শিক্ষার্থীরা কী খাচ্ছেন, নজর নেই কারও

হলে থাকা শিক্ষার্থীদের খাবারে কোনো ভর্তুকি নেই। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, ‘বাজেট কম’।

হলগুলোর ক্যানটিন ও ক্যাফেটেরিয়ার ডাল যেন ‘হলুদ পানি’

এক কেজি ওজনের একটি মুরগি (ব্রয়লার) রান্না করার সময় সর্বোচ্চ কত টুকরা করা সম্ভব? যে কারও কল্পনাশক্তিও হার মানবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো একটি আবাসিক হলের ক্যানটিনে খেতে বসলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের একজন বাবুর্চি তথ্য দিয়েছেন, সাধারণত এক কেজি ওজনের মুরগিকে ২৫ টুকরা পর্যন্ত করেন তাঁরা। আর মাছের ক্ষেত্রে নিয়ম হচ্ছে, যত বেশি টুকরা করা যায়।

হলগুলোর ক্যানটিন ও ক্যাফেটেরিয়ার ডাল যেন ‘হলুদ পানি’। ভাত হয় মোটা চালের, সেটিও বাজারের সবচেয়ে নিম্নমানের। দুপুরে এক বেলা খাবারের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যানটিন-ক্যাফেটেরিয়ায় একজন শিক্ষার্থীর ন্যূনতম খরচ ৩৫-৪০ টাকা। ভাত (ভরপেট) ১০ টাকা, মুরগির মাংস ৩০ টাকা, মাছ ২৫ টাকা, রান্না করা ডিম ২০-২২ টাকা। কেউ সবজি খেতে চাইলে আরও ৫ টাকা খরচ হবে। ক্যানটিনে ‘অভিজাত’ খাবার গরুর মাংস। ছোট্ট দুই টুকরা মাংসের সঙ্গে এক টুকরা আলু, দাম ৪৫ টাকা।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

দুপুরের খাবারের পেছনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যানটিনগুলোতে শিক্ষার্থীদের সর্বনিম্ন ৩০-৩৫ টাকা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩০ টাকা, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩০-৪০ টাকা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩০-৩৫ টাকা এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ৪০ টাকা। ঢাকাসহ এই ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের খাবারের পেছনে কোনো ভর্তুকি নেই। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসনের দাবি, ‘বাজেট কম’।

২০১৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) এবং হল সংসদ নির্বাচন হলেও ক্যানটিন-ক্যাফেটেরিয়ার খাবারের মানে কোনো পরিবর্তন হয়নি। এ নিয়ে ডাকসুর নির্বাচিত প্রতিনিধিদেরও কোনো তৎপরতা ছিল না। ডাকসুতে কমন রুম ও ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদকের একটি পদ রয়েছে। এই পদে নির্বাচিত হওয়া ছাত্রলীগের নেত্রী লিপি আক্তার এখন উচ্চশিক্ষা নিতে লন্ডনে। ফোনে যোগাযোগ করেও তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি। উল্টো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্যানটিনের ইজারা থেকে সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত থেকে চাঁদাবাজির অভিযোগ আছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে।

ডাকসুর সর্বশেষ সহসাধারণ সম্পাদক (এজিএস) ও ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির বর্তমান সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেনের দাবি, খাবারের মান পুরোপুরি কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে না গেলেও আগের চেয়ে ভালো হয়েছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ক্যানটিন ইজারার সঙ্গে ছাত্রলীগের জড়িত থাকার অভিযোগ ‘গালগল্প’।

যখন থেকে ছাত্রসংগঠনগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করল, তখন থেকে খাবারের মান একেবারেই কমে গেল।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম শিক্ষাবিদ

ক্যানটিনের ইজারা নিয়ে চাঁদা আদায়ের অভিযোগের বিষয়টি সামনে এসেছে গত বছরের শেষ দিকে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) লালন শাহ হলের প্রাধ্যক্ষ সেলিম হোসেনের রহস্যজনক মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। গত ৩০ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়টির তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের এই অধ্যাপকের মৃত্যু হয়। অভিযোগ ওঠে, মৃত্যুর দিন দুপুরে বাসায় ফেরার পথে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা অধ্যাপক সেলিমকে তাঁর বিভাগের কক্ষে ডেকে নিয়ে যান। ছাত্রলীগ মনোনীত প্রার্থীকে হলের ডাইনিং ম্যানেজার করতে তাঁকে চাপ দেওয়া হয়। সেদিনই তিনি মারা যান। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় গঠিত তদন্ত শেষে ছাত্রলীগের চারজনকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়।

