লক্ষ্য ছিল সাড়ে ৭ লাখ, গেছেন মাত্র ২ লাখ

করোনাভাইরাসের কারণে চাকরি হারিয়ে বিদেশ থেকে ফিরেছেন সাড়ে তিন লাখ কর্মী।

বাংলাদেশ থেকে এ বছর সাড়ে সাত লাখ নতুন কর্মীকে বিদেশে পাঠানোর লক্ষ্য ছিল প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু এখন পর্যন্ত দুই লাখও যেতে পারেননি। অর্থাৎ, বিদেশে এ বছর পাঁচ লাখের বেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ হারাল বাংলাদেশ। এর প্রভাব নিশ্চিতভাবেই আগামী বছর প্রবাসী আয়ে পড়বে বলে জানিয়েছেন অভিবাসন খাতের সঙ্গে যুক্ত বিশেষজ্ঞরা।

প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২০ সালের প্রথম তিন মাসে বাংলাদেশ থেকে ১ লাখ ৮১ হাজার ২১৮ জন নতুন কর্মী গেছেন বিভিন্ন দেশে। এরপর করোনা পরিস্থিতির কারণে বিশ্বজুড়ে উড়োজাহাজ সেবা বন্ধ হয়ে গেলে কাজ নিয়ে বিদেশে যাওয়াও বন্ধ হয়ে যায়। আর গত জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত গেছেন ৮ হাজার ১৩ জন। সব মিলিয়ে এ বছরের প্রথম ১১ মাসে (৩০ নভেম্বর পর্যন্ত) বিদেশে নতুন কর্মী গেছেন ১ লাখ ৮৯ হাজার ২৭১ জন। বছর শেষে সংখ্যাটি ২ লাখ ২০ হাজারের মতো হতে পারে বলে মনে করছেন বিএমইটির কর্মকর্তারা।

গত জুলাই মাস থেকে সীমিত আকারে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে উড়োজাহাজ যোগাযোগ চালু হলেও কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে নতুন কর্মী যাচ্ছেন খুবই কম। মূলত যাঁরা করোনার আগে বিভিন্ন দেশ থেকে ছুটিতে এসে আটকা পড়েছিলেন, তাঁদেরই একটি অংশ এখন যেতে পারছেন। গত বছর বাংলাদেশ থেকে সাত লাখ নতুন কর্মী কাজ নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গেছেন। বেশির ভাগ কর্মীর গন্তব্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো।

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন প্রথম আলোকে বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে বিশ্বজুড়েই অভিবাসন খাতে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হচ্ছে। এখন সরকারের লক্ষ্য হলো প্রচলিত শ্রমবাজার ধরে রাখা ও নতুন নতুন শ্রমবাজার খুঁজে বের করায় জোর দেওয়া। আর সংখ্যার চেয়ে গুণগত অভিবাসনে বেশি নজর দেওয়া হচ্ছে। দক্ষ কর্মী পাঠাতে পারলে কম কর্মী পাঠিয়েও বেশি প্রবাসী আয় দেশে আনা সম্ভব। তাই দক্ষ কর্মী তৈরিতে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

একদিকে নতুন কর্মীর যাওয়ার সুযোগ কমছে, অন্যদিকে কাজ হারিয়ে বিদেশ থেকে ফিরে আসার সংখ্যা বাড়ছে। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, উড়োজাহাজ বন্ধের পর গত এপ্রিল থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় ফিরতে শুরু করেছেন প্রবাসীরা। গত ১ এপ্রিল থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত দেশে ফিরে এসেছেন ৩ লাখ ২৬ হাজার ৭৫৮ প্রবাসী। এর মধ্যে পাসপোর্ট না থাকায় আউটপাস (ভ্রমণের বৈধ অনুমতিপত্র) নিয়ে এসেছেন ৪০ হাজার ৩৮১ জন। ফিরে আসা কর্মীদের মধ্যে ৩৯ হাজার ২৭৪ জন নারী কর্মী। এর আগে গত জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত আউটপাস নিয়ে এসেছেন ১৭ হাজার ২৮৯ জন। সব মিলিয়ে বছর শেষে ফিরে আসা প্রবাসীর সংখ্যা সাড়ে তিন লাখ ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন অভিবাসন খাতের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা।

গত মার্চে আড়াই লাখ টাকা খরচ করে কাতার যাওয়ার প্রস্তুতি শেষ করেছিলেন নারায়ণগঞ্জের শান্তা ইসলাম। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে যেতে পারেননি। গত এপ্রিলে তাঁর ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। দেশেই কিছু একটা করতে ঋণ নিতে প্রবাসী ব্যাংকে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। এখন আবার কাতার যাওয়ার চেষ্টা করে কোনো উপায় পাচ্ছেন না তিনি।

