‘লজ্জিত হয়েছি আমরাও!’

বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ মো. কাশেম
ছবি: সংগৃহীত
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রায় ১০০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার সম্মানী ভাতা স্থগিত করেছে। মন্ত্রণালয়ের ভাষ্য, তাঁদের বিরুদ্ধে বিভিন্নজনের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা পেয়ে অথবা দ্বন্দ্বের কারণে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এ নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ মো. কাশেম। ৬৬ বছর বয়সী মো. কাশেম সারা দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরব থাকেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভের উপদেষ্টা। ‘মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ’ ইন্টারনেটভিত্তিক সংগ্রহশালা। যেখানে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের বই, দলিল, সে সময়ের পত্রপত্রিকা, মুক্তিযোদ্ধাদের গেজেট, তথ্যচিত্র, ভিডিও ফুটেজ, চলচ্চিত্র, অডিও ও আলোকচিত্র। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলাম

প্রশ্ন :

প্রশ্ন: মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার কারণে ভাতা স্থগিতের বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?

উত্তর: বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার কারণে ভাতা স্থগিত করে সরকার সঠিক পদক্ষেপ নিয়েছে। বীর মুক্তিযোদ্ধারা এভাবে সবার সামনে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে এসে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া অসম্মানের, লজ্জার। লজ্জিত হয়েছি আমরাও। সহযোদ্ধা হিসেবে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ে তাঁরা অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছেন। এটা খুবই দুঃখজনক। মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাঁদের আত্মমর্যাদা ও সম্মান সবার ওপরে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন কারণে বিভিন্নভাবে অনেক সময় তাঁদের মতো দু-চারজনের দোষেই প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানহানি হচ্ছে। তাঁদের জন্যই অমুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা বাড়ছে। যেখানে মুক্তিযোদ্ধা থাকার কথা সোয়া লাখ, সেখানে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে আড়াই লাখ।

প্রশ্ন :

এ অবস্থার জন্য দায়ী কে বলে মনে করছেন আপনি?

উত্তর: দায়ী মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, দায়ী মুক্তিযোদ্ধারা। আমি ভয় না পেয়েই বলতে পারি, এই মন্ত্রণালয় ব্যর্থ। রাজনৈতিক চাপের কারণে হোক বা দলীয় কারণে—যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ দেখেননি, মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি, তাঁদের অনেককে মুক্তিযোদ্ধা বানানো হচ্ছে। উদাহরণ দিয়ে বলতে পারি, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) ৭০তম সভায় খুলনা মহানগরের একজনের নাম মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অথচ আমরা কেউ তাঁকে চিনি না। ওই এলাকায় কোনো মুক্তিযোদ্ধা নেই। তাঁর নাম কোথা থেকে এল বুঝতে পারলাম না। পরে স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে জানলাম, একজন সাংসদ তাঁর নাম সুপারিশ করেছেন, তদবির করেছেন। অন্যদিকে, অনেক খ্যাতিমান মুক্তিযোদ্ধার নাম তালিকায় আসছে না।

প্রশ্ন :

আপনি বলেছেন সোয়া লাখ মুক্তিযোদ্ধা থাকার কথা, তাহলে বাকিরা কোথা থেকে এল?

উত্তর: আমি মনে করি অথবা আমার জানা মতে, মুক্তিযুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকা মানুষই বেশি অংশ নিয়েছিল। তবে এখন দেখছি সচিব, প্রকৌশলী, সরকারি কর্মকর্তারা অনেক বেশি। তাঁদের মধ্যে অনেকে সন্তান, নাতি-নাতনির জন্য সনদ নিয়েছেন। আবার এমনও ব্যক্তি আছেন, যাঁরা বলতেই পারেন না কোন সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন। আমি কাউকে ভয় না পেয়েই বলছি, এর বেশির ভাগই ফেক বা ভুয়া। সুবিধা নিতে অর্থ দিয়ে তাঁরা সনদ নিয়েছেন। তবে তাঁরা ধরাও পড়েছেন। ৩০ জানুয়ারি বীর মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ের দিন অনেক অমুক্তিযোদ্ধারই নাম প্রকাশ করা হবে। তবে এটাও ঠিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্যদের নিয়ে নানা অভিযোগ রয়েছে।

প্রশ্ন :

৩০ তারিখের যাচাই–বাছাইয়ের বিষয়ে আপনার অভিমত কী?

উত্তর: এবারের যাচাই–বাছাই খুব কাজে আসবে। কেননা, যারাই সাক্ষ্য দেবেন, তাঁদের বন্ডে সই করতে হবে। মিথ্যা সাক্ষ্য বা অসত্য তথ্য দিলে কমপক্ষে ছয় মাসের ভাতা বন্ধ হবে। এই ভয়ে কেউ মিথ্যা তথ্য দেবেন না। তবে আমি মনে করি, এবার যাচাই–বাছাইয়ের পর এসব চিরতরে বন্ধ হওয়া উচিত। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত একটি তালিকা প্রকাশ করতে হবে। বীর মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় কোনো অমুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত হয়ে থাকলে তাঁকে অবশ্যই বাদ দিতে হবে।

প্রশ্ন :

প্রশ্ন: এবারের যাচাই-বাছাইয়ে কি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবে বলে আপনি মনে করেন?

উত্তর: প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা অন্তর্ভুক্ত হবেন কি না, তা বলতে পারব না। অনেকেই আবেদন করেননি। কিন্তু আমি নিশ্চিত, অনেক অমুক্তিযোদ্ধার নাম বাদ যাবে।