শত বছর পর ‌‘মুল্লুক চলো’ সুলুক সন্ধান

চা–পাতা তোলার পর মাপা হচ্ছে। ভাড়াউড়া চা–বাগান, শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজারছবি: শিমুল তরফদার

‘সর্দার-চৌকিদারেরা বলল, ‌‘তবে তোরা কী করবি?’
‌‘দেশে চলে যাব। এখানে আর থাকব না।’
‌‘কোম্পানি তোদের বেঁধে রাখবে।’
‌‘অসম্ভব। বাঁধন আমরা ছিঁড়ব।’
‘কোম্পানি পুলিশ ডাকবে।’
‘পুলিশের আমরা থোড়াই কেয়ার করি।’
‘তবে সাহেবের কথা তোরা মানবি নে।’
‌‘না, না, না। আমরা দেশে যাব।’
এ কথোপকথন চা-শ্রমিকদের সঙ্গে বাগানের এক সরদারের। প্রেক্ষাপট, চা-বাগানে শ্রমিক নিগ্রহ আর এর ফলে সৃষ্ট অসন্তোষ। সময়, এখন থেকে শত বছর আগে। সিলেটের লেখক অজয় ভট্টাচার্যের উপন্যাস ‌‘কুলি-মেম’-এ এর উল্লেখ পাই। এ বই প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭০ সালে। তাই এই কথোপকথন হয়তো কল্পিত। কিন্তু বাস্তব ঘটনার প্রেক্ষাপটেই এ উপন্যাস গড়ে উঠেছে। সেটা ১৯২১ সাল। তখন অখণ্ড ভারতবর্ষ। ব্রিটিশ উপনিবেশ ভারতে তখন চা-চাষের বয়স প্রায় ৭০ বছর। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা অর্থাৎ আসাম আর সুরমা উপত্যকা অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশের সিলেটের চা-বাগানগুলোতে তখন শ্রমিকদের তীব্র অসন্তোষ চলছে। চৌকিদার যেমন বলছে, ‌‘কোম্পানি তোদের বেঁধে রাখবে’, ঠিক তেমনি করে পশুর মতো বেঁধে রাখা হতো চা-শ্রমিকদের। কিন্তু সেই অন্যায় আর সহ্য হয় না। চৌকিদারদের চোখ রাঙানি, পুলিশের ভয়, ব্রিটিশ সাহেবের চাবুক—সব তাঁরা অগ্রাহ্য করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। শ্রমিকেরা তাঁদের জন্মস্থানে বা ‌‘মুল্লুকে’ চলে যাবেন, যখন থেকে তাঁদের লোভ দেখিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল। বেঁধে ফেলা হয়েছিল চা-বাগানের বন্দিশালায় কাজ করতে। এর বিনিময়ে শ্রমিকেরা পেয়েছেন লাঞ্ছনা, নির্যাতন, নিপীড়ন। এবার তাঁরা মুল্লুকে যাবেনই। সে বছরেরই ২০ মে, আজ থেকে ঠিক ১০০ বছর আগে, চা-শ্রমিকদের সেই ‌‘মুল্লুক চলো’ আন্দোলন ব্রিটিশ রাজের সেপাইয়ের গুলি আর বেয়নেট চার্জে স্তিমিত হয়ে যায়। বাংলাদেশের এখনকার চাঁদপুর জেলার মূল হেড বড় স্টেশনসংলগ্ন এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।

বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের প্রধান উপদেষ্টা ও শ্রমিকনেতা তপন দত্ত বলছিলেন, ‌‘এক অসংগঠিত অথচ স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন ছিল ‌“মুল্লুক চলো” আন্দোলন। আসাম ও সিলেটের হাজার হাজার শ্রমিক এতে শামিল হন। চাঁদপুর ঘাটে স্টিমারে উঠতে যাওয়ার জন্য অপেক্ষমাণ শ্রমিকদের ওপর হামলা হয়। এতে ঘটনাস্থলেই কয়েক শ শ্রমিক নিহত হন। আহত হন এক হাজারের বেশি।’

