
অভাব-অনটনের কাছে হার মানেনি ওরা। সংসারের ঘানি টানার পাশাপাশি চালিয়ে গেছে পড়াশোনা। পড়াশোনা করতে গিয়ে পাড়ি দিতে হয়েছে বন্ধুর পথ। ওদের অধ্যবসায় ও অদম্য ইচ্ছাশক্তির কাছে দারিদ্র্যও হার মেনেছে। এবারের এসএসসি পরীক্ষায় ওরা জিপিএ-৫ পেয়েছে। আজ শুনব এমনই চার অদম্য মেধাবীর গল্প।
হাঁস-মুরিগ পালন করে পড়ত রাখি: রাখি আক্তারের বাবা আবদুর রহমান দিনমজুর। মা শরিফা খাতুন গৃহিণী। মা-বাবা ও চার ভাই-বোনের সঙ্গে ছোট একটি ঘরে ঠাসাঠাসি করে থাকতে হয়। বাবার আয়ে সংসার না চলায় মায়ের সঙ্গে সেও হাঁস-মুরগি পালন করেছে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকেই সে তার মাকে সহায়তা করেছে। হাঁস-মুরগির জন্য ফসলের মাঠে গিয়ে শামুক কুড়িয়েছে। এসব কাজের পাশাপাশি লেখাপড়া চালিয়ে গেছে। ঘরে বিদ্যুৎ না থাকায় রাতে কুপি বাতির আলোয় পড়তে হয়েছে। কষ্ট করে লেখাপড়া করে সে এবার ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থেকে সব বিষয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে। রাখি ব্রাক্ষণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার দেওড়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিল। রাখি ছোটবেলা থেকেই ভালো ফলাফল করে আসছে। সে প্রাথমিক সমাপনী ও জেএসসি পরীক্ষায়ও মেধাবৃত্তি পায়। তবে বাবার টাকা না থাকায় কলেজে ভর্তি হতে পারবে না বলে আশঙ্কা হচ্ছে তার।
অভাবজয়ী রুবেল রানা: রুবেল রানার বাবা জামাল উদ্দিন দিনমজুর। দুই বছর ধরে তিনি কিডনির সমস্যায় ভুগছেন। তাই অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় সংসারের খরচ জোগাড় করার জন্য কখনো দিনমজুরি আবার কখনো কৃষি কাজ করতে হয়েছে তাকে। এবারের এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের দিনও একজনের বাড়িতে নলকূপ স্থাপনের কাজ করছিল সে। ওই দিন তার বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক তাকে আনন্দের খবর জানান। সে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে। শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার উত্তর নাঁকশী উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল। রুবেলদের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, ছোট একটি টিনের ঘরে তারা বাস করে। ঘরের বেড়া ভাঙা।
পোশাকে পুঁতি লাগানোর কাজ করত ইয়াসমিন: ইয়াসমিনদের বাড়ি পাবনার চাটমোহর উপজেলার মূলগ্রাম ইউনিয়নের মহরমখালী গ্রামে। বাবা ইসমাইল হোসেন দরিদ্র কৃষক। নিজের কোনো জমি নেই। অন্যের জমি চাষ করেন। যা আয় হয় তাতে সংসার চলে না। তাই বাবাকে সহায়তা ও নিজের পড়ালেখার খরচ চালাতে পোশাকে জরি ও পুঁতি লাগানোর কাজ করত ইয়াসমিন আক্তার। যা আয় হতো তার কিছু তুলে দিত বাবার হাতে। সে এবার উপজেলার মূলগ্রাম ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মানবিক বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে।
লড়াকু আলমগীর কবীর: সংসারে অভাব ছিল প্রকট। তাই সপ্তম শ্রেণিতে থাকা অবস্থায়ই খুব ভোরে কাজের সন্ধানে ছুটতে হয়েছে আলমগীর কবীরকে। মানুষের জমির ফসল এবং মাটি কাটাসহ সব ধরনের কাজই করেছে। এ জন্য নিয়মিত বিদ্যালয়ে যেতে পারেনি। এত কাজের মধ্যে পড়াশোনা করার কথা ভোলেনি সে। সারা দিন মাঠে কাজ করায় তাকে রাত জেগে পড়াশোনা করতে হয়েছে। সে এবার ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলার বন্দিয়ারা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে সব বিষয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে। এত ভালো ফলাফল করার পরও কলেজে ভর্তি হওয়া নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছে সে। কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য সে এখনো দিনমজুরি করছে।
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন বদর উদ্দিন, সরাইল (ব্রাহ্মণবাড়িয়া); আবদুল মান্নান, নালিতাবাড়ী (শেরপুর); সরোয়ার মোর্শেদ, পাবনা; কাজী নুরুল ইসলাম, পীরগঞ্জ (ঠাকুরগাঁও) প্রতিনিধি]