লক্ষ্য অর্জন নিয়ে বৈঠকেই সংশয়

.
.

২০২০ সালে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশে উন্নীত করা হবে। আগামী পাঁচ বছরে ১ কোটি ২৯ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে।
সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা দলিলে এ লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় এ দলিল অনুমোদন দেওয়া হয়। এনইসির চেয়ারপারসন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে পরিকল্পনা কমিশনের এনইসি সম্মেলনকক্ষে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
তবে এই দলিলের রাজস্ব আহরণ, বিদেশি বিনিয়োগসহ বেশ কিছু খাতে যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, এর সমালোচনা করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এসব লক্ষ্য বাস্তবসম্মত নয় বলে তিনি মনে করেন। লক্ষ্য অর্জন নিয়ে সংশয়ও প্রকাশ করেন তিনি।
পঞ্চবার্ষিক দলিলে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর হার ১৮ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে আসবে। বর্তমানে ২৪ দশমিক ৮ শতাংশ জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়েছে। পুরো পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন করতে ৩১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা লাগবে। এর মধ্যে ২৪ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা আসবে বেসরকারি খাত থেকে। আর সরকার বিনিয়োগ করবে ৭ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা।
সভা শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ যে নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে, এটা ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সুফল। শুধু রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ দিলেই হবে না, মানুষের সামাজিক উন্নয়নও করতে হবে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ২০২১, ২০৩০ ও ২০৪০ সালের উন্নয়নের ভিত্তি তৈরি করেছে।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি) সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা দলিল তৈরি করেছে। ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে সরকার কী ধরনের উন্নয়ন পরিকল্পনা নিয়েছে, এর দলিল হলো এই সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। এর আগে ছয়টি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও দুটি দারিদ্র্যবিমোচন কৌশলপত্র বাস্তবায়ন করেছে বাংলাদেশ।
অর্থমন্ত্রীর সমালোচনা: বৈঠকে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার বিভিন্ন দিক উপস্থাপন করেন জিইডি সদস্য শামসুল আলম। এরপর পরিকল্পনা দলিল নিয়ে সভায় অংশগ্রহণকারীরা মতামত দেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এ আলোচনায় অংশ নেন।
দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সমালোচনা করে বলেছেন যে রাজস্ব ও জিডিপি অনুপাত ১৬ দশমিক ১ শতাংশে উন্নীত করার যে লক্ষ্য দেওয়া হয়েছে, তা তাঁর ভাষায় নো ওয়ে টু এচিভ, এটা বোগাস, সম্ভব নয়। গত ছয় বছরে রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত বেড়েছে মাত্র ৩ শতাংশ। ফলে আগামী পাঁচ বছরে কীভাবে আরও ৫ শতাংশ বাড়বে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি।
সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের লক্ষ্য প্রসঙ্গেও মন্তব্য করেন অর্থমন্ত্রী। পরিকল্পনায় ২০২০ সালে ৯০০ কোটি ডলারের লক্ষ্য ধরা হয়েছে। এখন বিদেশি বিনিয়োগ আসে বছরে গড়ে ১৫০ কোটি ডলার। পাঁচ বছরে বিদেশি বিনিয়োগ ৯০০ কোটি ডলারে যাওয়ার লক্ষ্য অর্থমন্ত্রীর ভাষায় ইমপ্র্যাকটিক্যাল, আনরিয়েলস্টিক।
পরিকল্পনা দলিলে বিদেশি সহায়তার পরিমাণ জিডিপির ৩ শতাংশ উন্নীত করার কথা বলা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী এই লক্ষ্যেরও সমালোচনা করে বলেছেন, এটা আনরিয়েলস্টিক, কিছুতেই সম্ভব নয়। সর্বোচ্চ ২ শতাংশ হতে পারে।
গতকাল রাতে এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে জিইডি সদস্য শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, পরিকল্পনার এসব লক্ষ্য অর্থ মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে বসেই ঠিক করা হয়েছে। তখন আপত্তি করা হয়নি। তিনি বলেন, চলতি বাজেটে রাজস্ব আহরণে ২৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। আর পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় রাজস্ব আহরণের বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৯ শতাংশ।
বিদেশি বিনিয়োগ সম্পর্কে শামসুল আলম বলেন, ‘ভিয়েতনাম যদি বছরে ২ হাজার ২০০ কোটি ডলার বিদেশি বিনিয়োগ পায়, তবে আমরা কেন ৯০০ কোটি ডলার আনতে পারব না? আমরা বলেছি, এ জন্য পরিবেশ তৈরি করতে হবে। চীনের বিনিয়োগ বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে, সেটা ধরতে হবে।’
এনইসি সভায় অংশ নেওয়া একাধিক দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, পরিকল্পনা দলিলের ভাষাগত উপস্থাপনার সমালোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, এ দলিলটি শুধু জাতীয় দলিল (ফ্ল্যাগশিপ) নয়, এর মধ্যে রাজনৈতিক দর্শনও থাকতে হবে। এ পরিকল্পনার ঐতিহাসিক পটভূমি নেই। খাতওয়ারি অতীত ইতিহাস, বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ লক্ষ্য—এসব আসেনি। এ দলিলে পুরোনো তথ্য, পরিসংখ্যান ব্যবহারের সমালোচনা করেন তিনি।
দলিলে যা আছে: ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের মেয়াদে প্রবৃদ্ধি আরও প্রায় দেড় শতাংশ বিন্দু পয়েন্ট বৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। গত অর্থবছরে ৬ দশমিক ৫১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। পরিকল্পনার মেয়াদকালের প্রথম বছরে চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে। প্রতিবছর ধারাবাহিকভাবে বেড়ে ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা ৮ শতাংশে উন্নীত হবে। তবে জিডিপিতে ক্রমান্বয়ে কৃষি খাতে অবদান কমবে, শিল্প ও সেবা খাতের অবদান বাড়বে।
এ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে বেসরকারি বা ব্যক্তি বিনিয়োগের ওপরই ভরসা করছে সরকার। পরিকল্পনা অনুযায়ী, জিডিপিতে বেসরকারি বিনিয়োগের অংশ ২৬ দশমিক ৬ শতাংশে ওঠানো হবে। আর সরকারি বিনিয়োগের জন্য সরকার রাজস্ব আদায়ে জোর দেবে। জিডিপি ও রাজস্বের অনুপাত ২০২০ সালে ১৬ দশমিক ১ শতাংশে উন্নীত করা হবে। এখন এ অনুপাত প্রায় ১১ শতাংশ।
বর্তমানে অতি দারিদ্র্য হার ১২ দশমিক ৯ শতাংশ। পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, ২০২০ সালে এসে তা ৮ দশমিক ৯ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে।
আগামী পাঁচ বছরে দেশে নতুন করে ১২ হাজার ৫৮৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। এর মধ্যে সরকারি খাত থেকে ৭ হাজার ৬৮২ মেগাওয়াট ও বেসরকারি খাতে ৪ হাজার ৯০২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। ২০২০ সাল নাগাদ মোট উৎপাদনক্ষমতা দাঁড়াবে ২৩ হাজার মেগাওয়াট। বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে বেসরকারি বিনিয়োগে বড় আকারের বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কথা বলা হয়েছে পরিকল্পনার খসড়ায়। এ ছাড়া রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব হবে।
পরিকল্পনা মেয়াদকালে পদ্মা সেতু ও ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ শেষ হবে। এ ছাড়া গভীর সমুদ্রবন্দর, মেট্রোরেল, এলএনজি টার্মিনাল, পায়রা সমুদ্রবন্দরের মতো বড় প্রকল্পে বিনিয়োগকেই প্রাধান্য দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।