সিলেটের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনের শুরুটা হয়েছে হলের খাবারের নিম্নমান নিয়ে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যানটিন ও ক্যাফেটেরিয়া ইজারা পান বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই। কিন্তু তাঁরা আবার বেশি টাকায় অন্য ব্যক্তিদের কাছে ক্যানটিন ও ক্যাফেটেরিয়া ভাড়া দেন। ফলে ইজারা পাওয়া ব্যক্তি নন, মূলত ভাড়া নেওয়া অন্য ব্যক্তি ক্যানটিন ও ক্যাফেটেরিয়া চালান। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে যে খিচুড়ি ২০ টাকায় পাওয়া যায়, সেটাই এখানে কিনতে হয় ৪০ টাকায়। বাইরে ৫ টাকায় যে জিলাপি বিক্রি হয়, তা এখানে বিক্রি হয় ১০ টাকায়।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিতে হল প্রাধ্যক্ষরা প্রায়ই নানা নির্দেশনা দেন। তবে তা বাস্তবায়িত হয় না। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেদের আটটি হলের মধ্যে আলাওল, সোহরাওয়ার্দী এবং এ এফ রহমান হলের ডাইনিং ও ক্যানটিনে গত এক দশকে সাত লাখ টাকার মতো বাকি রেখেছেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা—এমন অভিযোগ করেছেন ডাইনিং ও ক্যানটিন পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা।

আরও পড়ুন

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিত্যদিনের এই সমস্যা নিয়ে বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলোকে কখনো কখনো সরব হতে দেখা গেলেও অন্য ছাত্রসংগঠনগুলোর এ ব্যাপারে তেমন কোনো ভূমিকা দেখা যায় না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের ছাত্রী সুমাইয়া আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, হলের ক্যানটিনে খাবারের যা মান, তাতে কোনোরকমে বেঁচে থাকা যায়।

হলের খাবারের মান ও পুষ্টিগুণ

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মোটা দাগে শিক্ষার্থীদের খাবারের জন্য দুই ধরনের ব্যবস্থা আছে। একটি ডাইনিং বা মেস, অন্যটি ক্যানটিন বা ক্যাফেটেরিয়া। হল প্রশাসন-নির্ধারিত স্থানে শিক্ষার্থীদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয় ডাইনিং বা মেস। সেখানে শিক্ষার্থীরাই বাজার করেন ও হিসাব রাখেন। ইজারা বা ভাড়া নেওয়া ব্যবসায়ীদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয় ক্যানটিন। হলের ক্যানটিন-ক্যাফেটেরিয়াগুলো ছাড়াও হল ও ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে থাকা খাবারের দোকানগুলোও এর অন্তর্ভুক্ত।

আরও পড়ুন

ডাইনিং বা মেসে খাবারের দাম তুলনামূলক কম, মানও ভালো। অন্যদিকে ডাইনিংয়ের চেয়ে ক্যানটিনের খাবারের দাম দেড় থেকে দুই গুণ বেশি হলেও মান খারাপ। ডাইনিং বা মেসে খেতে হলে শিক্ষার্থীদের মাসের শুরুতে পুরো টাকা বা তার একটি অংশ জমা দিতে হয়। দুপুর ও রাতে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সেখানে খাবার পাওয়া যায়। ফলে পড়াশোনা, খণ্ডকালীন চাকরি, টিউশনসহ নানা কাজে ব্যস্ত শিক্ষার্থীদের বড় অংশই ক্যানটিন বা অন্য কোনো দোকানে খায়।

অভিযোগ রয়েছে, ক্যানটিন বা ক্যাফেটেরিয়া থেকে ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মী নিয়মিত ‘বাকি খান’, কেউ ‘ফাউ’ খান। ক্যানটিনের ইজারা পেতেও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের ‘চাঁদা’ দিতে হয়। ছাত্রলীগের এই ‘অত্যাচারের খড়্গ’ গিয়ে পড়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর। তাঁদের খেতে হয় নিম্নমানের খাবার। এ ছাড়া ক্যানটিনগুলোতে ছাত্রলীগের নেতাদের জন্য কিছুটা ভালো মানের আর সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য ‘ভিন্ন মানের’ খাবার পরিবেশন করা হয়। এমনকি ক্যানটিন পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ‘নমনীয়’ ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে রূঢ় আচরণ করেন বলেও অভিযোগ আছে।

