শনাক্ত হচ্ছে না প্রকৃত অপরাধীরা

ফেসবুক পোস্টে ইসলাম ধর্মের অবমাননা হয়েছে—এই হুজুগ তুলে সাম্প্রদায়িক হামলা শুরু কক্সবাজারের রামু থেকে। ২০১২ সালে ওই সহিংসতার পর প্রায় প্রতিবছর একই কায়দায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর অন্তত নয়টি বড় হামলা হয়েছে। কোথাও ভুয়া ফেসবুক পরিচিতি (আইডি) থেকে, কোথাও লেখাপড়া না জানা অন্যের আইডি থেকে উসকানিমূলক পোস্ট দিয়ে ঘটনার সূত্রপাত হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত একটি ঘটনায়ও পুলিশ প্রকৃত অপরাধী, অর্থাৎ ফেসবুকে উসকানিদাতাকে শনাক্ত করতে পারেনি।

মাঠপর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পুলিশের সক্ষমতা বা সদিচ্ছার অভাবে প্রকৃত অপরাধীরা শনাক্ত হচ্ছে না। পুলিশের কার্যক্রম তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের ৫৭ ধারায় অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে। এই মামলার শিকার হচ্ছেন ভুক্তভোগী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরীহ লোকজনও।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের সহকারী মহাপরিদর্শক (গণমাধ্যম) সহেলী ফেরদৌস প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের মামলা করে পুলিশ মাঝেমধ্যে বেকায়দায় পড়ে যাচ্ছে। প্রায়ই দেখা যাচ্ছে, ভুয়া আইডি থেকে নেতিবাচক পোস্ট ছড়ানো হচ্ছে। তখন পুলিশের কিছুই করার থাকছে না।

পুলিশের এই ‘অসহায়ত্বের’ সুযোগে একের পর এক ঘটনা ঘটে চলেছে। ফেসবুকে পবিত্র কোরআন অবমাননার অভিযোগে কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের ওপর ভয়ংকর হামলাটি হয় ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর। অভিযোগ ছিল, রামুর মেরুংলোয়া বড়ুয়াপাড়ার বাসিন্দা উত্তম কুমার বড়ুয়ার ফেসবুক আইডিতে পবিত্র কোরআন অবমাননা করে একটি পোস্ট ট্যাগ করা হয়। তিনি তাতে লাইক দেন মাত্র। রামু থেকে পরে ওই সহিংসতা উখিয়া ও টেকনাফ পর্যন্ত ছড়ায়। নিহত হন একজন। পুড়িয়ে দেওয়া হয় শত বছরের পুরোনো বৌদ্ধমন্দির ও হিন্দুধর্মাবলম্বীদের একটি মন্দির। সন্ত্রাসীরা বৌদ্ধপল্লির ৪০টির মতো বাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে।

পাঁচ বছর পরও পুলিশ জানতে পারেনি আসলে কে ওই পোস্টে উত্তম কুমার বড়ুয়াকে ট্যাগ করেছিলেন। উত্তমই ওই পোস্টে আসলে লাইক দিয়েছিলেন, নাকি তাঁর আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে অন্য কেউ কাজটি করেছিলেন, সে ব্যাপারেও পুলিশ কিছু জানতে পারেনি। ওই সময়ে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার ছিলেন সেলিম মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ সন্দেহভাজন আসামিদের কম্পিউটার, মুঠোফোন সিআইডিতে পাঠিয়েছিল। ওই সব উপাদান থেকে আসামি শনাক্ত করার মতো কোনো তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায়নি।

রামুতে ওই হামলা শুরু হলে ওই রাতে বাড়ি ছেড়ে পালান পেশায় দলিল লেখক-সহকারী উত্তম বড়ুয়া। তাঁর স্ত্রী রিটা বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, উত্তমের পরনে সেই রাতে শুধু একটি লুঙ্গি ছিল আর হাতে ছিল মোবাইল ফোন। সেই যে বাড়ি ছাড়লেন, আর ফিরে আসেননি। আজ পর্যন্ত কোনো খোঁজও পাওয়া যায়নি।