এ হত্যার কোনো বিচার সেদিন হয়নি। ঔপনিবেশিক সরকারের বিরুদ্ধে দরিদ্র, অসহায় চা-শ্রমিকদের এই দ্রোহের ঘটনা অনেকটাই অগোচরে রয়ে গেছে। তবে চা-শ্রমিকেরা পূর্বপুরুষদের রক্তে মাখা এ দিনটিকে ‌‘চা-শ্রমিক দিবস’ হিসেবে পালন করেন। করছেন এবারও।

চা-শ্রমিক, ঐতিহাসিক প্রতারণার শিকার এক জনগোষ্ঠী
‘মনে করি আসাম যাবো
আসাম গেলে তোমায় পাবো
বাবু বলে কাম কাম, সাহেব বলে ধরে আন
আর ওই সর্দার বলে লিবো পিঠের চাম
হে যদুরাম, ফাঁকি দিয়া চলাইলি আসাম।’

ভারতের আসামের গোয়ালপাড়া অঞ্চলের একটি জনপ্রিয় লোকগীতি এটি। এই গানের মাধ্যমে চা-বাগানের শ্রমিকদের শোষণের কথা তুলে ধরা হয়েছে। ইংরেজদের শ্রমিকদের প্রতি শোষণ ও অত্যাচারের কথা এই গানের মধ্যে ফুটে উঠেছে। এ গানে এক প্রতারণার কথা, নিপীড়নের কথা।

আসামে চা-চাষের গোড়াপত্তন হয় ১৮৩৯ সালে। ব্রিটিশ কোম্পানিগুলোই এর উদ্যোক্তা ছিল। বাংলাদেশের চট্টগ্রামে প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে চা-বাগান স্থাপিত হয় ১৮৪০ সালে। তবে ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনীছড়া বাগানে বাণিজ্যিকভাবে প্রথম চা-বাগান প্রতিষ্ঠা করা হয়।

জঙ্গল পরিষ্কার করেই শুরু হয়েছিল চা-বাগান স্থাপন। এ কাজ কঠিন। স্থানীয়রা এ কাজ করতে চাইত না। তাই বিহার, মাদ্রাজ, ওডিশা, মধ্যপ্রদেশের স্থানীয় নৃগোষ্ঠী ও দলিত সম্প্রদায়ের মানুষকে বাগানের ব্রিটিশ কোম্পানিগুলো শ্রমিক হিসেবে নিয়ে আসে। বিভিন্ন লেখায় চা-শ্রমিকদের বেদনাদায়ক অভিবাসন যাত্রার প্রমাণ মেলে। ব্রিটিশ লেখক ড্যান জোনসের ‌‘টি অ্যান্ড জাস্টিস’ বইয়ে পাই, ‌‘ক্লান্তিকর যাত্রা এবং কঠিন কাজ ও খারাপ কর্মপরিবেশের কারণে শ্রমিকদের এক-তৃতীয়াংশের মৃত্যু হয়। বাগানে আসার পর এসব শ্রমিকের পরিচয় হয় কুলি আর তারা কোম্পানিগুলোর সম্পত্তিতে পরিণত হয়।’

হতদরিদ্র, অসহায় এসব শ্রমিককে এই বলে বাগানে নিয়ে আসা হয় যে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হবে ‌‘পাহাড়ঘেরা একটা দেশের চমৎকার বাগানে। সেই বাগানের গাছের পাতা খাঁটি সোনার। কেউ সে গাছে ঝাঁকুনি দিলে ঝরবে সোনার পাতা।’

