শহরাঞ্চলে সংক্রমণের বিস্ফোরণ ঘটার আশঙ্কা

মুশতাক হোসেন।
মুশতাক হোসেন।

বর্তমান সময়ে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা এবং দক্ষিণ এশিয়ায় সংক্রমণের হার সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশে আমরা মৃদু পর্যায় ছাড়িয়ে সংক্রমণের মাঝারি পর্যায়ে রয়েছি। এটা যেকোনো সময় দ্রুত সংক্রমণের পর্যায়ে যেতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি, শহরাঞ্চলে তা আরও বেশি। শহরাঞ্চলে সংক্রমণের বিস্ফোরণ ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। একসঙ্গে অনেক লোক থাকে এমন জায়গায় হঠাৎ সংক্রমণের গতি বেড়ে যেতে পারে। এতিমখানা, কারাগার, মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রীদের আবাস, বস্তি অঞ্চল ঝুঁকিপর্ণ। একসঙ্গে অনেক মানুষ সংক্রমিত হলে মৃত্যুহার বেড়ে যাবে। ভারত, পাকিস্তান বা বাংলাদেশ—এই সব দেশের সামাজিক বাস্তবতা ও কাঠামোর মধ্যে মিল রয়েছে, সব কটি দেশই একই ঝুঁকিতে আছে।

ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো দ্রুত বিচ্ছিন্ন করতে হবে। ‘লকডাউন’ শব্দে আপত্তি থাকলে একে আমরা ‘স্বাস্থ্যবেষ্টনী’ বলতে পারি। গত এক সপ্তাহে কোথায় সংক্রমণ বেড়েছে, শনাক্তের হার বেড়েছে, সেই তথ্য নিয়ে স্বাস্থ্যবেষ্টনী কার্যকর করতে হবে। বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ আছে, কিন্তু এটা ছাড়া পথ নেই। পূর্ব রাজাবাজারে একটি পদ্ধতি দাঁড়িয়েছে। এ ধরনের নিবিড় কর্মসূচি নিতে হবে।

শহরে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর সংকট রয়েছে। নতুন নিয়োগ সময়সাপেক্ষ। দেশের যেসব অঞ্চলে সংক্রমণ কম, সেখান থেকে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের শহরে আনতে হবে। ঢাকার প্রতিটি থানায় কমিউনিটি আইসোলেশন সেন্টার তৈরি করা উচিত। শহরাঞ্চলে সংক্রমণ ঠেকাতে আক্রান্ত বা সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে দ্রুত বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে হবে। কতজন লক্ষণযুক্ত, কতজনের ফুসফুসে এক্স-রেতে নিউমোনিয়া ধরা পড়েছে, কতজন পিসিআর পরীক্ষায় পজিটিভ হয়েছেন—এসব তথ্য নথিভুক্ত করতে হবে।

রেড জোনগুলো অন্তত তিন সপ্তাহের জন্য কার্যকর রাখতে হবে। এ ধরনের রেড জোনে ফল আগে পাওয়া গেছে। টোলারবাগে সংক্রমণ কমানো গেছে। পূর্ব রাজাবাজারে সংক্রমণের হার কমতে শুরু করেছে। তবে সামগ্রিক ফল পেতে হলে সবগুলো রেড জোনকে একই সঙ্গে কার্যকর করতে হবে।

অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের দোহাই দিয়ে সম্ভবত কিছু কাজে শিথিলতা দেখানো হচ্ছে। এখানে সিটি করপোরেশনগুলোর ভূমিকা জরুরি। ঢাকা শহরের অন্তত এক-তৃতীয়াংশ এলাকাকে স্বাস্থ্যবেষ্টনীর মধ্যে আনা উচিত। এখন যা দ্বিগুণ পরিশ্রম করে সামাল দেওয়া যাবে, সময় চলে গেলে দশ গুণ পরিশ্রমেও তা হবে না।

চীনের কথা, চীনের অভিজ্ঞতার কথা ঘুরেফিরে চলে আসে। চীনের রাজনৈতিক কাঠামো বাংলাদেশের চেয়ে ভিন্ন। তাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা উন্নততর। তারা যা পেরেছে, এ দেশের জন্য তা কঠিন। তবে তাদের পর্যবেক্ষণ ঠিক। চীন টেস্টের পাশাপাশি সিটি স্ক্যান ও ফুসফুসে নিউমোনিয়া নিশ্চিত করতে এক্স-রে করছে, সে ধরনের কিছু এ দেশেও করা উচিত । এক্স-রে করে নিউমোনিয়া পাওয়া গেলে চিকিৎসক ব্যবস্থা নিতে পারেন। লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসার দিকে দ্রুত যেতে হবে। পরীক্ষার আগেই সন্দেহভাজন আক্রান্তদের স্থানীয়ভাবে আলাদা করতে হবে। যাঁদের বাসায় থাকার সুযোগ নেই তাঁরা আইসোলেশন সেন্টারে থাকবেন।

প্রশ্ন উঠেছে কোন দিকে যাচ্ছে বাংলাদেশ? এই ভাইরাসের মৌসুম নেই। আপনাআপনি এই ভাইরাসের সংক্রমণের হার কমে আসবে না। চেষ্টা করেই সংক্রমণ কমাতে হবে। চীনের উহানে হঠাৎ করে ও দ্রুত সংক্রমণ বেড়েছে। চেষ্টা করেই কামানো হয়েছে। নিউজিল্যান্ডও তা–ই করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোতে ধীরগতিতে বেড়ে একপর্যায়ে সংক্রমণের বিস্ফোরণ ঘটেছে। সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে সেটা কমিয়েছে। কিন্তু এরপরও সংক্রমণে হার সেখানে যথেষ্ট বেশি। কমছে, আবার বাড়ছে। আফ্রিকা আর দক্ষিণ এশিয়ার পরিস্থিতিকে বলা যায় তুষের আগুনের মতো। এটা জ্বলছে এবং এখান থেকে যেকোনো সময় খড়ের গাদায় আগুন লেগে যেতে পারে।

চীনের বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশের মানুষের অসচেতনতার বিষয়টি এসেছে। এ ক্ষেত্রে মানুষকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। মানুষকে সচেতন করার দায়িত্ব সরকারের। ভারতে কেরালা বা ভিয়েতনামে মানুষকে সম্পৃক্ত করেই সংক্রমণ ঠেকানো হয়েছে। সরকার চেষ্টা করলে অল্প সময়ের মধ্যেই এটা সম্ভব।