শততম জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি

অধ্যাপক কবীর চৌধুরী

আজ ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২ আমাদের কালের এক প্রাতঃস্মরণীয় মনীষী বিবেকী কণ্ঠস্বর জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর শততম জন্মদিন। ১৯২৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি তিনি জন্মেছিলেন বাবার তৎকালীন কর্মস্থল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। তাঁর বাবা খান বাহাদুর আবদুল হালিম চৌধুরী ছিলেন পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা।

আশা করি, আগামী বছর কবীর চৌধুরীর জন্মশতবার্ষিকী যথাযোগ্য মর্যাদায় জাতীয়ভাবে পালিত হবে। ৮৮ বছর বয়সে ২০১১ সালের ১৩ ডিসেম্বর ঘুমের মধ্যেই তিনি এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যান।

ছাত্র হিসেবে কবীর চৌধুরী ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। ১৯৪০ সালে আইএ পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান অধিকার করেন। ১৯৪৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে বিএ অনার্স এবং পরের বছর এমএ পাস করেন। দুটো পরীক্ষাতেই তিনি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। ইংরেজিতে অনার্সে বহু বছর ধরে বুদ্ধদেব বসু ছাড়া আর কেউ পরীক্ষায় এত বেশি নম্বর পাননি। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে তিনি যে কেবল লেখাপড়ার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ছিলেন তা নয়, ফুটবল, ক্রিকেট, হকি ও টেনিস খেলাতেও ছিলেন সমান পারদর্শী।

কর্মজীবনে কবীর চৌধুরীর কর্তব্যনিষ্ঠা ও সততা অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, বিভিন্ন সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ, শিক্ষাসচিব, শিক্ষা কমিশনের প্রধান—যখন যেখানে দায়িত্ব পালন করেছেন, সব জায়গাতেই সাফল্যের চিহ্ন রেখে গেছেন।

একটি সংবাদপত্রে সাক্ষাৎকারে ২০০৫ সালে কবীর চৌধুরী বলেছিলেন, ‘চিরবিদায়ের ক্ষণ উপস্থিত হলে আমিও হাসিমুখে বিদায় নিতে চাই। আর মৃত্যুর পর আমি চাই না যে কোনোরকম পাকা সমাধি হোক, শিলালিপি লেখা হোক, নামধাম, জন্ম-মৃত্যুর তারিখ ইত্যাদি কোথাও উৎকীর্ণ হোক। এসবের কোনো দরকার নেই। আমি এসব চাই না। আমাকে যদি মানুষ স্মরণ করতে চায়, মনে রাখতে চায়, তাহলে অনেকভাবেই তা করতে পারবে। আমার শিক্ষকতার কথা তারা স্মরণ করতে পারবে, আমার রচিত বই-পুঁথির কথা তারা স্মরণ করতে পারবে, আমার মৌলবাদবিরোধী ভূমিকার কথা, আমাদের সুশীল সমাজকে অধিকতর শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে আমার প্রয়াসের কথা স্মরণ করতে পারবে। এসবের মধ্য দিয়েই আমার স্মৃতি বেঁচে থাকবে। যদি কেউ বাঁচিয়ে রাখতে চায়। সে জন্যই আমি পাবলিক গ্রেভইয়ার্ডে সমাধিস্থ হতে চাই, সরকারি গোরস্থানে শেষশয্যা পাততে চাই। সেখানে বছর তিনেক পর নতুন কবর হবে আমার কবরের ওপর।’

বিশ্বসাহিত্য ও চিত্রকলার সঙ্গে কবীর চৌধুরী আমাদের পরিচিত করিয়েছিলেন। তাঁর মতো এত অনুবাদ আমাদের দেশে আর কেউ করেননি। গল্প, উপন্যাস, নাটক, কবিতা, চিত্রকলা—সব ধরনের বিষয়ই তাঁর অনুবাদে স্থান পেয়েছে। বাংলাদেশের সাহিত্যেরও প্রচুর অনুবাদ করেছেন তিনি। তাঁর বাংলা থেকে ইংরেজি অনুবাদগ্রন্থের সংখ্যা অর্ধশতাধিক। নিরলসভাবে চিন্তাশীল প্রবন্ধ রচনা করে গেছেন আমৃত্যু।

বাংলাদেশের প্রতিবাদী নাগরিক আন্দোলনে কবীর চৌধুরীর নেতৃত্ব আমাদের সাহসী করেছে, অনুপ্রাণিত করেছে। মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান ছিল আপসহীন। ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে তাঁর যুক্তিপূর্ণ বক্তব্যের কারণে মৌলবাদীরা তাঁকে ‘মুরতাদ’ হিসেবেও আখ্যায়িত করেছিল। কিন্তু তিনি ছিলেন সব ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টাতে কবীর চৌধুরী ছিলেন বাংলা একাডেমির প্রধান। প্রচণ্ড সাহসের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে নানাভাবে সহায়তা করেছেন গোপনে। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের শেষের দিকে একদিন তিনি আমাকে সঙ্গে নিয়ে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার বাড়ি গিয়ে তাঁকে বললেন, ‘আমার মনে হয় এখন আমরা নাগরিক সমাজের প্রবীণ ব্যক্তিরা মিছিল করে রাস্তায় পুলিশের গুলির সামনে বুক পেতে দেব। আমার অনেক বয়স হয়েছে, আমি থাকব মিছিলের অগ্রভাগে। এভাবে চূড়ান্ত প্রতিবাদ করতে হবে।’ শেখ হাসিনা তাঁকে বুঝিয়ে বললেন, ‘এখনো সে পর্যায়ের প্রতিবাদের সময় আসেনি। রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে আপনাদের সঙ্গে নিয়ে আমরা স্বৈরাচারী শক্তির পতন ঘটাব।’ অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর এই প্রস্তাব কোনো কথার কথা ছিল না। তিনি মানুষের মুক্তির জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করতে চেয়েছিলেন।

কবীর চৌধুরী মানুষের ভালোবাসা পেয়েছিলেন অফুরন্ত। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছিলেন স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারসহ দেশে-বিদেশে নানা পুরস্কার-সম্মাননা। ব্রত হয়েছিলেন জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে, আমৃত্যু ছিলেন বাংলা একাডেমির সভাপতি।

লোভ কোনো দিন কবীর চৌধুরীকে স্পর্শ করেনি। গুলশানে বাড়ি বিক্রি করে অনেক টাকা পেয়েছিলেন। তিন মেয়ের জন্য তিনটি ফ্ল্যাট কিনে এবং নিজেদের চিকিৎসার জন্য কিছু টাকা রেখে বাকি প্রায় এক কোটি টাকা বাংলা একাডেমি, থিয়েটার স্কুল, বারডেম, অ্যাসিড সারভাইভার্স ফাউন্ডেশন, আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের মতো প্রতিষ্ঠানকে দান করে দেন। বলেছিলেন, ‘ইনফ্লেশনের কারণে এত টাকা পেয়েছি, এটা তো আমি অর্জন করিনি।’ এমনই ছিল তাঁর ঔদার্য।

শততম জন্মদিনে কবীর চৌধুরীর জীবন ও কর্মকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা প্রয়োজন। কারণ, আমাদের সমাজে অনুসরণ করার মতো মানুষ খুবই নগণ্য। তাঁর কোনো গুণ যদি আমরা নিজেদের মধ্যে ধারণ করতে পারি, তবে আমরা প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠব।

আজ কবীর চৌধুরী আমাদের মধ্যে নেই, কিন্তু তিনি চিরঞ্জীব।