হলগুলোতে শিক্ষার্থীদের সুবিধা-অসুবিধা দেখার জন্য প্রতিটি ‘ব্লকে’ (হলের প্রতি তলার একটি অংশ) একজন করে আবাসিক শিক্ষক থাকেন। তবে শিক্ষার্থীরা তাঁদের ‘চেনেন না’। কারণ, তাঁরা সাধারণত নিজের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্লকে যান না। ক্যানটিন দেখভালের দায়িত্বে থাকা শিক্ষকেরাও কদাচিৎ ক্যানটিনে যান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষার্থী মামুন হোসেনের মতে, ক্যানটিন-ক্যাফেটেরিয়ার খাবারের মান নিয়ে কেউ ভাবলে সে আর খেতে পারবে না। বেশির ভাগ হলে রান্না হয় অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে। কোনোরকমে খাওয়া যায় এটিই অনেক, পুষ্টিগুণের সে খবর কে রাখে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারদা সূর্য সেন হলের ক্যানটিনে খাবার খাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। গতকাল দুপুরে
ছবি: প্রথম আলো

হলের খাবারে যে পুষ্টিমান থাকে, তা দারিদ্র্যসীমার কতটা ওপরে বা নিচে, এ নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে ২০১৭ সালের এপ্রিল ও মে মাসে একটি গবেষণা হয়েছিল। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২৫ জন আবাসিক শিক্ষার্থীর (১২৫ জন ছেলে ও ১০০ জন মেয়ে) ওপর এই গবেষণা করা হয়। এতে দেখা গেছে, হলের শিক্ষার্থীদের দৈনিক পুষ্টির পরিমাণ গড়ে ১ হাজার ৮২১ কিলোক্যালরি। অথচ পুষ্টিবিজ্ঞানীরা বলছেন, একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর দিনে ২ হাজার ৮০০ থেকে ৩ হাজার কিলোক্যালরি গ্রহণ করা উচিত।

গত শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে এক অনুষ্ঠানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ওই গবেষণার তথ্য তুলে ধরে অধ্যাপক আনু মুহম্মদ বলেন, বাংলাদেশে দারিদ্র্যসীমার প্রচলিত হিসাব অনুযায়ী, কেউ যদি দৈনিক ২২০০ কিলোক্যালরি গ্রহণ করে, তাহলে বলতে হবে সে দারিদ্র্যসীমার মধ্যে আছে। এর বেশি হলে বলতে হবে, সে দারিদ্র্যসীমার ওপরে আছে। ১ হাজার ৮০০ কিলোক্যালরি হলে বলতে হবে, সে চরম দারিদ্র্যসীমার মধ্যে আছে। এই হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন হলে যা খান, তা ১ হাজার ৮০০ কিলোক্যালরির কম। তার মানে, তাঁরা হলে থেকে যে খাবার গ্রহণ করেন, তার পুষ্টিমান চরম দারিদ্র্যসীমারও নিচে।

প্রথম আলো দেশের যে ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলের শিক্ষার্থীদের খাবার ব্যবস্থাপনার বিষয়ে খোঁজ নিয়েছে, এর মধ্যে শুধু খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাবারের মান কিছুটা ভালো। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্থক্য হচ্ছে, এখানে ছাত্ররাজনীতি নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে শিক্ষার্থীদের পরিচালিত মেসে খাবারের মান ও দাম—দুটোই শিক্ষার্থীদের কাছে সন্তোষজনক। হল ভেদে মাসে ২ হাজার থেকে ২ হাজার ২০০ টাকা জমা দিয়ে দুই বেলা (দুপুর ও রাত) খাওয়া যায়। শিক্ষার্থীদের চার সদস্যের একটি কমিটি মেসগুলোর বাজার করা থেকে শুরু করে অন্যান্য বিষয় দেখভাল করে।

তবে শিক্ষার্থীদের দৈনিক রুটিনের সঙ্গে খাওয়ার সময় না মেলা এবং অগ্রিম টাকা না থাকার কারণে অনেকেই ক্যানটিন বা ক্যাম্পাসের আশপাশের দোকানগুলোতে খান। মাসে খরচ হয় সাড়ে ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি আবাসিক হলেই ক্যানটিন আছে। এর বাইরে ডাকসু ও টিএসসির ক্যাফেটেরিয়ায় ২০ টাকায় দুপুর ও রাতের খাবার পাওয়া গেলেও দিনের পুষ্টিচাহিদা পূরণে সেই খাবার যথেষ্ট নয়। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ভবন, ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ, আইবিএ ভবন, চারুকলা অনুষদ, উচ্চতর বিজ্ঞান গবেষণাকেন্দ্র এবং কার্জন হল এলাকায় ক্যানটিন আছে। তবে এসব ক্যানটিনে খাবারের দাম হলের ক্যানটিনগুলোর চেয়ে বেশি।