শান্তা ইসলামের মতো এমন অনেকেই সব প্রক্রিয়া শেষ করেও বিদেশে যেতে পারেননি। বিদেশে কর্মী পাঠানো এজেন্সিগুলোর সংগঠন বায়রা বলছে, এমন সংখ্যা এক লাখের বেশি হতে পারে। এর মধ্যে শুধু সৌদি আরবে যাওয়ার প্রক্রিয়া শেষ করেছিলেন ৯০ হাজারের বেশি। আর দেশে করোনা সংক্রমণ শুরুর আগে দেশে ছুটিতে এসে আটকা পড়েন প্রায় তিন লাখ প্রবাসী। দুই মাস ধরে তাঁরা ফিরে যেতে শুরু করেছেন। সৌদি আরবে একটি বড় অংশ ফিরে যেতে পারলেও মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলোর কর্মীরা নানা জটিলতায় ফিরতে পারছেন না। সীমিত আকারে ফেরার অনুমতি পাচ্ছেন তাঁরা।

এমন এক প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস আজ (১৮ ডিসেম্বর) পালিত হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশে এবার দিবসটির স্লোগান ‘মুজিব বর্ষের আহ্বান, দক্ষ হয়ে বিদেশ যান’। অবশ্য কয়েক বছর ধরেই দক্ষ কর্মী বিদেশে পাঠানোর কথা বলা হচ্ছে। বিএমইটির তথ্য বলছে, ২০১৮ সালে বিদেশে যাওয়া কর্মীদের মধ্যে ৪৩ শতাংশ ছিলেন দক্ষ কর্মী। আর গত বছর (২০১৯ সাল) বিদেশে যাওয়া কর্মীদের মধ্যে দক্ষ কর্মী ছিলেন ৪৪ শতাংশের মতো।

বিএমইটি বলছে, সারা দেশে দক্ষ কর্মী বাড়াতে কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্রগুলো বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছে। দক্ষ কর্মী পাঠানো বাড়াতে বাড়লে প্রবাসী আয়ে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা যাবে বলে মনে করছেন বিএমইটির কর্মকর্তারা। তাঁরা বলেন, এখন ফিরে আসা কর্মীদের কাজের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে দক্ষতার সনদ দেওয়া হচ্ছে। এটি ভবিষ্যতে আবার বিদেশে যেতে কাজে লাগবে।

পুনর্বাসন ঋণ বিতরণে ধীরগতি

ফিরে আসা কর্মীদের পুনর্বাসনে সরকারি ঋণসহায়তা বিতরণে এখনো ধীরগতি। গত ১৫ জুলাই থেকে আবেদন সংগ্রহ করা হলেও ঋণ ছাড় হয়েছে খুবই কম।

প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংক বলছে, ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪২৫ জন প্রবাসী পুনর্বাসন ঋণ পেয়েছেন। তাঁরা ৮ কোটি ৩৬ লাখ টাকার ঋণসহায়তা নিয়েছেন। নভেম্বর পর্যন্ত ঋণগ্রহীতার সংখ্যা ছিল ২১২ জন। এ মাস থেকে গতি বাড়তে শুরু করেছে।

এ বিষয়ে প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ব্যবস্থাপনা পরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. এবনুজ জাহান প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাংকের শাখা বাড়ানোসহ বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আবেদন ও ঋণ ছাড়; দুটোই বাড়ছে। গাণিতিক হারে নয়, জ্যামিতিক হারে এটি বাড়বে সামনে। ডিসেম্বরেই ঋণসহায়তা ১৬ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।

দক্ষ কর্মী তৈরির বিকল্প নেই

বিদ্যমান বাজারের পাশাপাশি নতুন নতুন শ্রমবাজারের সন্ধান করছে সরকার। বিশেষ করে ইউরোপের কয়েকটি দেশ পোল্যান্ড, রোমানিয়ায় সম্ভাবনা খুঁজে পাওয়া গেছে। নতুন শ্রমবাজার ধরতে দক্ষ কর্মী তৈরির বিকল্প নেই বলে মনে করছেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা। কারিগরি প্রশিক্ষণ বাড়াতে একাধিক মন্ত্রণালয় মিলে উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। বিশেষ করে স্বাস্থ্য খাতে কর্মী পাঠানোর ভালো সম্ভাবনা আছে।

এ বিষয়ে অভিবাসন খাতের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রামরুর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার তাসনিম সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, বিদেশে কাজ নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের তেমন কোনো ভূমিকা নেই, সবকিছু নিজেরাই করেন অভিবাসীরা। নিয়ম বেঁধে অভিবাসন হয় না। তাই অনিশ্চয়তা সব সময়ই থাকে। এখন যাওয়া বন্ধ কিন্তু ফিরে আসা বাড়ছে; তাই প্রবাসী আয় কমে যেতে পারে সামনে।