শ্রীমঙ্গলের ভাড়াউড়া চা বাগান
ছবি: শিমুল তরফদার

কিন্তু যদুরামের মতো শ্রমিকদের সোনার পাতা আর পাওয়া হয়নি। প্রাচীন দাসপ্রথার আদলে সবুজে ঘেরা চা-বাগানের লেবার লাইনে (চা-শ্রমিকদের থাকার জায়গা) বন্দী করে ফেলা হয় তাঁদের। বাগান কর্তৃপক্ষ স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে শ্রমিকদের নিয়ে গিয়ে তাঁদের শ্রমদাস করে ফেলার জন্য একটি চুক্তি বা অ্যাগ্রিমেন্ট করে। চা-বাগানের অশিক্ষিত শ্রমিকের কাছে তা বহুল প্রচলিত ‌‘গিরমিন্ট’। আর অর্থনৈতিকভাবে এমন নিগড়ে ফেলা হয় যেন শ্রমিকেরা বাগানের বাইরে কিছু না করতে পারেন।

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রামভজন কৈরী বলেন, প্রতিটি বাগানের জন্য আলাদা প্রতীকী মুদ্রা ছিল। বাগানের বাইরে এগুলোর কোনো মূল্য ছিল না। এসব মুদ্রায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনতেন চা-শ্রমিকেরা। অর্থাৎ বাগানে বেঁধে রাখার সমস্ত আয়োজন ছিল।

এ মুদ্রার কিছু নমুনা বাগান-শ্রমিকদের কাছে এখনো আছে। সেই সময় শ্রমদাস হিসেবে চা-শ্রমিকদের ওপর চলত অকথ্য নির্যাতন।

১৯১১ সালে আসামের সরকার সে অঞ্চলের প্রধান বাগানগুলোর শ্রমিকদের অবস্থা নিয়ে একটি প্রতিবেদন দেয়। সেখানে বলা হয়, ‌‘বাগান কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের সঙ্গে মধ্যযুগীয় ভূমিদাসদের মতো আচরণ করে।’

মুল্লুক ছাড়ো আন্দোলনের ইতিবৃত্ত

চা-শ্রমিকেরা কিন্তু মুখ বুজে এসব নির্যাতন সব সময় মেনে নেননি। দিন গেছে, নির্যাতনের পরিমাণ বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে শ্রমিকের অসন্তোষ। আসাম ও সিলেট অঞ্চলে এসব মানুষকে আনার পর থেকেই ঐতিহাসিক স্বপ্নভঙ্গের কষ্ট তাঁদের পেয়ে বসে। শ্রমিকেরা বিদ্রোহ করতে থাকেন।

‘প্ল্যান্টেশন লেবার ইন ইন্ডিয়া’ নামে রজনীকান্ত দাসের লেখা বইয়ে বলা হয়েছে, ‘ইউরোপীয় অফিসারদের লাথি, ঘুষি এবং কুলিদের ওপর নানারূপ দৈহিক নির্যাতন প্রায়ই বাগানগুলিতে সংঘর্ষের অবস্থা তৈরি করত। ১৮৯১ সালে আসামের চা-বাগানে ১০৬টি দাঙ্গাহাঙ্গামার ঘটনা ঘটে।’

এভাবে প্রতিবাদ দিনের পর দিন চলতে থাকে। গত শতকের ১০২১ সালে এর বড় বিস্ফোরণ ঘটে। শ্রমিকেরা তাঁদের জন্মস্থানে ফিরতে চান। দুই উপত্যকার বাগানে ছড়িয়ে পড়ে এর স্ফুলিঙ্গ। এর সর্বশেষ কারণ হিসেবে চা-শ্রমিকদের মজুরি কমানোর ঘটনা মুখ্য ছিল।

