রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মধ্যস্থতা চালিয়ে যেতে চায় চীন, আছে সংশয়

ফেরার অপেক্ষায় রোহিঙ্গারা।  প্রথম আলো
ফেরার অপেক্ষায় রোহিঙ্গারা। প্রথম আলো

রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে তাদের আস্থার সংকটই প্রধান বাধা। তাই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারকে কিছু বিষয়ে ছাড় দিতে চীন, আসিয়ানের মতো পক্ষগুলোকে অনুরোধ করছে বাংলাদেশ। তবে মিয়ানমারের প্রতি চীনের পক্ষপাত থাকায় শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের এই চেষ্টা কতটা সফল হবে, তা নিয়ে সংশয় আছে।

ঢাকা, নিউইয়র্ক, ইয়াঙ্গুন ও বেইজিংয়ে কর্মরত বাংলাদেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে কথা বলে এ ধারণা পাওয়া গেছে। তাঁরা জানিয়েছেন, রাখাইনের নিরাপত্তা, নাগরিক অধিকারসহ মৌলিক সুবিধা না দিলে রোহিঙ্গাদের যে রাখাইনে পাঠানো যাবে না, এ বিষয়ে চীন নিশ্চিত হয়েছে। তাই এ বিষয়গুলোর সমাধানে কীভাবে কাজ করা যায়, তা নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে চীন।

কূটনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের মতে, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে গিয়ে ২০১৭ সালের নৃশংসতার ঘটনায় জবাবদিহির প্রশ্নে ছাড় দিয়ে কোনো সুফল আসবে না। কারণ, এখন পর্যন্ত মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ কমাতেই চীন সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আর আন্তর্জাতিক চাপ না থাকলে চীন এতটা সক্রিয় হতো না। তাই আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত আর আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে বিচারপ্রক্রিয়ায় সমর্থনের ধারায় বাংলাদেশকে যুক্ত থাকতে হবে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, রোহিঙ্গা সংকটের শুরু থেকেই চীন রাখাইনে রোহিঙ্গা নিধনের বিচারের বিরোধিতা করে আসছে। এবার প্রত্যাবাসনে সরাসরি মধ্যস্থতার সময় চীন বিষয়টিতে জোর দিয়েছে। ফলে আইসিসির তদন্তের জন্য বাংলাদেশে দপ্তর খোলাসহ প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো নিয়ে চুক্তি সইয়ের প্রক্রিয়ায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সময় নিচ্ছিল। ২২ আগস্ট পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় কমিটির বৈঠকে আইসিসির প্রসঙ্গটি আলোচনায় আসে। আলোচনায় একাধিক সাংসদ বলেন, মিয়ানমারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখার অন্যতম পদক্ষেপ হচ্ছে আইসিসির তদন্ত। এ ধরনের চাপ সরে গেলে মিয়ানমার কিছুই করবে না। তাই প্রত্যাবাসনের কথা ভেবে আন্তর্জাতিক তদন্ত বা জবাবদিহির পদক্ষেপে ছাড় দেওয়া যাবে না। সংসদীয় কমিটির ওই বৈঠকের পর গত কয়েক দিনে আইসিসির সঙ্গে চুক্তির প্রস্তুতি জোরদার হয়েছে।

মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে শুরু থেকেই যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও জাতিসংঘ বাংলাদেশের পাশে আছে। তবে গত শুক্রবার নিরাপত্তা পরিষদের এক বৈঠকে মার্কিন প্রতিনিধি রাখাইনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জবাবদিহি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়ার ওপর ছেড়ে দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের এই অবস্থান বাংলাদেশকে অবাক করেছে। কারণ, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে রাখাইনে রোহিঙ্গা নিধনের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক তদন্তের কথা বলে আসছে।

এদিকে চীনের মতো ভারতও রোহিঙ্গাদের দ্রুত রাখাইনে পাঠাতে বারবার বলছে বাংলাদেশকে। অথচ এই নিকট প্রতিবেশীর কাছ থেকে শুরু থেকে এখন পর্যন্ত শুধু মানবিক সহায়তাই এসেছে। ইয়াঙ্গুনের কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, গত সোমবারও এক আলোচনায় বাংলাদেশকে দ্রুত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করতে বলেছে ভারত। তাড়াহুড়া করে রোহিঙ্গাদের যে এখনই ফেরত পাঠানো যাবে না, সেটা বাংলাদেশ খুব স্পষ্ট করেই ভারতকে জানিয়েছে।

জানতে চাইলে চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ আহমেদ গত সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, রোহিঙ্গাদের মধ্যে আস্থা ফেরানোর ওপর মূল মনোযোগটা দেওয়া উচিত। কারণ, বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়সহ সবার উপস্থিতি আছে। অথচ মিয়ানমারের রাখাইনে কারও উপস্থিতি নেই। কাজেই চীন, ভারত, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ১০টি দেশের আঞ্চলিক জোট আসিয়ানসহ বিভিন্ন দেশ ও পক্ষকে যুক্ত করে তাদের যথাযথ ক্ষমতা দিয়ে রাখাইনে পাঠানো নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, নাগরিকত্বসহ রোহিঙ্গাদের পাঁচ দফা দাবির সবগুলো একসঙ্গে পূরণ করে তাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে তিনি একমত নন। কেননা, নিরাপত্তা ও নাগরিকত্বের মতো মূল দুটি বিষয়ের সুরাহা হলেই অনেক সমস্যার সমাধান হবে।

