রেলে বিপুল ব্যয়, তারপরও অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং

রেল দুর্ঘটনায় যত প্রাণহানি হয়, তার ৮৯ শতাংশই ঘটে অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ে। কখনো বাসের সঙ্গে, কখনো মাইক্রোবাসসহ অন্য যানবাহনের সঙ্গে ট্রেনের সংঘর্ষে এসব প্রাণহানি ঘটে। অথচ এসব ক্রসিং নিরাপদ করার বিষয়টি কর্তৃপক্ষের অগ্রাধিকারে নেই। বর্তমানে রেলে ১ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প চলমান। এর মধ্যে লেভেল ক্রসিং উন্নয়নে প্রকল্প আছে মাত্র ১০০ কোটি টাকার। প্রকল্পটির মেয়াদও শেষ। ক্রসিংয়ে পাহারাদার হিসেবে যাঁদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, তাঁদের অনেকেই চাকরি ছেড়ে চলে যেতে শুরু করেছেন।

রেলের উন্নয়ন প্রকল্প ও দুর্ঘটনার তথ্য বিশ্লেষণ করে এ চিত্র পাওয়া গেছে।

সারা দেশে রেলপথ আছে ২ হাজার ৯৫৫ কিলোমিটার। এই রেলপথের ওপর দিয়ে কোথাও কোথাও সড়ক চলে গেছে। রেল আর সড়কের এই সংযোগস্থলকেই লেভেল ক্রসিং বলা হয়। দেশে কম-বেশি লেভেল ক্রসিং আছে আড়াই হাজার। এগুলোকে বৈধ, অবৈধ, পাহারাদার আছে (ম্যানড), পাহারাদার নেই (আনম্যানড)—এভাবে শ্রেণিবিন্যাস করে রেল কর্তৃপক্ষ। যেসব ক্রসিংয়ে পাহারাদার আছেন, সেগুলোতে লোহার প্রতিবন্ধক থাকে। পাহারাদার ট্রেন আসার সংকেত পেয়ে প্রতিবন্ধক নামিয়ে অন্য যানবাহনের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করেন। ফলে পাহারাদার ভুল না করলে যানবাহনের সঙ্গে ট্রেনের সংঘর্ষ হওয়ার সুযোগ নেই। পাহারাদার ও প্রতিবন্ধক থাকা রেলক্রসিংয়ে তাই দুর্ঘটনাও খুব কম। পাহারাদার নেই এমন ক্রসিং অরক্ষিত। 

গত সোমবার সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় এমনই একটি অরক্ষিত ক্রসিংয়ে রাজশাহী থেকে ঢাকাগামী পদ্মা ট্রেনের সঙ্গে মাইক্রোবাসের সংঘর্ষে বর-কনে, শিশুসহ ১২ জন প্রাণ হারিয়েছে। এ ঘটনার পর স্থানীয় মানুষ ট্রেন আটকে রাখে। বাধ্য হয়ে রেল কর্তৃপক্ষ অরক্ষিত ক্রসিং উন্নয়নের ঘোষণা দেয়।

রেলের হিসাব বলছে, ২০১৪ সাল থেকে এ বছরের জুন পর্যন্ত সারা দেশে মোট ৮৬৮টি দুর্ঘটনা ঘটে। এসব দুর্ঘটনায় ১১১ জন প্রাণ হারিয়েছেন। লেভেল ক্রসিংয়ে ৯৬টি দুর্ঘটনা ঘটে। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৯৯ জন। তাঁদের প্রায় সবাই ক্রসিং পার হতে যাওয়া বাস, মাইক্রোবাস ও ছোট যানবাহনের আরোহী। রেলক্রসিং পারাপারের সময় যেসব পথচারী প্রাণ হারান, সেই হিসাব রেল কর্তৃপক্ষ সংরক্ষণ করে না।

