লালমনিরহাটে উড়োজাহাজ মেরামত কেন্দ্র করবে সৌদি

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালের পরিত্যক্ত লালমনিরহাট বিমানঘাঁটি ও এয়ারস্ট্রিপকে (ছোট পরিসরের রানওয়ে) ঘিরে এ অঞ্চলের উড়োজাহাজ মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের কেন্দ্র গড়ে তুলতে চায় সৌদি আরব। এই লক্ষ্যে দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত বিমান মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ প্রতিষ্ঠান আলসালাম এরোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ শুরুতে বাংলাদেশে অন্তত ২০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছে।

ঢাকা ও রিয়াদের কূটনৈতিক সূত্রগুলো প্রথম আলোকে জানিয়েছে, লালমনিরহাট বিমানঘাঁটিকে কেন্দ্র করে বিনিয়োগের প্রস্তাবের বিষয়ে বাংলাদেশ এরই মধ্যে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে। প্রস্তাব বাস্তবায়নের বিষয়ে আলোচনার জন্য গত মাসের শেষ ভাগে সৌদি আরবকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ।

রিয়াদের একটি কূটনৈতিক সূত্র এই প্রতিবেদককে জানিয়েছে, এ বছরের এপ্রিলে বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল মাসিহুজ্জামানের সৌদি আরব সফরের সময় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। ওই সময় তিনি সেখানকার শীর্ষস্থানীয় প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের পাশাপাশি আলসালাম এরোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ পরিদর্শনে যান।

জানতে চাইলে সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহ গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, বিমানবাহিনী প্রধানের সাম্প্রতিক রিয়াদ সফরের সময় দুই দেশের বিমানবাহিনীর সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এ সময় লালমনিরহাট বিমানঘাঁটিকে কেন্দ্র করে আলসালাম এরোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজের সঙ্গে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর সহযোগিতায় কারখানা প্রতিষ্ঠার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।

গোলাম মসিহ জানান, সমরাস্ত্র নির্মাতা ও রক্ষণাবেক্ষণ প্রতিষ্ঠান সৌদি অ্যারাবিয়ান মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিজের (সামি) আওতায় আলসালাম এরোস্পেস বাংলাদেশে কাজটি করবে।

আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) গত ১১ এপ্রিল এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, বিমানবাহিনী প্রধান মাসিহুজ্জামান সৌদি সফরের সময় রাজকীয় সৌদি সশস্ত্র বাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ জেনারেল ফায়িদা বিন হামাদ আর-রোয়াইলি, রাজকীয় সৌদি বিমানবাহিনীর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল তুরকি বিন বানদার বিন আবদুলআজিজের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। তিনি রাজকীয় সৌদি বিমানবাহিনীর পরিচালনা কেন্দ্র, বাদশাহ ফয়সাল বিমান একাডেমি ও আলসালাম এরোস্পেস পরিদর্শন করেন।

মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও প্রতিরক্ষাবিষয়ক সাময়িকী থেকে জানা গেছে, সব ধরনের সামরিক উড়োজাহাজ, জেট, হেলিকপ্টারের পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি উড়োজাহাজ মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ১৯৮৮ সালে আলসালাম এরোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজের যাত্রা শুরু হয়। আর সামরিক ও বেসামরিক উড়োজাহাজ নির্মাণ ও মেরামত এবং সমরাস্ত্রের বৈশ্বিক বাজার ধরতে সৌদি সরকার ২০১৭ সালে গড়ে তুলেছে সামি। যুক্তরাষ্ট্রে নিবন্ধিত সৌদি সরকারের এই প্রতিষ্ঠান ২০৩০ সালের মধ্যে সমরাস্ত্রের বৈশ্বিক বাজারে সরবরাহকারী দেশের তালিকায় নেতৃত্ব দেওয়ার লক্ষ্য সামনে রেখে এগিয়ে চলেছে।

প্রাথমিকভাবে সৌদি প্রতিষ্ঠানটি ধারণা দিয়েছে, বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর সঙ্গে সরকারি পর্যায়ে যৌথ বিনিয়োগের একটি চুক্তি সই হবে। এরপর বাণিজ্যিকভাবে তারা কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে। গত সপ্তাহে রিয়াদের বাংলাদেশ দূতাবাস বিষয়টি নিয়ে আলোচনার ব্যাপারে সরকারের সম্মতি জানিয়ে সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে।

