রায় ঠিকভাবে কার্যকর হচ্ছে না, এটা দুঃখজনক: প্রধান বিচারপতি

প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। ফাইল ছবি

প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেছেন, ‘সংবিধানের ১১২ অনুচ্ছেদে আছে, দেশের নির্বাহী বিভাগসহ সবাই সুপ্রিম কোর্টের এইডে (সহায়তা) কাজ করবে। যেখানে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা আছে কাজ করার জন্য, সেখানে কেন আবার আমাদের আদালত অবমাননার রুল ইস্যু করতে হবে? রাষ্ট্রের সবার দায়িত্ব হলো সুপ্রিম কোর্টের রায় কার্যকর করা।’

সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতির লেখা দুটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন উপলক্ষে ভার্চ্যুয়াল এক অনুষ্ঠানে শনিবার প্রধান বিচারপতি এসব কথা বলেন। আপিল বিভাগের বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের লেখা ‘বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ একজন যুদ্ধ শিশুর গল্প ও অন্যান্য’ শিরোনামে এবং হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিমের লেখা ‘বঙ্গবন্ধু: সংবিধান আইন আদালত ও অন্যান্য প্রবন্ধ’ শিরোনামে বইয়ের মোড়ক আজ উন্মোচন করা হয়। বই দুটি প্রকাশ করেছে মাওলা ব্রাদার্স।

অনুষ্ঠানে ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘গত এক দশকে জনস্বার্থে হাইকোর্ট যুগান্তকারী কিছু রায় দিয়েছেন। কিন্তু আমি বিচারকদের কাছে একটি প্রশ্ন রাখতে চাই, আপনারা কখনো কি দেখেছেন রায়গুলো কার্যকর করা হয় কি না? এখানে প্রধান বিচারপতি রয়েছেন, আমি মনে করি জনস্বার্থে দেওয়া রায়গুলো পালিত হচ্ছে কি না, তা রিপোর্টিংয়ের জন্য একজন বিচারপতির নিয়ন্ত্রণে একটি সেল থাকা দরকার।’

এই প্রসঙ্গ টেনে মুনতাসীর মামুনের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন আরও বলেন, ‘আমরা কনটেম্পট (আদালত অবমাননা) করতে পারি। কনটেম্পট করে করে আমরা হয়রান। কারণ কনটেম্পট করেও আমাদের রায় ঠিক যেভাবে কার্যকর হওয়ার কথা, সেভাবে কার্যকর হচ্ছে না—এটি একটি দুঃখের বিষয়।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের যেসব রায় যাচ্ছে, আশা করি নির্বাহী বিভাগের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় প্রতিটি রায় বাস্তবায়িত হবে।’

অনুষ্ঠানে অন্য এক প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেন, ‘বঙ্গভবনে এক অনুষ্ঠানে মালদ্বীপের ফার্স্ট লেডি জানতে চেয়েছিলেন, বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের কি বিচার হয়নি? তখন মালদ্বীপের ফার্স্ট লেডিকে বলেছি, হ্যাঁ, বিচার হয়েছে। সাধারণ আদালতে এদের বিচার হয়েছে। প্রায় সব খুনির ফাঁসি হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, দুই-তিনজন এখনো পলাতক। তাদের বিদেশ থেকে ফেরত আনতে সরকার সর্বাত্মক চেষ্টা করছে।’

প্রধান বিচারপতি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যদি জাগ্রত করতে হয়, তাহলে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের কথা আনতে হবে। জানাতে হবে বাংলাদেশ কোনো খুনিদের দেশ নয়।

বই নিয়ে আলোচনা

অনুষ্ঠানে মোড়ক উন্মোচিত বই দুটির লেখক দুই বিচারপতিকে শুভেচ্ছা জানিয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘এটি আমাদের ভবিষ্যতের জন্য দলিল হিসেবে কাজ করবে। তাঁদের রচিত গ্রন্থ থেকে দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে লেখক হিসেবে তাঁরা যথেষ্ট প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন।’

বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের বইটি পাঠ করলে বাংলাদেশের গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার সম্পর্কে একটি সম্যক ধারণা পাওয়া যাবে বলে উল্লেখ করেন প্রধান বিচারপতি। তিনি বলেন, বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিমের বইয়ে সংবিধানে বিবৃত জাতির জনকের দর্শন, স্বপ্ন, ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনা সুনিপুণভাবে তুলে ধরা হয়েছে। আইন, আদালত ও বিচারব্যবস্থা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর অভিজ্ঞতা ও ভাবনা চমৎকারভাবে তিনি তাঁর লেখায় উপস্থাপন করেছেন।
আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী বলেন, দুজন বিচারপতি লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধের ওপরে, লিখেছেন বঙ্গবন্ধুর কথা। দুজনের লেখা ভিন্ন, তবে সম্পূরক। দুই বিচারপতির বইয়ে যে তথ্যগুলো পাওয়া যায়, তা মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে প্রকৃত তথ্য। তথ্যগুলো বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়।

‘বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ একজন যুদ্ধ শিশুর গল্প ও অন্যান্য’ বইয়ের লেখক বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, বইটিতে ১৪টি নিবন্ধ আছে। এর মধ্যে আইনের শাসন ও বঙ্গবন্ধুর ভাবনা, উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহারে সমস্যা ও সমাধান এবং একজন মুক্তিযোদ্ধার জবানবন্দি আছে।

‘বঙ্গবন্ধু: সংবিধান আইন আদালত ও অন্যান্য প্রবন্ধ’ বইয়ের লেখক বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু দীর্ঘদিন কারাগারে ছিলেন, তিনি অসংখ্য মামলার সম্মুখীন হয়েছেন। আইন-আদালত, বিচারব্যবস্থা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর যে অভিজ্ঞতা, তিনি যেভাবে বলেছেন সেগুলো আমার দৃষ্টিভঙ্গিতে বইয়ে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। বঙ্গবন্ধু নিয়ে আলোচনার বদলে এখন বঙ্গবন্ধু চর্চাটা আমাদের জন্য খুব প্রয়োজন। সেই তাগিদ থেকে বই লেখা।’

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী রোকসানা পারভীনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সাবেক সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক, একাত্তর টিভির প্রধান সম্পাদক মোজাম্মেল বাবু, প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক আনিসুল হক এবং মাওলা ব্রাদার্সের স্বত্বাধিকারী আহমেদ মাহমুদুল হক আলোচনায় অংশ নেন।