এ ঘটনার এক বছর পর ২০১৩ সালের ২ নভেম্বর ফেসবুকে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে কটূক্তি করা হয়েছে—এই গুজব ছড়িয়ে
পাবনার আতাইকুলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা হয়। ওই দিন ছিল কালীপূজা। অভিযোগ যার বিরুদ্ধে, সে স্থানীয় একটি স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র, বনগ্রাম বাজারের দোকানমালিক বাবলু সাহার একমাত্র ছেলে। ঘটনার দিন তাঁর ছেলে ফেসবুকে মহানবী (সা.)-কে কটূক্তি করেছে অভিযোগে এলাকায় ত্রিমুখী হামলা হয়। একদল বাজারে মিছিল বের করে, একদল পাবনা-নগরবাড়ী সড়কে কাঠের গুঁড়ি ফেলে রাস্তা বন্ধ করে দেয়, অন্য দলটি লাঠিসোঁটা, ধারালো অস্ত্র নিয়ে হিন্দুবাড়ি ও মন্দিরগুলোতে হামলা চালায়।

বাবলু সাহা প্রথম আলোকে বলেন, তিনি তাঁর ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান। সন্ত্রাসীরা তাঁর বাড়িতে আগুন দেয় এবং দোকান লুট করে। হাইকোর্ট থেকে পরে সরকারকে ৪৩ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়, যদিও ওই টাকা তিনি এখনো পাননি।

এ ঘটনায় তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় ওই কিশোরের বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশ। অভিযুক্ত কিশোরকে আইনি সহায়তা দেয় আইন ও সালিশ কেন্দ্র। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, অভিযোগ যাচাইয়ে পুলিশ ওই কিশোরের কম্পিউটার ও মুঠোফোন বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের (বিটিআরসি) কাছে পাঠিয়েছিল। অভিযোগের সত্যতা না থাকায় পরে ওই কিশোর মামলা থেকে অব্যাহতি পায়।

দুই সংখ্যালঘু তরুণ ইসলাম ধর্ম অবমাননা করেছে—এমন অভিযোগ তুলে কুমিল্লার হোমনায় বাগসিতারামপুরের জেলেপাড়ায় হামলা হয় ২০১৪ সালের ২৬ এপ্রিল। স্থানীয় কিছু ব্যক্তি মাদ্রাসার দুজন কট্টরপন্থী শিক্ষক ও ছাত্রদের নিয়ে হামলা চালান। ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য নঈম মোল্লা তাঁদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন।

নঈম মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, শেষ পর্যন্ত জেলেপাড়ার ওই দুই সংখ্যালঘু তরুণ ইসলাম ধর্ম অবমাননা করেছেন—এমন অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি।

গত বছরের ২৯ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের লেখাপড়া না জানা জেলে রসরাজের বিরুদ্ধে ফেসবুকে অবমাননাকর পোস্ট দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। এরপর সেখানে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা হয়। রসরাজকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) ফরেনসিক ল্যাবের প্রতিবেদনে প্রমাণিত হয়, রসরাজ ওই ফেসবুক পোস্ট দেননি। এর আগেই রসরাজকে সাড়ে তিন মাস জেল খাটতে হয়।

নাসিরনগরে হামলার ঘটনায় করা আট মামলার মধ্যে একটির অভিযোগপত্র গত ১১ ডিসেম্বর আদালতে জমা দিয়েছে পুলিশ। তাতে হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে ২৮৮ জনকে আসামি করা হয়েছে। কিন্তু ফেসবুকে কে ওই ধর্মীয় অবমাননার পোস্ট ছড়াল, সে বিষয়ে অভিযোগপত্রে কিছু বলা হয়নি। পুলিশ বলছে, ওই ঘটনায় আইসিটি আইনে একটি মামলা রয়েছে। ওই মামলার তদন্তে ফেসবুকের পোস্টের বিষয়টি দেখা হচ্ছে। ওই মামলায় রসরাজও আসামি।

