লালচে কাঠঠোকরা

আদমপুর সংর‌ক্ষিত বনে লালচে কাঠঠোকরা l ছবি: লেখক
আদমপুর সংর‌ক্ষিত বনে লালচে কাঠঠোকরা l ছবি: লেখক

শীতকালের এক সকালে বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলার সাতশৈয়ার গ্রামের মেঠো পথ ধরে হাঁটছিলাম। শীত সকালের মিষ্টি রোদ গায়ে পড়ায় বেশ আরাম পাচ্ছিলাম। খানিক হাঁটার পর কলসিবাঁধা একটা খেজুরগাছ চোখে পড়ল। গাছের কপাল থেকে কলসিতে রস পড়ার জন্য যে কঞ্চির নলি দেওয়া থাকে, তার ওপর বসে একটি হলদে পাখি খেজুরের রস পান করছিল। ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে গেল। শীতকালে গ্রামে বেড়াতে গেলেই ভোরবেলা আব্বা খেজুরের রসের ব্যবস্থা করতেন। রসের কলসি আসার পর আমরা চাচাতো-জ্যাঠাতো ভাইবোনেরা রস পান করার জন্য রীতিমতো প্রতিযোগিতায় নেমে পড়তাম। এসব সাত-পাঁচ যখন ভাবছি, ঠিক তখন হঠাৎ করেই আমার মাথার ওপর দিয়ে অন্য একটি পাখি ছন্দে ছন্দে উড়ে গিয়ে পাশের নারকেলগাছটায় বসল। চমৎকার ভঙ্গিমায় লালচে-খয়েরি সুদর্শন পাখিটি তার ড্যাগারের মতো চোখা ঠোঁটটি গাছের কাণ্ডে চালিয়ে টসটসে পোকায় উদর পূর্তি করছে। অনেক কষ্টে ওর একটা চলনসই ছবি তুললাম। জীবনে প্রথম এই পাখিটিকে দেখলাম।

বহুদিন পর লালচে-খয়েরি দেহের ওই পাখিটিকে আবার দেখলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের আমলকীবাগানে। কিছুদিন পর মিরপুরের জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে ওদের দুটিকে দেখলাম প্রজননরত অবস্থায়। সর্বশেষ কিছুদিন আগে এক সকালে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর সংরক্ষিত বনে ওকে দেখলাম।

সুদর্শন এই পাখিটি আমাদের আবাসিক পাখি লালচে কাঠঠোকরা। খয়েরি কাঠকুড়ালি নামেও পরিচিত। ইংরেজি নাম Rufous Woodpeckeer বা Eastern Rufous Woodpeckeer. Picidae পরিবারের পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Celeus brachyurus.

লালচে কাঠঠোকরার দেহের দৈর্ঘ্য ২৫ সেন্টিমিটার ও ওজন ১০৫ গ্রাম। এদের পুরো দেহের পালক লালচে-খয়েরি, তার ওপর রয়েছে কালচে ডোরা। মাথার চূড়া লোমশ। কাঁধ-ঢাকনি, ডানা লেজ ও বগলে আড়াআড়ি ডোরা রয়েছে। গলার পালক আঁইশের মতো দেখায়। পিঠ ও পেটে হালকা কালচে টান, ছিট ও ছোপ রয়েছে। চোখ বাদামি লাল। চোখের নিচে অর্ধচন্দ্রাকৃতির উজ্জ্বল লাল পট্টি আছে। ঠোঁট ও নখ কালো। পা ও পায়ের পাতা নীলচে-সবুজ। স্ত্রী আকারে কিছুটা ছোট এবং স্ত্রীর কান-ঢাকনি হালকা পীত বর্ণের। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির বুক ও তলপেটে স্পষ্ট আড়াআড়ি ডোরা ও অর্ধচন্দ্রাকৃতির দাগ থাকে।

লালচে কাঠঠোকরা আর্দ্র পাতাঝরা বন, চিরসবুজ বনসহ বন-বাগান, এমনকি লোকালয়েও বাস করে। এরা একাকী বা জোড়ায় ঘুরে বেড়ায়। ছোট পোকামাকড়, পিঁপড়া, লার্ভা, উইপোকা, বুনো ডুমুর ও ডুমুরের রস প্রিয় খাবার। এরা চমৎকার ভঙ্গিমায় গাছে ঝুলে থেকে পিঁপড়া ও পোকামাকড়ের বাসায় ঠোঁট চালায়। টসটসে উইপোকা খাওয়ার জন্য উইঢিবিতে আক্রমণ চালাতেও ছাড়ে না।

এপ্রিল-মে প্রজননকাল। এ সময় গাছের খোঁড়ল বা গর্তের মতো জায়গায় বাসা বানায়। কখনো কখনো গেছো পিঁপড়ার বাসার ভেতরে বা ওপরেও বাসা করতে পারে। ডিম পাড়ে ২-৩টি। ডিমের রং সাদা। ১৪-১৮ দিন তা দেওয়ার পর ডিম থেকে ছানা বেরোয়। ছানারা প্রায় ২৫-২৭ দিনে উড়তে পারে। লালচে কাঠঠোকরা প্রায় পাঁচ বছর বাঁচে।