লেবানন: দেশ ছোট, আঘাত বড়

বৈরুত বন্দরে ৪ আগস্ট ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। ছবি: এএফপি
বৈরুত বন্দরে ৪ আগস্ট ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। ছবি: এএফপি

পৃথিবীর বুকে আয়তনে ক্ষুদ্র একটি রাষ্ট্র লেবানন। মাত্র ১০ হাজার ৪৫২ বর্গকিলোমিটার আয়তনের একটি দেশ। ক্ষুদ্র হলেও আন্তর্জাতিক স্বার্থান্বেষী মহলের কাছে ভূরাজনৈতিক বিবেচনায় দেশটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অতীতে নানা আগ্রাসন, বাইরের হস্তক্ষেপ ও দেড় দশকের গৃহযুদ্ধ অন্তত সেটাই প্রমাণ করে। দেশটির একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবন্দর বৈরুত। ৪ আগস্ট বৈরুত বন্দরে থাকা ২ হাজার ৭৫০ মেট্রিক টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট বিস্ফোরণে বন্দরটি একেবারেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। এ পর্যন্ত দেড় শ মানুষ মৃত্যুবরণ করার খবর পাওয়া গেছে। প্রায় তিন লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। ১০ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে দেশটি। এমনিতেই পশ্চিম এশিয়ার এ দেশ (লেবানন) দীর্ঘদিন বিদেশি আগ্রাসন আর গৃহযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত। দেড় দশক ধরে অভ্যন্তরীণ সামাজিক ও রাজনৈতিক চুক্তির আওতায় গণতন্ত্রের মোড়কে গঠিত রাষ্ট্রব্যবস্থা কিছুটা স্থিতিশীলতা পেলেও দেশটির অর্থনীতি ভঙ্গুর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক অব্যবস্থা, দুর্নীতি ও দুঃশাসনে সেখানকার জনগণের ত্রাহি অবস্থা। করোনাকাল শুরুর আগে দেশটির শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগে প্রচণ্ড গণবিক্ষোভ হয়। এতে শাসকগোষ্ঠীর খুব একটা টনক নড়েছে বলে মনে হয় না।

এরপর আসে করোনাকাল। করোনার ফলে লেবাননের জনগণের ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ অবস্থা হয়। মানুষের কর্মহীন হয়ে পড়া, বেতন হ্রাস পাওয়া, মুদ্রার মান পড়ে যাওয়ায় অর্ধেক বেতন আবারও অর্ধেক হয়ে যাওয়া ইত্যাদি ঘটনা দেশটির অর্থনীতিকে তলানিতে পৌঁছে দেয়। এর ওপর ছোট্ট এই দেশকে বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর চাপও সামলাতে হয়। মাত্র ৬১ লাখ জনসংখ্যা যে দেশে, সে দেশে ১৫ লাখ সিরীয় ও ফিলিস্তিনি শরণার্থী। এমন একটি নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে যখন বৈরুত বিস্ফোরণ ঘটল, তখন সাধারণ লেবানিজদের অসহায় অবস্থার ওজন ঠিক কতটা, তা পরিমাপ করা সত্যিই কঠিন! ২০১৩ সাল থেকে এই বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক কী করে বন্দর এলাকায় মজুত থাকল, সে দায় শুধু কি বন্দর কর্তৃপক্ষের নাকি রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষেরও আছে? একই সঙ্গে এই প্রশ্নও উড়িয়ে দেওয়া যায় না যে এই অব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে লেবাননকে আরও তলানিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক কোনো ষড়যন্ত্র কাজ করছে কি না। এর যেকোনোটির রহস্য উদ্‌ঘাটনের জন্য লেবানিজদেরই মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। পাশাপাশি পরিপূর্ণ সদিচ্ছা থাকলে জাতিসংঘের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।