 ফরিদপুরের কৃষ্ণ কুমার মালো শুরু থেকেই বলেছেন, তাঁর নামে অন্য কেউ একটি আইডি খুলেছে। তিনি তাঁর প্রকৃত আইডি কোনটি, সে কথাও বারবার জানিয়েছেন, কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। ভুয়া আইডি থেকে ছবি পোস্ট করে প্রচারের কাজ করেছে দুর্বৃত্তরা আর জেলে যেতে হয়েছে কৃষ্ণ কুমার মালোকে।

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, ‘বিনা অপরাধে মানুষ সাজা খাটবে কেন? তার বিরুদ্ধে মামলাই বা হবে কেন? যেখানে দেখা যাচ্ছে, ফেক আইডি থেকে পোস্ট দেওয়া হচ্ছে, সেখানে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা দেওয়ার কোনো মানে হয় না। এই ধারায় মামলা দিলে জজ সাহেবরা জামিন দিতে চান না।’

সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতারা মনে করেন, ফেসবুকে ভুয়া পোস্ট দিয়ে পুরো সম্প্রদায়ের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। তাঁরা ভীত, আতঙ্কিত। এক জায়গায় হামলা হলেই আরেক জায়গার মানুষ ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে। কিন্তু সত্যিকারের অপরাধী ধরা না পড়ায় এ ধরনের প্রবণতা বাড়ছে।

হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি রানা দাশগুপ্ত প্রথম আলোকে বলেন, সব সময়ই ধর্মকে স্বার্থ উদ্ধারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এর আগে ২০১১ সালে একবার ধানমন্ডি বয়েজ স্কুলের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ তোলা হলো। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ওই শিক্ষকের ওপর স্কুলের রুটিন তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তাঁর করা রুটিনে কারও কারও কোচিং ব্যবসায় ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। ওই শিক্ষকেরা ছাত্রদের দিয়ে মিছিল বের করালেন। প্রাণভয়ে তাঁকে অনেক দিন পালিয়ে থাকতে হয়।

প্রকৃত অপরাধী শনাক্ত করা সম্ভব

তথ্যপ্রযুক্তিবিদেরা বলছেন, যেহেতু ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা কোনো না কোনো আইএসপির (ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান) সঙ্গে যুক্ত থাকেন, ফেসবুক বা গুগল কর্তৃপক্ষকে আইএসপির নাম জানালে নির্দিষ্ট তারিখে, নির্দিষ্ট সময়ে কে কে ফেসবুক ব্যবহার করেছেন, সেটা জানা সম্ভব হয়।

ঢাকা মহানগর পুলিশের সাইবার নিরাপত্তা ও অপরাধ বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের ঘটনায় পুলিশ ফেসবুক ও গুগলের কাছ থেকে সন্দেহভাজন আইডিটা কোন আইপি দিয়ে চলছে, তা জানতে চায়। কিন্তু সমস্যা হলো, বাংলাদেশের সব আইএসপি তাদের গ্রাহকেরা কখন ইন্টারনেট ব্যবহার করছে তার আইপিলগ রাখে না। আবার ফেসবুক ও গুগলও সব সময় তথ্য দেয় না।

এ প্রসঙ্গে মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা থামানোর জন্য রাষ্ট্রের শক্ত রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে। সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যদি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থন দিয়ে থাকে, যেমনটা আমরা অভিযোগ শুনি, তাহলে অপরাধী শনাক্ত হবে না, বিচারও হবে না।’ তিনি বলেন, বিচার হয় না বলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আর প্রতিকার চায় না, মানবাধিকারকর্মীরাও চুপ করে যান। এটা একটা বিপজ্জনক অবস্থা এবং সাংবিধানিক অঙ্গীকারের বরখেলাপ।

[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন কুমিল্লার বাঞ্ছারামপুর প্রতিনিধি মনিরুল ইসলাম]