শতবর্ষী গোবিন্দচরণ পার্ক
গোবিন্দচরণ পার্কের অবস্থান ছিল সিলেট শহরের বন্দরবাজার এলাকায়। একটা সময়ে এ পার্ক মিছিল-সমাবেশ-সাংস্কৃতিক আয়োজনে মুখর থাকত। বহু ঐতিহ্যের সাক্ষী এই পার্ক এখন কেবল ইতিহাস। অনেকটা বিস্মৃতও। ১৯৫৯ সালে পার্কটি গুঁড়িয়ে দিয়ে তৈরি করা হয় বিপণিবিতান। তৎকালীন জেলা প্রশাসক আলী হাসানের নামানুসারে পার্কের নাম বদলে রাখা হয় হাসান মার্কেট। সেই থেকে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে বিপণিবিতানটি।
অখণ্ড ভারতবর্ষের বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি গোবিন্দচরণ পার্কে সভা-সমাবেশে বক্তব্য দিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ও পঞ্চম প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী উল্লেখযোগ্য। সত্য ও তথ্য বইয়ে এসব জানিয়েছেন আমীনুর রশীদ চৌধুরী। আমীনুর দেশের অন্যতম প্রাচীন বাংলা সংবাদপত্র যুগভেরীর সম্পাদক ছিলেন।
বড় বড় গাছগাছালিতে ঘেরা গোবিন্দচরণ পার্কের অস্তিত্ব মুছে দেওয়ার বিষয়টি দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন সিলেটের প্রবীণ শিক্ষাবিদ বিজিতকুমার দে (৮৯)। তাঁর কথা, ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন সভা-সমাবেশও এখানে হয়েছে। স্মৃতিবাহী পার্কটি গুঁড়িয়ে যে জেলা প্রশাসকের পৃষ্ঠপোষকতায় বিপণিবিতান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তিনি ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের বাসিন্দা। স্বাধীনতার এতকাল পরও পশ্চিম পাকিস্তানের বাসিন্দার নামটি বহাল তবিয়তে আছে। কেবল আড়ালে চলে গেছে এ মাটির সূর্যসন্তান গোবিন্দচরণের নাম।
একাধিক বিশিষ্টজনের আত্মস্মৃতিমূলক বই ঘেঁটে জানা গেছে, সিলেটের প্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মুরারিচাঁদ কলেজ (এমসি কলেজ) প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৯২ সালে। পাঠদানসহ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম তখন শুরু হয় বন্দরবাজার এলাকায় বাঁশ ও টেউটিনের একটি ঘরে। ১৯২৪ সালে কলেজটি টিলাগড়ে নিজস্ব পাকা ভবনে স্থানান্তরিত হয়। এরপরই বন্দরবাজার এলাকার ওই স্থানের স্বত্বাধিকারী গিরীশচন্দ্র রায় একটি পার্ক, অর্থাৎ উদ্যান নির্মাণ করেন। তাঁর বাবা গোবিন্দচরণের স্মৃতি রক্ষার্থে উদ্যানের নাম দেওয়া হয় ‘গোবিন্দচরণ পার্ক’। ত্রিকোণাকৃতির উদ্যানের চারপাশে পাকা দেয়াল, লোহার রেলিং ও ফটক ছিল। ভেতরে বসার জন্য ছিল লোহার একাধিক বেঞ্চ।
গোবিন্দচরণ পার্ক প্রতিষ্ঠার ইতিহাস কিছুটা জানা যায় ভাষাসংগ্রামী মো. আবদুল আজিজের আত্মজীবনী কালের যাত্রার ধ্বনি থেকে। বইয়ে আবদুল আজিজ জানিয়েছেন, গোবিন্দচরণ পার্কটি স্থাপন করেন রায়বাহাদুর গিরীশচন্দ্র। তিনি ছিলেন সিলেটের প্রথম ইঞ্জিনিয়ার। কলকাতার হাওড়া সেতুরও তিনি ছিলেন অন্যতম স্থপতি।
উন্মুক্ত হওয়ার কারণে পার্কটিতে শহরের মানুষেরা অবসর কাটাতে আসতেন। ধীরে ধীরে স্থানটি সভা-সমাবেশের আয়োজনস্থল হিসেবেও পরিচিতি পায়। একাধিক বইপুস্তকে লেখা আছে, পার্কে বড় বড় গাছপালা ছিল। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের পর এখানে কয়েকজন স্বাধীনতাসংগ্রামীকে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। তাই পার্কের একদিকে সিপাহি বিদ্রোহের শহীদদের স্মৃতি স্মারকস্তম্ভও ছিল। ১৯৪৭ সালে সিলেটে অনুষ্ঠিত গণভোট এবং ১৯৫৪ সালে নির্বাচনের আগে এখানে সভা-সমাবেশ হয়েছে। চট্টগ্রামের বিখ্যাত কবিয়াল রমেশ শীলও এ পার্কে কবিগান পরিবেশন করেছিলেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, আগেকার কোনো স্মৃতিচিহ্নই এখন আর পার্কে অবশিষ্ট নেই। বিপণিবিতানের কয়েক শ দোকান ক্রেতা-বিক্রেতায় সরগরম। বিপণিবিতানের তিনটি স্থানে তিনটি প্রকাণ্ড আকারের শিরীষগাছ দাঁড়িয়ে আছে। এসব গাছের চারা বিপণিবিতান চালুর সময় রোপণ করা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন হাসান মার্কেট দোকান মালিক ও ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. রইছ আলী।
সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ‘সিলেটের বহু ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাক্ষী ছিল গোবিন্দচরণ পার্ক। গোবিন্দচরণের স্মৃতি রক্ষার্থে কোনো উদ্যোগ নেওয়া যায় কি না, ভেবে দেখব।’