লোকসাহিত্যের দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার

বাংলা শিশুসাহিত্যের ধারায় সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাম দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার। একাধারে লোকসাহিত্যের সংগ্রাহক, ছড়াকার, চিত্রশিল্পী, দারুশিল্পী এবং কিশোর কথাকার হিসেবেও দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার বিশেষ অবদান রেখে গেছেন। বস্তুত তাঁর হাত ধরেই বাঙালি কিশোর শিক্ষার্থীরা সাহিত্যের অন্তলোকে প্রবেশ করে—প্রথম শব্দশিল্পের আস্বাদ লাভ করে।

প্রধানত ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ শীর্ষক অবিস্মরণীয় গ্রন্থের জন্যই বাঙালি পাঠকসমাজে সমধিক পরিচিত দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার। শিশুসাহিত্যে তাঁর ভূমিকার কথা স্মরণ করে এ কথা আজ নিঃসন্দেহে বলা যায় যে হাজার বছরের বাংলাদেশ যেসব সূর্যসন্তান বাঙালি জাতিকে উপহার দিয়েছে, সাভারের দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার তাঁদের মধ্যে অন্যতম।


১৮৭৭ সালের ১৫ এপ্রিল (১২৮৪ বঙ্গাব্দের ২ বৈশাখ) ঢাকা জেলার অন্তর্গত সাভারের উলাইল গ্রামের সম্ভ্রান্ত মিত্র মজুমদার বংশে দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার জন্মগ্রহণ করেন। দক্ষিণারঞ্জনের পরিবারের আদি বাস ছিল বরিশালের বাকলা মহকুমা অন্তর্গত চন্দ্রদ্বীপ গ্রামে। তাঁর ধমনিতে প্রবাহিত ছিল প্রাচীন বাংলার রাজবংশের রক্তধারা।

দক্ষিণারঞ্জনের পিতা রমদারঞ্জন মিত্র মজুমদার ও মাতা কুসুমময়ী। রমদারঞ্জন ছিলেন একজন স্বভাবকবি, নানা শাস্ত্রে তিনি ছিলেন ব্যুৎপন্ন। শৈশবে পিতার মাধ্যমেই সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ওঠেন দক্ষিণারঞ্জন। পিতা–মাতার একমাত্র সন্তান দক্ষিণারঞ্জনের গৎবাঁধা লেখাপড়ার প্রতি তেমন মন ছিল না। তাই একটু বেশি বয়সেই তাঁর স্কুলে যাওয়া। ১৮৮৬ সালে যখন দক্ষিণারঞ্জনের বয়স মাত্র ৯ বছর তখন তাঁর মা মৃত্যুবরণ করেন। ১৮৮৭ সালে ১০ বছর বয়সে তাঁকে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করে দেওয়া হয় ঢাকার কিশোরীমোহন হাইস্কুলে পরে বিভিন্ন স্কুল পরিবর্তন করে সর্বশেষ ১৮৯৮ সালে মুর্শিদাবাদের বহরমপুর হাইস্কুলে প্রথম বিভাগে এনট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর তাঁকে বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ কলেজে এফএ ক্লাসে ভর্তি করানো হয়। ১৯২০ সালে পিতা রমদারঞ্জন মারা যান।

দক্ষিণারঞ্জনের ধরাবাঁধা পড়ালেখার প্রতি অনীহা ও পিতার মৃত্যুর কারণে পিসিমার সঙ্গে মুর্শিদাবাদ ত্যাগ করে টাঙ্গাইল চলে যাওয়ায় তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখার সমাপ্তি ঘটে। কিন্তু পিতার সমৃদ্ধ পাঠাগার তাঁকে সাহিত্যচর্চায় চরম আকর্ষিত করত।

১৯০১ সালে দক্ষিণারঞ্জনের সম্পাদিত মাসিক ‘সুধা’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। চার বছর ধরে গোটা বিশেক সংখ্যা প্রকাশিত হয়। দক্ষিণারঞ্জনের প্রথম গ্রন্থ ‘উত্থান’ কাব্য প্রকাশিত হয় ১৯০২ সালে। ‘উত্থান’ এবং ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ (১৯০৭) ছাড়া তাঁর যেসব বই বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য সেগুলো হলো ‘মা-বাবা আহুতি’, ‘ঠাকুরদাদার ঝুলি’, ‘চারু -হারু’, ‘দাদামশায়ের থলে’, ‘খোকা খুকুর খেলা’, ‘আমালবই’, ‘সরলচণ্ডী’, ‘পূজার কথা’, ‘ফার্স্টবয়’, ‘উৎপল ও রবি’, ‘কিশোরদের মন’, ‘কর্মের মূর্তি’, ‘বাংলার সোনার ছেলে’, ‘সবুজ লেখা’, ‘চিরদিনের রূপকথা’, ‘আশীর্বাদ’, ‘আশীর্বাণী’ ইত্যাদি। তাঁর প্রতিটি বইই বাংলা সাহিত্যের অক্ষয় সম্পদ। সাহিত্যজীবনই মূলত তাঁর কর্মজীবন ছিল। সারা জীবনই তিনি লোকসাহিত্য সংগ্রহ, সম্পাদনা করেছেন।

দক্ষিণারঞ্জনের প্রতিভার আর দুটি বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, তিনি খুব ভালো ছবি আঁকতেন। নিজের বইয়ের ছবি এবং প্রচ্ছদগুলো সব সময় তিনি নিজেই আঁকতেন। দক্ষিণারঞ্জন ছিলেন একজন অসাধারণ দারুশিল্পী। কলকাতার পূর্ণদাস রোডে তাঁর যে বাসভবন, সেখানকার দরজা-জানালার কাঠের শিল্পকর্ম তিনি নিজের হাতেই করেছেন।

১৯০৮ সালে বিক্রমপুরের মালখানগরের বসু পরিবারের কন্যা গিরিবালা দেবীর সঙ্গে দক্ষিণারঞ্জন পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। দক্ষিণারঞ্জন ও গিরিবালার ঘরে জন্মগ্রহণ করেন ১১ জন সন্তান। ১৯৫৬ সালের ৩০ মার্চ বাংলা ১৩৬৩ সালের ১৬ চৈত্র দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার ৮০ বছর বয়সে কলকাতার নিজ বাসভবন ‘সাহিত্যাশ্রম’–এ চিরনিদ্রায় শায়িত হন।
দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার বাংলা সাহিত্যের এক কিংবদন্তি পুরুষ। এ দেশের কিশোর-কিশোরীদের স্বপ্নমুখী, সাহিত্যমুখী এবং জীবনমুখী করার ক্ষেত্রে তিনি পালন করেছেন অবিস্মরণীয় ভূমিকা। দক্ষিণারঞ্জনের শিকড়ের সন্ধান আসলে আমাদের সাভারবাসীর ঐতিহ্যের অনুসন্ধান তথা বাঙালির ঐতিহ্যের অনুসন্ধান। এই শিকড় গভীর থেকে গভীরতর স্তরে গ্রথিত। তাই এর অনুসন্ধান কখনোই শেষ হওয়ার নয়, যেখানেই শেষ হবে সেখান থেকেই আবার শুরু করতে হবে এবং নিরলসভাবে তা চালিয়ে যেতে হবে। তাঁর এই অনুসন্ধান হবে আমাদের নিজেদের জানার প্রক্রিয়ারই একটি অংশ।

* বিশ্বজিৎ ঘোষ ও কালি প্রসন্ন দাস-এর লেখা হতে সংকলিত।
*[email protected]