ক্রসিংয়ে সুরক্ষার ব্যবস্থা না থাকার বিষয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোফাজ্জেল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সার্বিক বিষয় নিয়ে বসব। কারিগরি ও আর্থিক দিক বিবেচনা করে দ্রুতই ব্যবস্থা নেব।’ তিনি বলেন, গতকাল বুধবারও জেলা প্রশাসকদের সম্মেলনে অবৈধ লেভেল ক্রসিং যাতে না হয়, সে বিষয়ে দৃষ্টি রাখতে নির্দেশনা দিয়েছেন। সড়ক নির্মাণকারী সংস্থাগুলোকেও চিঠি দেওয়া হয়েছে, আরও দেওয়া হবে।

রেলের উচ্চপর্যায়ের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, রেল কর্তৃপক্ষের মধ্যে এমন একটা ধারণা জন্মেছে যে রেলক্রসিংয়ে যানবাহন চাপা পড়ে প্রাণহানির দায় তাদের নয়। কারণ বেশির ভাগ সংস্থা সড়ক নির্মাণের সময় তাদের অনুমতি নেয়নি। অথচ রেলের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে নির্মাণ করা বৈধ রেলক্রসিংয়ের ৬১.৫৮ শতাংশই অরক্ষিত।

রেলের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, রেলে এ পর্যন্ত যে বিপুল বিনিয়োগ হয়েছে এবং চলমান যে বরাদ্দ আছে, এর ১ শতাংশের কম বিনিয়োগ করলেও রেলপথ নিরাপদ হয়ে যায়। মানুষের চাহিদার প্রয়োজনে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ) ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি), সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদসহ বিভিন্ন সংস্থা সড়ক নির্মাণ করেছে। ফলে রেলপথ সুরক্ষার লক্ষ্যে এই খাতে বিনিয়োগ হতেই পারে। কিন্তু রেলের কর্মকর্তাদের এসব প্রকল্পের দিকে মনোযোগ নেই। 

>প্রাণহানির ৮৯% ক্রসিংয়ে
রেলে ১ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প চলমান
লেভেল ক্রসিংয়ের জন্য ১০০ কোটি
অবৈধ বলে অন্য সংস্থার ওপর দায় চাপানো হয়


বর্তমানে রেলে ৪৮টি প্রকল্প চলমান আছে। এর মধ্যে রেলক্রসিং পুনর্বাসন ও মানোন্নয়নে প্রকল্পের একটি পূর্বাঞ্চলে, অন্যটি পশ্চিমাঞ্চলের। পূর্বাঞ্চলে ৩২৮টি রেলক্রসিংয়ের মানোন্নয়ন এবং ১ হাজার ৩৮ জন পাহারাদার নিয়োগ দেওয়ার কথা। কিন্তু ৮১৭ জন নিয়োগ হলেও এঁদের একটা বড় অংশই চাকরি ছেড়ে চলে গেছে। কারণ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে জুনে। এখন কর্মীরা বেতন পাচ্ছেন না। এ প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ৪৯ কোটি ৩৩ লাখ টাকা।

অন্যদিকে পশ্চিমাঞ্চলে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪৭ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। এর আওতায় ৩২৬টি ক্রসিংয়ের মান উন্নয়ন ও পাহারা দেওয়ার জন্য ৮৫১ জন লোক নিয়োগ দেওয়ার কথা ছিল। নিয়োগ হয় ৭৬৮ জন। তাঁদের মধ্যে ১৩৯ জন চাকরি ছেড়ে চলে গেছেন। বাকিরা ৩ মাস ধরে বেতন পাচ্ছেন না। প্রকল্প–সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, নতুন করে প্রকল্প না নেওয়া হলে বাস্তবায়ন করা প্রকল্প বৃথা যাবে। 