প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের জুলাইয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লালমনিরহাট বিমানঘাঁটিতে বিমান কারখানা নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিলেন।

>এই প্রস্তাব শুধু অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে দেখলে ঠিক আছে
কিন্তু সামরিক উপাদান যুক্ত হলে সজাগ থাকতে হবে
আ ন ম মুনীরুজ্জামান, প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ

সৌদি প্রস্তাব সম্পর্কে জানতে চাইলে গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, বন্ধুদেশ হিসেবে সৌদি আরবের সঙ্গে সহযোগিতা হতেই পারে। তা ছাড়া যেকোনো বিদেশি বিনিয়োগকে বাংলাদেশ স্বাগত জানায়। তবে নিরাপত্তা সহযোগিতার উপাদান আছে, এমন বিনিয়োগের সময় কোনো দেশের নিজস্ব ও আঞ্চলিক দ্বন্দ্বে যাতে বাংলাদেশ জড়িয়ে না পড়ে, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকা বাঞ্ছনীয়।

সাবেক ওই জ্যেষ্ঠ প্রতিরক্ষা কর্মকর্তার মতে, সৌদি আরবের বিনিয়োগের প্রস্তাব শুধু অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে দেখলে ঠিক আছে। কিন্তু এর সঙ্গে সামরিক উপাদান যুক্ত হলে তা নিয়ে সজাগ থাকতে হবে।

প্রতিরক্ষা চুক্তির বাস্তবায়ন কোন পথে
দুই দেশের মধ্যে সামরিক সহযোগিতা জোরদারের জন্য এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি সই হয়। মূলত রূপরেখা চুক্তিটি বাস্তবায়নের জন্য পরিচালনা পর্যায়ে বেশ কয়েকটি সম্পূরক চুক্তি সইয়ের কথা রয়েছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে সৌদি-ইয়েমেন সীমান্তে মাইন অপসারণের জন্য বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর জনবল নিয়োগ এবং অন্যটি সৌদি সীমান্ত ব্যবস্থাপনা ও সামরিক, বেসামরিক অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়নকাজ।

কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, সীমান্তে মাইন অপসারণের জন্য সৌদি-ইয়েমেন সীমান্তের দক্ষিণাঞ্চলের নাজরান ও জিজানে বাংলাদেশি সেনা মোতায়েনের প্রস্তাব দিয়েছে সৌদি আরব।

২০১৫ সালে ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সৌদি নেতৃত্বে সামরিক অভিযান শুরুর পর থেকেই ওই সব এলাকায় দুই পক্ষের মধ্যে সংঘাত চলছে। কয়েক মাসের মধ্যে এ নিয়ে আলোচনার পর থেকেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যদের সৌদি ভূখণ্ডে মোতায়েন করা হবে। ধারণা করা হয়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রায় ১ হাজার ৮০০ সদস্যকে মাইন অপসারণে নিয়োগ দেওয়া হবে।

সীমান্ত ব্যবস্থাপনার বিষয়ে জানতে চাইলে আলোচনার প্রক্রিয়ায় যুক্ত একটি সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি) সৌদি আরব-ইয়েমেন সীমান্তে ব্যবস্থাপনার কাজ করবে। সীমান্ত ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি সামরিক, বেসামরিক অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়নকাজও করবে বিজিবি।

জানতে চাইলে গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের (বিইআই) ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট এম হুমায়ুন কবীর প্রথম আলোকে বলেন, সৌদি আরব নিজেদের অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য আনতে বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগের পদক্ষেপ নিচ্ছে। এমন এক পরিস্থিতিতে সৌদি আরবের বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ আদর্শ জায়গা। সৌদি আরব যখন বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশকে বেছে নেয়, ব্যবসার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের সহযোগিতাও তার কাম্য। যেমন সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ, ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন অভিযানে সমর্থন। কাজেই এ বিষয়ে একধরনের ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক বজায় রাখার বিষয়ে বাংলাদেশকে খেয়াল রাখতে হবে।