দেওয়ান চমনলাল ‘কুলি: দ্য স্টোরি অব লেবার অ্যান্ড ক্যাপিটাল ইন ইন্ডিয়া’ বইতে লিখেছেন, ‘প্রথম মহাযুদ্ধের সময় চা-শিল্পের মালিকেরা প্রচণ্ড মুনাফা অর্জন করে। এদের মুনাফার অঙ্ক বহুক্ষেত্রেই ৪৫০ শতাংশে গিয়ে পৌঁছায়। মালিকেরা যখন এই হারে মুনাফা অর্জন করল, তখন শ্রমিকদের বেতন এক আনাও বৃদ্ধি করেনি। কিন্তু যুদ্ধের পর যখন বাজার মন্দা হলো, শ্রমিকের মজুরি হ্রাস করে দৈনিক তিন পয়সা হিসেবে ধার্য করা হলো। তিন আনা আয় করেও তাদের সংসার চলেনি। উপরন্তু তারা স্ত্রী, পুরুষ, শিশুনির্বিশেষে মালিকদের কাছে থেকে পেয়েছে বেত্রাঘাত এবং অকথ্য নির্যাতন, তাই দেশে প্রত্যাবর্তনই তারা সিদ্ধান্ত করল।’

কিন্তু চা-বাগানের মালিকেরা তা মানবেন কেন। তাই তাঁরা নিপীড়নের পথ ধরলেন। সুকোমল সেনের লেখা ‌‘ভারতের শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস (১৮৩০-২০১০)’ বইতে উঠে এসেছে সেই মুল্লুক ছাড়ো আন্দোলনের ইতিবৃত্ত। তিনি লিখেছেন, করিমগঞ্জ (আসাম) রেলওয়ের ইউরোপীয় অফিসারের নির্দেশ ছিল যে কুলিদের রেলের টিকিট দেওয়া হবে না। কুলিরা তখন পায়ে হেঁটেই মুল্লুকের দিকে যাত্রা শুরু করলেন। সেই সময় কলকাতার মেয়র জে এম সেনগুপ্তর হস্তক্ষেপের ফলে টিকিট বিক্রি শুরু হলো।
আসামের এসব শ্রমিক সিলেট হয়ে চাঁদপুরের মেঘনা ঘাটের দিকে যেতে থাকেন। তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন সিলেটের বিভিন্ন বাগানের শ্রমিকেরা। তাঁদের লক্ষ্য ছিল, মেঘনা ঘাটে স্টিমারে চেপে তাঁরা গোয়ালন্দ যাবেন। সেখান থেকে ট্রেনে চেপে নিজ নিজ জন্মস্থানে পাড়ি জমাবেন। কিন্তু ২০ মে এক ভয়ংকর অভিজ্ঞা হলো মুল্লুক ফেরার জন্য উদগ্রীব মানুষগুলোর।

চাঁদপুর শহরের বড় স্টেশন মূল হেড। এখানেই ১৯২১ সালের ২০ মে চা আন্দোলনরত চা শ্রমিকদের নির্যাতন করা হয়
ছবি: আলম পলাশ

সুকোমল সেন সে ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন।

‌‘বস্তুত এটি ছিল একটি পাশবিক ষড়যন্ত্র। ২০ মে, ১৯২১ রাত্রে কুলিদের চাঁদপুর স্টেশন থেকে যাত্রা করার কথা ছিল। এদিকে কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যাপকসংখ্যক সশস্ত্র পুলিশ আমদানি করে স্টেশন ছেয়ে ফেলল। তারপর রাত্রে ৩০০০ কুলি যখন প্ল্যাটফর্মে নিদ্রামগ্ন ছিল, তখন ডিভিশনাল কমিশনারের আদেশে গোর্খা সৈন্যরা উন্মুক্ত বেয়নেট নিয়ে স্ত্রী, পুরুষ, শিশুনির্বিশেষে নিদ্রিত কুলিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। মাতৃক্রোড়ে শিশু থেকে শুরু করে স্ত্রী, পুরুষ, বৃদ্ধ কাউকেই বেয়নেটের আঘাত থেকে রেহাই দেওয়া হলো না। অনেককে নদীতে নিক্ষেপ করে হত্যা করা হয়েছিল।’