বৈধ-অবৈধ ঠেলাঠেলিতে জননিরাপত্তা বিঘ্নিত

রেলের হিসাবে, সারা দেশে রেলক্রসিং আছে ২ হাজার ৫৭৪টি। এর মধ্যে অনুমোদিত রেলক্রসিং ১ হাজার ৪৬৮টি। অর্থাৎ ৪৩ শতাংশ ক্রসিং অবৈধ। অনুমোদিত বলতে, সংশ্লিষ্ট সংস্থা রেললাইনের ওপর দিয়ে রাস্তা নির্মাণের সময় রেলের অনুমোদন নিয়েছে। ক্রসিংগুলোতে প্রতিবন্ধক ও অবকাঠামো তৈরি এবং কর্মী নিয়োগের পর ১০ বছরের রক্ষণাবেক্ষণ খরচ দেওয়ার পরই অনুমতি পাওয়া যায়। ফলে অনুমোদিত ক্রসিং সুরক্ষিত রাখা রেলের দায়িত্ব।

রেলের হিসাবে, প্রতিবন্ধক, পাহারাদার এবং ট্রেন চলাচলের খবরাখবর জানা যায় এমন ব্যবস্থা আছে মাত্র ৫৬৪টি ক্রসিংয়ে। অর্থাৎ বৈধ বাকি ৯০৪টি ক্রসিংয়েও কোনো সুরক্ষার ব্যবস্থা নেই। এসব ক্রসিংয়ে সতর্কবার্তা–সংবলিত সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দায় সারছে রেল কর্তৃপক্ষ। সাইনবোর্ডের ভাষা অনেকটা এ রকম, ‘এই গেটে কোনো গেটম্যান নাই, পথচারী ও সকল প্রকার যানবাহনের চালক নিজ দায়িত্বে পারাপার করিবেন এবং যেকোনো দুর্ঘটনার জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকিবেন।’

রেলের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রেলের আইন অনুসারে লাইনের দুই পাশে ১০ ফুট করে মোট ২০ ফুট এলাকায় যেকোনো মানুষ প্রবেশ করলেই তা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। এমনকি ২০ ফুটের মধ্যে কোনো গবাদিপশু প্রবেশ করলেও তা আটকের মাধ্যমে বিক্রি করে রেলওয়ের কোষাগারে জমার নিয়ম রয়েছে। এ জন্যই রেল কর্তৃপক্ষ ক্রসিং নিয়ে খুব একটা পাত্তা দেয় না। 

রেলওয়ে সূত্র জানায়, অবৈধ রেলক্রসিংয়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি এলজিইডি ও ইউনিয়ন পরিষদের রাস্তাই বেশি। এর মধ্যে ৪২৭টি করে অবৈধ ক্রসিং আছে এলজিইডি ও ইউনিয়ন পরিষদের।

লেভেল ক্রসিং বৈধ–অবৈধ ধারণাটি ভুল বলে মনে করেন এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী মো. খলিলুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এ বিষয়ে অনেক আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক হয়েছে। সমাধানে আসা যায়নি। একের পর এক মানুষের প্রাণহানি বেদনাদায়ক। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, টাকা কে খরচ করবে? সবই তো সরকারি টাকা। মানুষের নিরাপত্তাই মূল। কারিগরি কিংবা যৌক্তিকতা—কোনো বিবেচনাতেই লেভেল ক্রসিং এলজিইডি বা অন্য সংস্থার পক্ষে রক্ষণাবেক্ষণ সম্ভব নয়। এটা রেলেরই দায়িত্ব। 

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবন্ধক বা পাহারাদার ছাড়া কোনো লেভেল ক্রসিং রাখার অর্থই হলো, এখানে প্রাণ ঝরবে। এটা জেনেও যদি কেউ সুরক্ষার ব্যবস্থা না নেন, তাহলে তো বলতে হবে, মানুষের মৃত্যুতে তাঁদের মাথাব্যথা নেই। সড়ক ও রেল—দুটিই জনগণের জন্য এবং তাঁদের টাকায় নির্মাণ করা হয়। ফলে সুরক্ষা তাঁদের প্রাপ্য। আর রেল যদি মনে করে, অবৈধ ক্রসিংয়ে বিনিয়োগ করবে না, তাহলে বন্ধ করে দিক। 

অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, কম খরচেই লেভেল ক্রসিংয়ের সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব। কিন্তু সরকারের দপ্তরগুলো বিপুল ব্যয় আর অবকাঠামোর প্রকল্পে বেশি জোর দেয়।