শখের শিকারি এখন বন্য প্রাণীর বন্ধু

লোকালয়ে মানুষের হাতে ধরা পড়ে বা নির্মমভাবে মানুষ কর্তৃক আঘাত পাওয়া, অ্যাসিডে ঝলসানো, বৈদ্যুতিক তারে জড়িয়ে যাওয়া, দ্রুতগামী পরিবহনের চাকায় পিষ্ট হয়ে মরণাপন্ন অথবা অন্য কোনো দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত বন্য প্রাণীদের প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র দেশে খুব বেশি নেই। কিন্তু শ্রীমঙ্গলের বন্য প্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনের নাম ইতিমধ্যে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এই ফাউন্ডেশন শুধু প্রাণীদের চিকিৎসাই করে না, সুস্থ হয়ে ওঠা প্রাণীগুলো তাদের আবাসস্থলে ফিরিয়ে দিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এ ছাড়া বন্য প্রাণী হত্যা, পাচার ও বন্য প্রাণীদের প্রতি মানুষের বিরূপ আচরণ বন্ধে সচেতনতামূলক কর্মসূচি নিয়ে থাকে। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে বৃক্ষরোপণ এবং বন্য প্রাণীর নিরাপদ আবাসস্থল বজায় রাখতে সামাজিক আন্দোলন অংশগ্রহণ করে থাকে এ সংগঠন। বন্য প্রাণীদের ভালোবেসে ও বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীদের অস্তিত্ব রক্ষায় তিলে তিলে যিনি এই সেবাকেন্দ্র গড়ে তুলেছেন, তিনি হলেন সিতেশ রঞ্জন দেব।
শ্রীমঙ্গলসহ সারা দেশের মানুষের কাছে তিনি সিতেশ বাবু হিসেবেই বেশি পরিচিত। বন্য প্রাণীদের প্রতি তাঁর অগাধ ভালোবাসা। বন্য প্রাণীরাই তাঁর ধ্যানজ্ঞান। দিনরাত বন্য প্রাণীদের নিয়েই তাঁর বসবাস।
সিতেশ রঞ্জন দেবের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রয়াত বাবার সঙ্গে কিশোর বয়স থেকেই পশুপাখিদের লালন-পালনের কাজ শুরু করেন। বাবার সঙ্গে শিকারেও যেতেন তিনি। তখন পশুপাখি শিকারে বিধিনিষেধ ছিল না। থাকলেও কড়াকড়ি ছিল না। ১৯৮৬ সালে তাঁর বাবা শিরীষ রঞ্জন দেব মারা যাওয়ার পর তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে সিতেশ রঞ্জন দেবও শখের শিকারি ওঠেন। তবে তাঁর শিকারিজীবন বেশি দিনের নয়। শিকারি থেকে তিনি হয়ে ওঠেন বন্য প্রাণীর রক্ষক।
বিভিন্ন জায়গা থেকে উদ্ধার করা আহত প্রাণীদের সুস্থ করে তুলতে শ্রীমঙ্গল শহরের মিশন রোডের বাড়ির আঙিনায় গড়ে তোলেন একটি মিনি চিড়িয়াখানা। পরে পশ্চিম ভাড়াউড়া এলাকায় অবস্থিত বাগানবাড়িতে এটিকে স্থানান্তর করেন। সরকারের বন্য প্রাণী আইনানুযায়ী এটিকে রূপান্তর করেন বাংলাদেশ বন্য প্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনে।
সিতেশ দেবের ছোট ছেলে সঞ্জিত দেব বলেন, ‘বন্য প্রাণীর জন্য বাবার (সিতেশ রঞ্জন দেব) অগাধ ভালোবাসা। কখনো কোনো প্রাণীর আহত হওয়ার খবর পেলেই তিনি ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। সারাক্ষণই প্রাণীর কথা ভাবেন তিনি। বাবার সঙ্গে আমরা দুই ভাই এই সেবা ফাউন্ডেশনে কাজ করলেও সবকিছুই বাবা করে থাকেন। এখানে অনেক প্রাণীই সুস্থ হয়ে বনে ফিরে গেছে, যাদের বেঁচে থাকার আশাই ছিল না।’
সঞ্জিত দেব বলেন, ‘অ্যাসিডে পুরো মুখ ঝলসে যাওয়া বানর, তিন পায়ের হরিণ, বৈদ্যুতিক তারে জড়ানো শকুন, লোকালয়ে এসে মানুষের দায়ের কোপে আহত অজগরসহ অসংখ্য প্রাণী সুস্থ হয়ে ফিরেছে বনে। শুধু আমাদের অঞ্চলের প্রাণীই নয়, ২০১৬ সালে ঝড়ের কবলে পড়ে মৃতপ্রায় একটি গাঙচিল দিনাজপুর থেকে আমাদের এখানে আনা হয়। এই গাঙচিল এখন সম্পূর্ণ সুস্থ।’
বাংলাদেশ বন্য প্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সিতেশ রঞ্জন দেব প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে তো বন্য প্রাণীদের থেকে নিজেকে রক্ষা করতেই মানুষ শিকার করত। বন্য প্রাণীদের মারত। আমিও শখের বশে একসময় শিকার করেছি। সরকার বন্য প্রাণী আইন করার পর থেকে আমি আইন অমান্য করিনি। এখন প্রাণী সংরক্ষণে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। বন্য প্রাণী রক্ষা করতে হবে আগামী প্রজন্মের জন্য।’
সিতেশ রঞ্জন দেব আরও বলেন, ‘বর্তমানে বন্য প্রাণীদের আবাসস্থল তাদের অনুকূলে নেই। এদের আবাসন, খাধ্যসংকট রয়েছে। তাই প্রায়ই তারা বন ছেড়ে লোকালয়ে চলে আসে। মানুষের বাসাবাড়িতে বন্য প্রাণী এলে মানুষ স্বাভাবিকই তাদের ওপর আক্রমণ করবে। আমরা খবর পেলে এসব প্রাণীকে উদ্ধার করে নিয়ে আসি। তাদের সেবা করে, সুস্থ করে আবার তাদের পরিবেশ ছেড়ে দিই।’
সিতেশ রঞ্জন দেব সম্পর্কে জানতে চাইলে ওয়াইল্ড লাইফ ক্রাইম কন্ট্রোল ইউনিটের পরিচালক (সাবেক সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা) মিহির কুমার দে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি সিলেট বন বিভাগে কর্মরত অবস্থায় সিতেশ রঞ্জন দেবের কাছ থেকে অনেক সহযোগিতা পেয়েছি। বন্য প্রাণী রক্ষায় তাঁর ভূমিকা অতুলনীয়।’