শিক্ষকদের চেষ্টা, বাল্যবিবাহের পরও পরীক্ষায় বসল ওরা

বাল্যবিবাহ
প্রতীকী ছবি

বাল্যবিবাহের শিকার অনেক শিক্ষার্থী এবারের এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে। অনেক স্থানে শিক্ষকেরা অভিভাবকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বুঝিয়ে মেয়েদের পরীক্ষায় অংশ নেওয়া নিশ্চিত করেছেন। করোনাকালে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার সময় অনেক মেয়ের বাল্যবিবাহ হয়েছিল। সেই শিক্ষার্থীরা চলতি এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। সন্তান জন্মের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পরীক্ষার হলে হাজির হওয়ার নজিরও আছে।

করোনা মহামারির মধ্যে দেশের ৯ জেলায় সাড়ে ৭ হাজারের বেশি বাল্যবিবাহ হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট জেলা ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন। শিক্ষক, শিক্ষাবিদসহ বিশিষ্টজনেরা এসব শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। এবার এসএসসি পরীক্ষা চলাকালে বাল্যবিবাহ বেশি হয় এমন কয়েকটি জেলায় প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, বাল্যবিবাহের শিকার বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই এবারের এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে।

বাল্যবিবাহ নিয়ে মাঠপর্যায়ে কাজের অভিজ্ঞতা আছে এমন কয়েকজন ব্যক্তি বলছেন, বাল্যবিবাহের শিকার বেশির ভাগ মেয়েকে পড়াশোনা থেকে ঝরে পড়তে দেখা যায়। তাই করোনাকালে বাল্যবিবাহের শিকার এসব মেয়েদের এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ শিক্ষার প্রতি মানুষের আগ্রহ সৃষ্টির ইতিবাচক বার্তা দেয়। মহামারির মধ্যে এবার এসএসসি পরীক্ষা কম বিষয়ের ওপর এবং বিশেষ পদ্ধতি অনুসরণ করে হয়েছে এ কারণে মেয়েরাও হয়তো পরীক্ষা দিতে নিজেরা আগ্রহী হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শাহনাজ হুদা বলেন, পরিবারগুলো শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পেরে হয়তো মেয়েদের পরীক্ষায় অংশ নিতে দিয়েছে। শিক্ষকদেরও একটা ভূমিকা থাকতে পারে। তাঁরা হয়তো মেয়ের পরিবার বা মেয়ের শ্বশুরবাড়ি বা মেয়েটিকেই পড়াশোনা অব্যাহত রাখার বিষয়ে আগ্রহী করতে পেরেছেন। আরেকটি বিষয় হতে পারে, স্কুলজীবনের শেষ পরীক্ষা হিসেবে একটি সনদ নেওয়ার আগ্রহ থেকে তারা পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে।

সাতক্ষীরা জেলার মানচিত্র

সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ আদর্শ বালিকা বিদ্যালয়ের ৩৮ জন এসএসসি পরীক্ষার্থীর মধ্যে ২২ জনের বাল্যবিবাহ হয়েছিল করোনাকালে। তারা সবাই এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। সাতক্ষীরার ছয়টি বিদ্যালয়ের তথ্যে প্রায় একই চিত্র উঠে এসেছে।

কালীগঞ্জ আদর্শ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সফিকুল ইসলাম বলেন, অভিভাবকদের বুঝিয়ে পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষা অংশ নেওয়া নিশ্চিত করেছেন তাঁরা।
সাতক্ষীরার আশাশুনির বুধহাটা বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কামরুল ইসলাম জানান, তাঁর বিদ্যালয়ের ১৮ জন সবাই পরীক্ষা দিচ্ছে। এর মধ্যে ছয়জনের বাল্যবিবাহ হয়েছে। নলতা মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলাম জানান, তাঁদের ৫৯ জন এসএসসি পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৫৫ জন পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে। ১৫ জনের বাল্যবিবাহ হয়ে গেলেও ১১ জন পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে।

সাতক্ষীরা জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, করোনাকালে প্রায় প্রতিটি বালিকা বিদ্যালয় ও সমন্বিত বিদ্যালয় থেকে অনেক ছাত্রীর বিয়ে হয়ে গেছে। বিয়ে হয়ে গেলেও তারা অধিকাংশই পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে।