ঠিক কতজন শ্রমিক সেদিন নিহত হয়েছিলেন, এর কোনো হিসাব সুনির্দিষ্টভাবে কেউ বলতে পারে না। চাঁদপুর জেলা প্রশাসনের কাছেও এর কোনো নথি নেই। তবে ওই ঘটনার ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। শ্রমিকদের ওপর এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ আসাম ও বাংলার রেলওয়ে শ্রমিকেরা ১০ দিনের ধর্মঘট পালন করেন।

চাঁদপুরে এখন কী আছে

চাঁদপুর পৌরসভার মূল হেড বড় স্টেশন এলাকাটি শত বছর ধরে চা-শ্রমিকদের ওপর নিপীড়নের সাক্ষ্য বহন করছে। চা-শ্রমিকদের অনেকেই ওই জায়গায় মাঝেমধ্যে যান। পূর্বপুরুষের নির্মম অভিজ্ঞতার স্থান দর্শন করেন। কিন্তু চা-শ্রমিকদের সেই আন্দোলনের কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই। জেলা প্রশাসনের কাছে সেই ঘটনার নথিও নেই। ২০১৬ সালে জেলা প্রশাসনের প্রকাশ করা ‘চাঁদপুর পরিক্রমা: ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ বইতে এ ঘটনার কোনো উল্লেখ নেই।

চাঁদপুর ১৯২১ সালে ত্রিপুরার অংশ ছিল। চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খানমজলিস গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমন ঘটনার কথা আমার জানা নেই। শত বছর আগের এ-সংক্রান্ত কোনো নথিও নেই। সাধারণত “ক” শ্রেণিভুক্ত নথি বা আইনকানুন সংরক্ষণ করা হয়। তাই এ ঘটনার কোনো দালিলিক প্রমাণ নেই।’

চা-শ্রমিকদের দাবি, চাঁদপুরের ঐতিহাসিক এই স্থানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হোক। এ দাবির ব্যাপারে জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খানমজলিস বলেন, ‘এমন একটি ঐতিহাসিক ঘটনার নিশ্চয়ই তাৎপর্য রয়েছে। এ বিষয়ে খোঁজ নেব। আর তাঁদের দাবির প্রতি অবশ্যই শ্রদ্ধা জানানো হবে।’

শুধু চা-শ্রমিকেরা নন, চাঁদপুরের অনেকেই চান ঐতিহাসিক সেই ঘটনার কোনো স্মৃতিচিহ্ন থাকুক। তাঁদের একজন দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক কাজী শাহাদাত। তিনি বলছিলেন, এমন একটি বিয়োগান্ত ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ভুলে যাওয়া একটা অপরাধ। এখন এ ঘটনাকে স্মরণ করা উচিত।

কাজী শাহাদাতের সঙ্গে একমত পৌর মেয়র জিল্লুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই ঘটনাকে প্রায় সবাই ভুলে গেছে। এটাকে স্মরণ ও শ্রদ্ধা জানানো আমাদের কর্তব্য। এই ঘটনাকে যেন স্মরণে রাখা যায়, সেই ব্যবস্থা পৌরসভার পক্ষ থেকে করব।’

চাঁদপুর পৌর এলাকার বড় স্টেশন মূল হেড এলাকা
ছবি: আলম পলাশ

চা-শিল্প ও এর শ্রমিক

ঔপনিবেশিক শক্তির হাত ধরে এ অঞ্চলে চা-শিল্প এসেছিল। এখন এটি দেশের গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক খাত। এক শতকে বাগানে উপনিবেশ আমলের সেই পরিবেশ পাল্টেছে। বাংলাদেশে প্রতি দশকে বেড়েছে চায়ের উৎপাদন। বাংলাদেশ টি বোর্ডের হিসাব বলছে, স্বাধীনতার পর দেশের চায়ের উৎপাদন ছিল ২ কোটি ৩০ লাখ কেজি। ২০২০ সালে দেশের ১৬৭টি চা-বাগান থেকে উৎপাদিত হয়েছে ৮ কোটি ৬৩ লাখ কেজি চা। দেশে চা-শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় সোয়া লাখ। এ বছর থেকে তাঁদের দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা করে নির্ধারণ করা হয়েছে। চা-শ্রমিকদের দাবি, এই মজুরি অন্তত ৩০০ টাকা করা হোক। মজুরির পাশাপাশি একজন শ্রমিক সপ্তাহে ৩ কেজি ২৭০ গ্রাম চাল বা আটা পান। শ্রমিকের অনূর্ধ্ব ১২ বছর বয়সী দুই সন্তানও নির্দিষ্ট পরিমাণে চাল বা আটা পায়।