লেবানন এমন একটি দেশ, যেখানে ৫৪ শতাংশ জনসাধারণ মুসলিম, ৪১ শতাংশ খ্রিষ্টান এবং ৫ শতাংশ দ্রুজ জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। রাষ্ট্রব্যবস্থায় ক্ষমতা বণ্টনে রাষ্ট্রপতি খ্রিষ্টান, প্রধানমন্ত্রী সুন্নি মুসলিম এবং স্পিকার শিয়া মুসলিম। অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে এখানে এমন একটি বহুপক্ষীয় ঐক্য তৈরি হয়েছে। এই ঐক্য ধরে রাখতে হলে লেবানিজদের ধৈর্য, ত্যাগ ও সহনশীলতার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটাতে হবে। দুর্নীতিবাজদের রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে যেমন হটাতে হবে, তেমনি ধর্মীয় ও জাতিগত ঐক্য রক্ষা করতে হবে। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রও মোকাবিলা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে লেবাননের জন্য সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে, সৎ ও বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী সন্ধান করা। মধ্যপ্রাচ্যকে যেভাবে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রমূলক রাজনীতি তছনছ করে দিয়েছে, সে ক্ষেত্রে মুসলিম কোনো দেশ মনে হয় না, লেবাননকে নিরাপদ করতে পারে। কেননা মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় প্রতিটি দেশ আজ কোনো না কোনোভাবে ষড়যন্ত্র ও বিপর্যয়ের শিকার। বৈরুত বিস্ফোরণের ঘটনায় যাঁরা বাইরের ষড়যন্ত্রের আভাস খুঁজছেন, তাঁদের উদ্দেশ্য কতটুকু পরিষ্কার, সেটিও লেবাননকে বুঝতে হবে।

লেবানন সরকার প্রথমে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের মজুতকেই বিস্ফোরণের জন্য দায়ী করে আসছিল। কিন্তু এতে যখন সমালোচনার তির দায়িত্বে অবহেলার জন্য নিজের দিকেই আসছিল, তখন শাসকগোষ্ঠী ষড়যন্ত্রতত্ত্বের দিকেও মনোযোগ ঘোরাতে চেষ্টা করছে। এমন উদ্দেশ্যবাদী চেষ্টা দ্বারা প্রকৃত তথ্য উদ্‌ঘাটন কঠিন হবে বৈকি। লেবানিজ শাসকগোষ্ঠীর নিজেদের স্বার্থ কুক্ষিগত করার চেয়েও নিজ নিজ ধর্ম ও গোষ্ঠীগত স্বার্থের কথা ভাবতে হবে কিংবা জনগণকে তাদের সরকারকে সেটি ভাবতে বাধ্য করতে হবে।

ছোট্ট একটা দেশ যেখানে পর্যটনই হচ্ছে অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি, সেই দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর এবং আশপাশের এলাকা যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে, দায় যাদেরই হোক, তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। এবং সেটি সম্ভব কেবল নিরপেক্ষ ও যথাযথ তদন্তের মাধ্যমেই। জাতিসংঘ চাইলে এখানে প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। প্রতিবেশী দেশ সিরিয়া যুদ্ধবিধ্বস্ত। এখানে এখনো যুদ্ধের ইতি ঘটেনি। ইসরায়েল বিস্ফোরণের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করলেও মধ্যপ্রাচ্যে তাদের আগ্রাসন নীতি থেকে সরে আসেনি; বরং নেতানিয়াহু-ট্রাম্প ঐক্য মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষতে আরও ঘি ঢেলে চলেছে। ফিলিস্তিনে আগ্রাসন নীতি জোরদার করেছে। সামগ্রিক বিবেচনায় বৈরুত বিস্ফোরণকে কোনোভাবেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। অভ্যন্তরীণ শাসনব্যবস্থার ভঙ্গুরতা যদি এর জন্য দায়ী হয়, তবে দেশের জনগণকে সেই শাসনব্যবস্থার খোলনলচে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে পাল্টাতে অগ্রণী হতে হবে। আর যদি আন্তর্জাতিক কোনো ষড়যন্ত্র এর পেছনে ছিল বলে প্রমাণিত হয়, তবে লেবাননকে সুরক্ষার জন্য একই সঙ্গে দেশের জনগণ, জাতিসংঘ কিংবা জাতিসংঘভুক্ত উদার বৃহৎ শক্তিকে নির্মোহভাবে এগিয়ে আসতে হবে। নয়তো বিশ্ববাসী সাক্ষীগোপালের মতো একটি পৃথিবীকে দেখবে, যেখানে সভ্যতার পরিবর্তে রচিত হচ্ছে আরণ্যক বাস্তবতা, যেখানে বড় বড় হিংস্র পশু ছোট্ট প্রাণীদের নির্বিচারে হত্যা করে আর ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে কেড়েকুড়ে খায়। একুশ শতকে দাঁড়িয়ে নিশ্চয়ই এমন নিষ্ঠুরতা আশা করা যায় না!

লেখক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক
[email protected]