খুলনা জেলার মানচিত্র

করোনাকালে খুলনায় তিন হাজারের বেশি ছাত্রী বাল্যবিবাহের শিকার হয়। তাদের মধ্যে অনেকেই ছিল এসএসসি পরীক্ষার্থী। তবে বিয়ে হওয়ার পরও বেশির ভাগ শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে।

জেলার রূপসা উপজেলার বেলফুলিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মনিরুজ্জামান জানান, স্কুল থেকে এবার ৩৩২ জন পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে। করোনাকালে স্কুলের ৭০ জন মেয়ের বাল্যবিবাহ হয়েছিল, যার মধ্যে ৩৩ জন এসএসসি পরীক্ষার্থী। তাদের মধ্যে মাত্র একজন পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে না। বাকিরা পরীক্ষা দিচ্ছে। এক দিন আগে সন্তান হয়েছে এমন শিক্ষার্থীও পরীক্ষা দিচ্ছে।
খুলনা সদর থানা এলাকার রেলওয়ে মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়েও করোনার সময় বাল্যবিবাহের সংখ্যা বেশি ছিল। ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সোনিয়া রহমান বলেন, ৩২ জন পরীক্ষার্থীর সবাই পরীক্ষা দিচ্ছে। এর মধ্যে বাল্যবিবাহ হয়ে যাওয়া পাঁচজন শিক্ষার্থীও রয়েছে। গত শনিবার সন্তান হয়েছে, এ রকম একজন শিক্ষার্থীও পরীক্ষা দিচ্ছে।

নেত্রকোনা জেলার মানচিত্র

নেত্রকোনার খালিয়াজুরি উপজেলার দুটি বালিকা বিদ্যালয়ে ৩৫ জন ছাত্রীর বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে সিদ্দিকুর রহমান বালিকা বিদ্যালয়ে ১৪ জন ও আবদুল জব্বার রাবিয়া খাতুন বালিকা বিদ্যালয়ে ২১ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে আবদুল জব্বার রাবিয়া খাতুন বালিকা বিদ্যালয়ের ১০ জন এসএসসি পরীক্ষার্থী রয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই বিদ্যালয়ে চলতি এসএসসি পরীক্ষায় ৮৯ জন শিক্ষার্থী ফরম পূরণ করে। তারা সবাই পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে। তাদের মধ্যে কৃষ্ণপুর ও আমানপুর এলাকার দুটি মেয়ে বাড়িতে বাচ্চা রেখে পরীক্ষা দিচ্ছে।

আবদুল জব্বার রাবিয়া খাতুন বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রুবিয়া আক্তার বলেন, ‘বাল্যবিবাহ হওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে ১০ জন এসএসসি পরীক্ষার্থী, তারা সবাই চলতি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে। আমরা ঝরে পড়া রোধ করতে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে বাল্যবিবাহের শিকার শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলছি।’

জামালপুর জেলার মানচিত্র

জামালপুরে দুই রকমের চিত্র পাওয়া গেল। জামালপুর পৌর শহরের বানিয়াবাজার উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মিজানুর রহমান বলেন, এসএসসি ফরম পূরণ করেছিল ১১০ জন। তারা সবাই পরীক্ষা দিচ্ছে। নয়জনের বাল্যবিবাহ হয়েছিল। তারাও পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে।

তবে জামালপুর সদর উপজেলার আলীম উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আবদুল্লাহ জানান, স্কুল বন্ধ থাকার সময় অষ্টম থেকে এবারের পরীক্ষার্থী ৬১ জনের বাল্যবিবাহ হয়েছে। তার মধ্যে ১১ জন এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল। তারা কেউই পরীক্ষায় অংশ নেয়নি।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম প্রথম আলোকে বলেন, এই তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বলা যায়, মেয়েদের মধ্যে লেখাপড়ার যে আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে এটা তারই প্রতিফলন। তবে এই মেয়েরা ঠিক কী ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করে এসেছে, তা আমাদের জানা নেই। পরিবার উৎসাহ দিয়ে থাকলে ইতিবাচক। মেয়েরা বাধা–বিপত্তি ডিঙিয়ে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে কি না, তা জানা প্রয়োজন। পড়াশোনায় সচেতন করার জন্য শিক্ষকদেরও বড় ভূমিকা থাকতে পারে।

[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা]