শালদা নদীর যুদ্ধ

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১: সবার বাঁয়ে লেখক। ছবি: লেখকের সৌজন্যে
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১: সবার বাঁয়ে লেখক। ছবি: লেখকের সৌজন্যে

৯ অক্টোবর বাংলাদেশ বাহিনীতে কমিশন লাভের পর ৫ নভেম্বর সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে শালদানদী এলাকায় ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দিই। সে সময় ৪ ইস্ট বেঙ্গল কুমিল্লার দক্ষিণে মন্দভাগ এবং শালদা নদী এলাকায় প্রতিরক্ষা অবস্থানে ছিল। ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার ছিল প্রতিরক্ষা অবস্থান থেকে দু–তিন কিলোমিটার পেছনে ত্রিপুরার কোনাবনে। আমার চার্লি কোম্পানির অবস্থান ছিল বাঁয়ে দক্ষিণে শালদা নদী থেকে মন্দভাগ চিউরা হয়ে উত্তরে কায়েমপুর পর্যন্ত। কোম্পানির সৈন্যবল ছিল প্রায় ২৫০ জন নিয়মিত ও গণবাহিনীর যোদ্ধা। সৈনিকদের ব্যক্তিগত অস্ত্র ছাড়াও পাঁচটা মেশিনগান ও কয়েকটা চায়নিজ এলএমজি ছিল। কোম্পানি হেডকোয়ার্টারে ছিল একটি ৬০ মিমি ও একটা ২ ইঞ্চি মর্টার, যাকে আমরা ‘উঠান ব্যাটারি’ বলতাম। কোম্পানিকে ফায়ার সাপোর্ট দেওয়ার জন্য ছিল ব্যাটালিয়ন ৮২ মিমি মর্টার প্লাটুন এবং ১০৬ ও ৭৫ মিমি রিকয়েললেস রাইফেল বা আরআর। সর্বোপরি ডাইরেক্ট ফায়ার সাপোর্টে ছিল মুজিব ব্যাটারি আর্টিলারি।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছে মন্দভাগ ও শালদানদী ছিল কৌশলগত কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলযোগাযোগ লাইন সীমান্তবর্তী এই এলাকা দিয়ে গেছে, যা জুলাই মাস থেকে সম্পূর্ণ আমাদের দখলে ছিল। এ ছাড়া পুরোনো জেলা বোর্ড রাস্তাও এরই সমান্তরাল চলে গেছে।
আমাদের বিপক্ষে পাকিস্তানি ৩০ পাঞ্জাব মুখোমুখি অবস্থান গ্রহণ করেছিল। সর্ববাঁয়ে শালদানদী স্টেশন থেকে নদীর দক্ষিণ পাড় বরাবর দূরে উত্তরে তাদের বাঙ্কার ও অস্ত্রের অবস্থান ছিল। তাদের একটি আর্টিলারি রেজিমেন্ট অবস্থান করছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কুটি এলাকায়। আমাদের দুই প্রতিরক্ষা অবস্থানের মধ্যে শালদা নদী ছিল ন্যাচারাল অবস্টাকল। এ জায়গায় নদী ১০০-২০০ গজ চওড়া। শালদা নদী ভারতের ভেতর থেকে উত্পন্ন হয়ে এঁকেবেঁকে শালদানদী স্টেশন হয়ে কুমিল্লার অভ্যন্তরে প্রবাহিত হয়েছে। আর বিস্তীর্ণ পরিত্যক্ত ধানখেত কাজ করছিল নো ম্যানস ল্যান্ড হিসেবে। দুই পক্ষের মধ্যে নিয়মিত গোলাগুলি চলত আর মাঝেমধ্যে আমাদের রেইড, অ্যামবুশ অভিযান।
নভেম্বর মাস ছিল রোজার মাস। যুদ্ধের মধ্যেও আমরা সবাই রোজা রাখতাম। সামনে ঈদুল ফিতর। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে ১৩–১৪ নভেম্বর গভীর রাতে আমার কোম্পানির তিনটি প্লাটুন একযোগে পাকিস্তানি অবস্থানে ইনফিলট্রেশন করে পিছ থেকে ত্রিমুখী আক্রমণ করে তাদের জানমালের ক্ষতি সাধন করে নিজ অবস্থানে ফিরে আসবে। আগের দিন ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টারে অধিনায়ক ক্যাপ্টেন গাফফারের সঙ্গে পরিকল্পনা নিয়ে বিশদ আলোচনা করে তার চূড়ান্ত অনুমোদন নিলাম। ফিরে এসে প্লাটুন কমান্ডার ও অন্য গুরত্বপূর্ণ কমান্ডারদের অভিযান সম্বন্ধে বিশদ নির্দেশনা দিলাম। মুজিব ব্যাটারি, ব্যাটালিয়ন মর্টার ও আরআর প্লাটুন পরিকল্পনা অনুযায়ী, অভিযান চলাকালে ফায়ার সাপোর্ট দেওয়ার জন্য সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে।

রাত ১২টার পর হালকা খাবার খেয়ে প্রায় ১০০ জন সৈনিককে তিনটি প্লাটুনে সংগঠিত করি। প্রতিটি প্লাটুন প্রয়োজনীয়সংখ্যক এলএমজি সঙ্গে নেয়। কোম্পানি হেডকোয়ার্টার অবস্থানে ৬০ এমএম মর্টার স্থাপন করি। পিআরসি-২৫ ওয়্যারলেস সেটের মাধ্যমে হেডকোয়ার্টার, মর্টার প্লাটুন ও মুজিব ব্যাটারির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করি। এ ছাড়া কোম্পানি ও প্লাটুনের মধ্যে ওয়াকিটকির মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপন করা হয়।
রাত দুইটার দিকে একযোগে তিনটি প্লাটুন শত্রু অবস্থানের দিকে অগ্রসর হয়। আমি আর সুবেদার ওয়াহাব, নায়েব সুবেদার মঙ্গল মিয়ার ৭ নম্বর প্লাটুনের সঙ্গে মধ্যরেখা বরাবর অগ্রসর হই। বাঁয়ে নায়েব সুবেদার বেলায়েতের ৮ নম্বর প্লাটুন শালদা নদীর নিজস্ব পাড় বরাবর এবং ডানে নায়েব সুবেদার শহীদ ৯ নম্বর প্লাটুন নিয়ে সম্মুখে অগ্রসর হন। আমি ৭ নম্বর প্লাটুনের সঙ্গে শত্রু অবস্থান থেকে প্রায় ২০০–৩০০ গজ দূরে নো ম্যানস ল্যান্ডে একটি বসতিহীন গ্রামের বাড়িঘর ও গাছপালার আড়ালে অবস্থান নিয়ে অন্য প্লাটুনের অগ্রগতি জানার অপেক্ষায় থাকি।
রাত প্রায় তিনটায় হঠাৎ করে শত্রু অবস্থান থেকে প্রথমে ডান দিকে এবং ক্রমান্বয়ে সমগ্র অবস্থান থেকে ফায়ারিং শুরু হয়। ওয়্যারলেসে নায়েব সুবেদার শাহীদ জানালেন যে তাঁরা খোলা ধানখেতে লাইং পজিশনে অবস্থান নিয়েছেন। তাঁদের অবস্থান জেনে শত্রু গোলাগুলি শুরু করেছে। পরিস্থিতি উপলব্ধি করে শাহীদকে ফায়ার অ্যান্ড মুভ করে নিরাপদ অবস্থানে ফিরে যেতে নির্দেশ দিলাম। বাঁয়ে নায়েব সুবেদার বেলায়েত জানালেন যে তিনি নদীতীরের কাছাকাছি নিরাপদ অবস্থানে আছেন এবং শত্রুর সঙ্গে গোলাগুলি বিনিময় করছেন। কথা বলে বুঝতে পারলাম নায়েব সুবেদার শাহীদের পক্ষে আর অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়। ক্রমে ভোরের আলো প্রকাশ হচ্ছে। আমরা আমাদের অবস্থান থেকে ফায়ার করে শত্রুকে পিন ডাউন করে রাখলাম। ইতিমধ্যে শত্রুর আর্টিলারি আমাদের অবস্থানের ওপর গোলাবর্ষণ শুরু করে। তবে বেশির ভাগই শিষ কেটে মাথার ওপর দিয়ে পেছনে গিয়ে পড়তে থাকল। কিছু পরেই তারা এয়ার বাস্ট শুরু করল। আমরা খোলা অবস্থানে থাকায় তা আমাদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠল। ৯ নম্বর প্লাটুন নিজ অবস্থানের কাছাকাছি পৌঁছানোর পর ৭ নম্বর প্লাটুনকে উইথড্র করে নিজ অবস্থানে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিলাম। তখনো শত্রু আর্টিলারির এয়ার বার্স্ট চলছিল। যাহোক নায়েব সুবেদার বেলায়েতের ৮ নম্বর প্লাটুন ছাড়া আমরা সবাই নিরাপদে আমাদের অবস্থানে ফিরে এলাম। ইতিমধ্যে ভোরের আলো আরও পরিষ্কার হয়ে গেছে।
এদিকে নায়েব সুবেদার বেলায়েতের ৮ নম্বর প্লাটুন নদীতীর বরাবর নিরাপদ আড়াল থেকে নদীর অপর তীরে শত্রুর বাঙ্কার ও অন্যান্য পোস্ট দেখেশুনে ফায়ার করতে থাকে। নায়েব সুবেদার বেলায়েত জানালেন যে ওই অবস্থানে থেকে তিনি যুদ্ধ চালিয়ে যাবেন। ওয়্যারলেসে ব্যাটালিয়নের অধিনায়কের অনুমতি নিলেন। ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার থেকে সার্বিক সমন্বয়ের জন্য টুআইসি লেফটেন্যান্ট কবির ও আরএমও ক্যাপ্টেন আখতার অগ্রবর্তী হয়ে নায়েব সুবেদার বেলায়েতের স্থায়ী অবস্থানে আসেন এবং যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত তাঁরা যোগাযোগ অব্যাহত রাখেন। ওয়্যার করেসপন্ডেন্ট হিসেবে বিচিত্রা সম্পাদক শাহাদাত চৌধুরী তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন।
ইতিমধ্যে ৭ নম্বর প্লাটুন ফিরে আসায় আমি ওদের নিয়ে নায়েব সুবেদার বেলায়েতের সঙ্গে যোগ দিই। নদীর দুই পাড় থেকে অবিরাম গোলাগুলি বিনিময় হতে থাকে। এর সঙ্গে ব্যাটালিয়ন মর্টার আর মুজিব ব্যাটারি থেকে নয়নপুর বাজার বরাবর শত্রু অবস্থানে বিরামহীন গোলাবর্ষণ চলতে থাকে। আমরা এপার থেকে শত্রুর বাঙ্কার ও মুভমেন্ট দেখতে পাচ্ছিলাম এবং দৃষ্টিসীমার মধ্যেই ফায়ারিং করতে থাকি। এর মধ্যে ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার থেকে ২টা ১০৬ ও ৭৫ মিমি আরআর আমাদের অবস্থানে যোগ দেয়। আরআর দিয়ে নদীর অপর পাড়ের শত্রু পোস্টে গোলাবর্ষণ করতে থাকলাম। বিরামহীনভাবে আমাদের নিখুঁত আর্টিলারি, মর্টার, আরআর গোলাবর্ষণের সঙ্গে আমাদের ক্লোজ ফায়ারে শত্রুর পক্ষে অবস্থানে টিকে থাকা দুষ্কর হয়ে গেল। এ ছাড়া ৮ নম্বর প্লাটুনের অবস্থান থেকে এমজির ফায়ার দিয়ে শালদানদী স্টেশনে শত্রুর এমজি পোস্টকে নিষ্ক্রিয়ও করে রাখা হলো। অবস্থান কাছে হওয়ায় শত্রুর ওয়্যারলেস কথোপকথন শুনতে পাচ্ছিলাম। তারা একপর্যায়ে এয়ার সাপোর্ট চাইতে থাকে। তাদের লক্ষ্যভ্রষ্ট আর্টিলারি শেলিংও তেমন সুবিধা করতে পারেনি। ইতিমধ্যে দিনের আলোয় সব পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল।
একপর্যায়ে দেখলাম যে সবচেয়ে দূরের শত্রু এমজি দলটি রেললাইনের আড়ালে দ্রুত দৌড়ে পেছনের অবস্থানে পালিয়ে গেল। সেই সঙ্গে বাঁ পাশে সাগরতলা অবস্থান থেকে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট মমতাজের নেতৃত্বে আলফা কোম্পানির একটি প্লাটুন এসে স্টেশনে শত্রুর অবস্থান দখল করে দূরবর্তী শত্রু অবস্থানে ফায়ারিং করা শুরু করল। সামনে নদী থাকায় শত্রুর আরও ক্ষতি করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। শীতকালে পানি অনেক নিচে নেমে গেলেও পাড় অনেক খাড়া। ততক্ষণে বেলা গড়িয়ে দুপুর ১২টা-১টা হয়েছে। শত্রুর অবস্থান ক্রমান্বয়ে হালকা হতে থাকে।
একসময় আমাদের সৈনিকেরা ‘জয় বাংলা’ বলে নদী পার হয়ে ওপরের বাঙ্কার ও পরিত্যক্ত ঘরবাড়িগুলো সার্চ করতে থাকে। পাকিস্তানিরা নদীর কারণে অনেকটা বিনা বাধায় হতাহতদের সঙ্গে নিয়ে সরে পড়ে। তবু সার্চ করে একজন পাকিস্তানি সেনা ও দুই ইপিসিএএফের মৃতদেহ পাই, এ ছাড়া একজন রাজাকারকে জীবিত ধরি। পাকিস্তানি অবস্থান সার্চ করে বিপুল পরিমাণ রসদ ও গোলাবারুদ আমাদের হস্তগত হয়। সূর্য ক্রমেই অস্ত যেতে থাকে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার আগেই দখলকৃত অবস্থানে কোম্পানি বিন্যাসকে নতুন করে সংগঠিত করি।
অভিযান চলাকালে আমাদের একজন শহীদ হন এবং একজন আহত হন। সবচেয়ে মর্মান্তিক হলো, পরদিন সকালে আমাদের নতুন অবস্থানের সম্মুখে রেকি করার সময় এই অভিযানের নায়ক নায়েব সুবেদার বেলায়েত শত্রুর দূরবর্তী একটি এলএমজির ব্রাস্ট ফায়ারে শাহাদত বরণ করেন। এই যুদ্ধে বেলায়েত মরণোত্তর ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত হন। মমতাজ ও আমি ‘বীর প্রতীক’ খেতাব অর্জন করি।