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রামভজন কৈরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেই মুল্লুক ছাড়ো আন্দোলন হয়েছিল বাগান ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য। কিন্তু এখন অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। এখন শ্রমিকেরা বাগানে থাকতে চায়। কিন্তু শ্রম আইনের ৩২ ধারা অনুযায়ী, একজন শ্রমিক চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর বাগান ছেড়ে যেতে বাধ্য থাকে।’

চা-বাগানগুলো পরিচালিত হয় সরকারের কাছ থেকে লিজ নেওয়া জমিতে। এখানে প্রজন্মান্তরে বসবাস করলেও চা-শ্রমিকদের সেই জমিতে কোনো অধিকার নেই। এর অধিকার দাবি করেন শ্রমিকেরা। চা জীবনমানের উন্নয়ন।

বাংলাদেশের কোনো রাষ্ট্রীয় দলিলে প্রথমবারের মতো চা-শ্রমিকদের কথা উঠে আসে ২০০৪ সালে দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্রে (পিআরএসপি)। এটি তৈরি করেছিলেন অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি মনে করেন, অর্থনীতির উন্নয়নের তাগিদেই চা-শ্রমিকের জীবনমানের উন্নয়নের দিকে নজর দেওয়া উচিত। গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর বলেন, চা-বাগানকে ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। সেই পরিস্থিতির অনেকটা উন্নয়ন হয়েছে। শ্রমিকের মজুরি, আবাসন—সবকিছুকেই বিবেচনায় নিতে হবে। এতে আখেরে এ শিল্পেরই লাভ। আবার যেসব বাগান কর্তৃপক্ষ সমস্যায় আছে, তাদের সহায়তার কথাও সরকারকে ভাবতে হবে।

শত বছর পর কিংবদন্তির পূর্বপুরুষকে স্মরণ

চা-শ্রমিকের সন্তানেরা কিন্তু পূর্বপুরুষের রক্তমাখা ইতিহাসের দিনটিতে ভোলেননি। আজ করোনাবিধি মেনে চা শ্রমিক ইউনিয়নসহ বিভিন্ন সংগঠন নানা আয়োজনে দিনটি পালন করছে। মৌলভীবাজারের শমশেরনগর চা-বাগানের প্রাথমিক স্কুল প্রাঙ্গণে চা-শ্রমিকদের সন্তানেরা শহীদদের স্মরণ করছে নানা আয়োজনে। এর উদ্যোক্তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা চা-শ্রমিকের সন্তান মোহন রবিদাস।

দাবিগুলোর মধ্যে আছে চা-শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৫০০ টাকা, জাতীয় বাজেটে চা-শ্রমিকদের জন্য পৃথক বরাদ্দ, বাগানে শিক্ষা ও চিকিৎসার সুব্যবস্থা, ভূমি অধিকার নিশ্চিত করাসহ নানা দাবি।

মোহন রবিদাস শত বছর আগের দিনটিকে স্মরণ করতে কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর ‌‘আমি কিংবদন্তির কথা বলছি’ কবিতাটি স্মরণ করেন। মোহন বলেন, পূর্বপুরুষের পিঠে রক্তজবার সেই ক্ষত আজও আমরা বহন করছি। আমরা চাই রাষ্ট্র মানবিক হোক। চা-শ্রমিকদের শোভন জীবন নিশ্চিত হোক।