ক্যানটিনে মোটা চালের ভাত ও পাতলা ডাল পরিবেশিত হয়। মাছ-মাংসের আকার খুবই ছোট। মাছ, মাংস ও তরকারি সঠিক উপায়ে পরিষ্কার ও রান্না করা হয় না বলে অভিযোগ আছে।

খাবারের মান নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘হলগুলোর ক্যানটিনে খাবারের গুণগত মান যাতে নিশ্চিত করা হয়, সে ব্যাপারে ক্যানটিনগুলোর পরিচালকদের সঙ্গে খুব শিগগির আমরা আলোচনায় বসব। সেখানে খাবারের মূল্য ও মানোন্নয়ন—এসব নিয়ে আলোচনা হবে।’

একাধিক হলের ক্যানটিন ব্যবস্থাপক নাম না প্রকাশের শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ক্যানটিনের ইজারা পেতেও ছাত্রলীগের নেতাদের টাকা দিতে হয়। টাকা দিলে তাঁরা হলে নিজেদের প্রভাব ব্যবহার করে ইজারা পাইয়ে দেন। এ ছাড়া হলভেদে প্রতি বেলায় ১০-২০টি ফাউ খাবার দিতে হয়। এসব না করলে কর্মীদের দিয়ে তাঁদের নানাভাবে ‘চাপ’ দেন ছাত্রলীগের নেতারা। কখনো কখনো ক্যানটিন ভাঙচুরও করানো হয়।

শিক্ষার্থীদের পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনাও নেই। অন্যদিকে খাবারের মান নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো গবেষণা নেই। খাবারের মানোন্নয়নে প্রশাসনের কোনো ভর্তুকিও নেই।

নিম্নমানের খাবার খেয়ে শিক্ষার্থীদের অসুস্থ হওয়ার ঘটনাও কম নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ বুদ্ধিজীবী মোহাম্মদ মোর্তজা চিকিৎসাকেন্দ্রের চিকিৎসক হাফেজা জামান প্রথম আলোকে বলেন, যেসব স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী চিকিৎসাকেন্দ্রে আসেন, তার একটি হলো ডায়রিয়া। তিনি বলেন, ‘এখন করোনা পরিস্থিতিতে ৯০ শতাংশই সর্দি, কাশি ও জ্বর নিয়ে আসেন। স্বাভাবিক সময়ে ডায়রিয়া, টাইফয়েড, জন্ডিস ইত্যাদি নিয়ে বেশি আসেন শিক্ষার্থীরা।’

শিক্ষার্থীরা বলছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু জগন্নাথ হলের ক্যানটিনে খাবারের দাম কিছুটা কম, এখানে খাবারের মানও অন্যান্য হলের চেয়ে ভালো। ফলে অন্যান্য হলের অনেক শিক্ষার্থী দুপুর ও রাতের খাবার খেতে এই হলে ভিড় করেন।

খাবারে শিক্ষার্থীরা পর্যাপ্ত পুষ্টি পাচ্ছেন কি না, এ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো গবেষণা না থাকা দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, যেসব কাজে বেশি প্রশংসা পাওয়া যায়, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনগুলোর সেসব কাজে আগ্রহ বেশি। কিন্তু যে কাজটি করলে শিক্ষার্থীদের স্বার্থ সংরক্ষণ হয় এবং তাঁদের পুষ্টির বিষয়টি নিশ্চিত হয়, সেসবে কাজে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মনোযোগ কম। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাজেট-স্বল্পতা ও ব্যবস্থাপনায় ঘাটতির কারণে খাবারে ভর্তুকি দিতে পারে না তারা। দায়বদ্ধতা ও স্বচ্ছতার সংস্কৃতি তৈরি হলে এই পরিস্থিতির অবসান সম্ভব।

অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম মনে করেন, যখন থেকে ছাত্রসংগঠনগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করল, তখন থেকে খাবারের মান একেবারেই কমে গেল। কারণটা হচ্ছে খাবারের বিষয়টি টেন্ডার-বাণিজ্যের অংশ হয়ে যাওয়া। ছাত্রনেতারা যখন টেন্ডার-বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত হবেন, তখন খাবারের মান অবধারিতভাবেই কমে যাবে।

[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন সুমনকুমার দাশ, নিজস্ব প্রতিবেদক, সিলেট; শেখ আল-এহসান, নিজস্ব প্রতিবেদক, খুলনা; সুজয় চৌধুরী, প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; মাইদুল ইসলাম, প্রতিবেদক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়; তাপস কুমার সরকার, প্রতিবেদক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়]