শতবর্ষী খেলা 'হুমঘুঁটি'

পৌষসংক্রান্তির দিন বিকেল থেকে শুরু হয় খেলাটি। ফসল কাটা শেষে বিশাল ন্যাড়া মাঠে চলে এই খেলা। ২২ কেজি ওজনের একটি পিতলের ঘুঁটি ছেড়ে দেওয়া হয় মাঠে। সেই ঘুঁটি দখলের চেষ্টা চলে বিভিন্ন দলের মধ্যে। কয়েকটি গ্রাম নিয়ে হয় একেকটি দল। শক্তি, বুদ্ধি আর কৌশল খাটিয়ে রাত অবধি চলে খেলা। একদল ঘুঁটি গুম করে (লুকিয়ে) রাখে। অন্য দলগুলো সেই ঘুঁটি খুঁজে বের করে নিজেদের দখলে নেওয়ার চেষ্টা করে। কোনো দল লুকানোর পর ঘুঁটিটি যদি আর খুঁজে পাওয়া না যায়, তবে সেটি তাদের দখলে চলে যায়। আর খেলারও সমাপ্তি ঘটে সেখানেই। জয়ী দলের কাছে ঘুঁটিটি এক বছর থাকে। ঘুঁটিটি নিজেদের কাছে রাখা গৌরবের মনে করে গ্রামের মানুষ।
খেলার নাম ‘হুমঘুঁটি’। ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় প্রতিবছর হয় এই খেলা। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, এটি আড়াই শ বছরের ঐতিহ্যবাহী একটি খেলা। গতকাল শনিবার ফুলবাড়িয়ার বড়ই আটা গ্রামে হুমঘুঁটি খেলার আয়োজন করা হয়। খেলা উপলক্ষে এলাকার মানুষের মধ্যে দিনভর ছিল উৎসবের আমেজ। বিকেল নাগাদ শুরু হয় খেলা। একসময় সন্ধ্যা গড়িয়ে নামে রাত। তখনো চলছিল খেলা।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, খেলায় জয়ী হওয়ার জন্য ঘুঁটিটি গুম করতে হবে। এটি দিনের আলোয় সম্ভব হয় না। রাতের অন্ধকারে কৌশল খাটিয়ে ঘুঁটিটি গুম করতে হয়। এক গ্রামের মানুষ ঘুঁটিটি গুম করার পর প্রতিযোগী অন্য গ্রামের মানুষ সেটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। এভাবে গভীর রাত পর্যন্ত খেলা চলে। খেলায় ধরাবাঁধা কোনো নিয়ম নেই। নেই কোনো বিচারক। ঘুঁটি গুম করতে গিয়ে খেলোয়াড়েরা গ্রামের ঘরবাড়িতে পর্যন্ত ঢুকে পড়ে। ঘুঁটিটি যে দল দখলে রাখতে পারবে, সেই দলই বিজয়ী।
ময়মনসিংহ-ফুলবাড়িয়া সড়কের পাশে বড় ফসলের মাঠে হুমঘুঁটি খেলা শুরু হয় গতকাল বিকেল চারটায়। খেলা দেখতে ফুলবাড়িয়া, ময়মনসিংহ সদর, ত্রিশাল ও মুক্তাগাছা উপজেলার কয়েক হাজার মানুষ আসে। গতকালের খেলায় ১৫ থেকে ২০ গ্রাম মিলে চারটি দলে অংশ নেয়। দলগুলো ঢাকঢোল পিটিয়ে উৎসব করতে করতে খেলায় যোগ দেয়। নারী-পুরুষ-শিশু মিলে খেলা উপভোগ করে।
বালাশ্বর গ্রামের হীরা মিয়া নামের প্রবীণ এক ব্যক্তি বলেন, ‘খেলাটি আমি ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি। খুব উৎসবমুখর পরিবেশে হয়। আমার বাবার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, কবে থেকে এই খেলা হয়। তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন, একই প্রশ্ন তিনি তাঁর বাবার কাছে করেও সঠিক উত্তর পাননি। খেলাটি অনেক প্রাচীন। এই খেলা গ্রামে উৎসবের আমেজ আনে।’
গতকাল সন্ধ্যা পৌনে ছয়টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত বিভিন্ন গ্রামের মানুষ ঘুঁটিটি নিজেদের দখলে নেওয়ার জন্য লড়ছিল। ফসলের মাঠে কাদা ও পানিতে ভিজে গ্রামবাসী ঘুঁটিটি দখলের চেষ্টা করছিল।
যেভাবে খেলার প্রচলন
স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, পিতলের পিণ্ডটিকে বলা হয় ঘুঁটি। ঘুঁটিকে গুম করা গ্রাম বিজয়ী হয় বলে খেলাটিকে প্রথমে গুমঘুঁটি নামে বলা হলেও পরে সেটির নাম হয় হুমঘুঁটি। ২৫০ বছরের বেশি আগে বর্তমানে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলা ও ত্রিশাল উপজেলার দুই জমিদারের জমিদারি ছিল। জমির পরিমাপ নিয়ে দুই জমিদারের পরগণায় বিরোধ মীমাংসা করতে এই খেলার উৎপত্তি বলে আয়োজকেরা জানিয়েছেন। জমিদারি প্রথা যত দিন ছিল তত দিন জমিদারদের পক্ষ থেকে খেলাটির আয়োজন করা হতো। জমিদারি বিলুপ্তির পর দৌলত মণ্ডল নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি খেলাটির আয়োজন করতেন। বংশপরম্পরায় দৌলত মণ্ডলের বংশের কেউ হন খেলার আয়োজক। ১৯৯৫ সাল থেকে আয়োজক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন আবু বক্কর ছিদ্দিক। তিনি খেলার আয়োজক কমিটির সভাপতি।
গতকাল দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত লক্ষ্মীপুর ও বালাশ্বর গ্রামের কয়েকটি বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ঐতিহ্যবাহী হুমঘুঁটি খেলা উপলক্ষে গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে আত্মীয়স্বজনেরা এসেছেন। ঘরে ঘরে পিঠাপুলি বানানোর ধুম পড়েছে।