজার। বাস্তবে ঢাকার সড়কে অটোরিকশা চলে আরও অনেক বেশি। করোনার আগে একজন সিএনজিচালককে গাড়ি নিয়ে বের হলে মালিককে দিতে হয় ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকা। গ্যাস ভরার বিল আসে ৩০০ টাকা। সব মিলিয়ে একজন অটোরিকশাচালকের খরচ আছে দৈনিক ১২০০–১৩০০ টাকা।

করোনার আগে সব খরচ দেওয়ার পরও একেকজন সিএনজিচালক গড়ে প্রতি মাসে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা আয় করতেন। তবে গত বছরের টানা ৬৬ দিন সরকারি ছুটির পর থেকে তাঁদের আয় কমে গেছে। আবার লকডাউন শুরুর পর সব মিলিয়ে গড়ে প্রতিদিন তাঁদের আয় হচ্ছে ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা। মালিককে দেওয়ার পর অল্প কিছু টাকা নিয়ে ঘরে যেতে পারছেন একজন সিএনজিচালক।

অটোরিকশাচালক সালাহউদ্দিন।
ছবি: আসাদুজ্জামান

শরীয়তপুরের সিএনজিচালক সালাহউদ্দিন বলেন, ‘গাড়ি নিয়ে ভোরবেলা বের হই, ফিরি রাত ১০টায়। যা আয় হয়, তার বেশির ভাগ দিতে হয় মালিককে। এখন চলছে লকডাউন। আয় নেই। আমরা বিপদে আছি। কী করব, কীভাবে সংসার চালাব, তা নিয়ে বেশ চিন্তিত আমি।’