>

রোহিঙ্গা প্রশ্নে মিয়ানমারের প্রতি চীনের পক্ষপাত
যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও জাতিসংঘ বাংলাদেশের পাশে
ভারতের কাছ থেকে শুধু মানবিক সহায়তাই এসেছে
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য দীর্ঘ সময় লাগতে পারে

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সরকারের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে প্রত্যাবাসন ও জবাবদিহি পাশাপাশি চলবে। রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতার বিচারের প্রসঙ্গটি এখন আন্তর্জাতিক দাবিতে পরিণত হয়েছে। আন্তর্জাতিক কিছু উদ্যোগ শুরু হয়েছে।

জাতিসংঘের অধিবেশন ঘিরে প্রস্তুতি
ঢাকা ও নিউইয়র্কে কর্মরত কূটনীতিকেরা এই প্রতিবেদককে জানান, সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন সামনে রেখে বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর সহযোগিতায় রোহিঙ্গা প্রসঙ্গটি জোরালোভাবে তুলে ধরার প্রস্তুতি চলছে। এ নিয়ে বিভিন্ন দেশ ও জোট বক্তৃতা দেবে। এ বিষয়ে একাধিক বৈঠক আয়োজনের কথা রয়েছে। এর পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বক্তৃতায় এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু কথা বলবেন।

মার্কিন অবস্থানের পরিবর্তন
যুক্তরাষ্ট্র থেকে কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, গত শুক্রবার নিউইয়র্কে আরিয়া ফর্মুলার (নিরাপত্তা পরিষদে বিষয়ভিত্তিক আলোচনার ফোরাম) বৈঠকে মার্কিন প্রতিনিধি রাখাইনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় জবাবদিহি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়ার ওপর ছেড়ে দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া বলতে তিনি মূলত দেশটির গড়া তদন্ত কমিশন বা কমিটির এ কাজ করা উচিত বলে মনে করেন।

এ নিয়ে জানতে চাইলে নিউইয়র্কে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনে কর্মরত এক কূটনীতিক গত সোমবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, রাখাইনে নৃশংসতার ঘটনায় জবাবদিহির ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের এই অবস্থান বড় ধরনের পরিবর্তন। রোহিঙ্গা সংকটের শুরু থেকেই রোহিঙ্গা নিধনের জবাবদিহি নিশ্চিত করার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র জোর দিয়ে বলছে। আর এই জবাবদিহি জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে হওয়া উচিত বলে যুক্তরাষ্ট্রের মত।

তবে ওয়াশিংটনের কূটনৈতিক সূত্রগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের মূল আপত্তি আইসিসি নিয়ে। কারণ, আইসিসিতে রাখাইনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের তদন্ত শুরু হলে ইরাক ও সিরিয়ায় মার্কিন অভিযানের বিচারের প্রসঙ্গটি সামনে নিয়ে আসবে।

অপেক্ষা দীর্ঘ সময়ের
বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মিয়ানমার সরকারের ব্যাপারে রোহিঙ্গাদের আস্থার সংকট রাতারাতি দূর হওয়ার নয়। প্রত্যাবাসনের জন্য দীর্ঘ সময় লাগতে পারে। কারণ, জোর করে রোহিঙ্গাদের যে রাখাইনে পাঠানো যাবে না, সেটা নিশ্চিত। তাই বাংলাদেশ স্বেচ্ছায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে সব দিক সামাল দিয়ে অগ্রসর হওয়ার পক্ষপাতী।

এ পর্যন্ত তিন দফায় রোহিঙ্গাদের জন্য জাতিসংঘের উদ্যোগে যৌথ সাড়াদান পরিকল্পনার আওতায় (জেআরপি) আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে। একবারও ওই অর্থের পুরোটা আদায় করা যায়নি। রোহিঙ্গাদের সহায়তায় তহবিল সংগ্রহের জন্য আন্তর্জাতিক যে সমর্থন দরকার, তা জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) বছরের পর বছর ধরে রাখতে পারবে কি না, সে প্রশ্নটি এখন সামনে আসছে। শিগগিরই যখন প্রত্যাবাসনের কোনো সম্ভাবনা নেই, এমন এক আবহে আন্তর্জাতিক সমর্থন ছাড়া বাংলাদেশের পক্ষে রোহিঙ্গাদের জন্য বছরে কম করে হলেও আট হাজার কোটি টাকা খরচ করা সম্ভব কি না, সেটিও ভাবার আছে। সব মিলিয়ে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে একটি সময়সাপেক্ষ পরিকল্পনা করা জরুরি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক আমেনা মহসিন প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ প্রত্যাবাসনের জন্য পুরোপুরি তৈরি অথচ মিয়ানমার নানা ছুতা তুলছে। এটি বাংলাদেশকে জোরালোভাবে তুলে ধরতে হবে। রোহিঙ্গারা যে এবার তাদের বক্তব্য জোরালোভাবে তুলে ধরেছে, এটিও ইতিবাচক। তিনি বলেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রবাসী রোহিঙ্গা রয়েছে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন সামনে রেখে তাদের নিউইয়র্কে জড়ো করার উদ্যোগ নেওয়া যায়। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক নাগরিক সমাজকে এ প্রক্রিয়ায় জোরালোভাবে আনতে হবে। এর পাশাপাশি চীন, রাশিয়া, জাপান ও ভারতের মতো দেশগুলোকে আমরা যেভাবে চাইছি, সেভাবে পাচ্ছি না। তাদের কাছে পেতে জোরালো কূটনৈতিক চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।’