শিবচর যেন মুক্তিযুদ্ধের এক শহর

মাদারীপুরের শিবচর উপজেলাটি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে ব্যতিক্রমভাবে সাজানো হচ্ছে। নির্মাণ হচ্ছে ভাস্কর্য, ম্যুরাল, সড়কের নামকরণ হচ্ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামে। এ যেন ইতিহাসের দায় শোধের আয়োজন।

শিবচর শহরের চৌধুরী ফাতেমা বেগম পৌর অডিটরিয়ামের সামনে নির্মিত দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্য ‘প্রবহমান ৭১’। এর ভাস্কর মানিক বিশ্বাসছবি: প্রথম আলো

উপজেলাটিতে ঢুকতেই একের পর এক চোখে পড়বে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের একাধিক নান্দনিক ভাস্কর্য। এ ছাড়া উপজেলার বেশির ভাগ নতুন সেতু, স্থাপনা, দোকানপাট, বিপণিবিতান—সবকিছুতেই রয়েছে লাল-সবুজের সমারোহ। বিভিন্ন রাস্তাঘাট শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামে, স্কুলের বিভিন্ন ভবন ও সেতু বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামে করা হয়েছে।

এ যেন মুক্তিযুদ্ধের এক শহর। শহরটির নাম শিবচর। মাদারীপুরের পাঁচটি উপজেলা শহরের মধ্যে সবচেয়ে সাজানো-গোছানো উপজেলা এটি। এ মফস্বল শহরে মুক্তিযুদ্ধের নানা ইতিহাস-স্মৃতিচিহ্ন এতটাই ছড়ানো-ছিটানো রয়েছে যে প্রথম দেখায় কেউ বিস্মিত হবেনই। এক ঘণ্টা সময়ে পুরো উপজেলা ঘুরে শেষ করা যায়, আর পুরোটা ঘুরে দেখে মনে হবে এ যেন ভাস্কর্য ও ম্যুরালের নগরী।

ভৌগোলিক কারণে পদ্মা সেতুসংলগ্ন দক্ষিণাঞ্চলের প্রবেশদ্বার শিবচর উপজেলাটি বহুল পরিচিত। মহান মুক্তিযুদ্ধে এ উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের রয়েছেন আত্মত্যাগের অনন্য গাথা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বড় বোন চৌধুরী ফাতেমা বেগমের বাড়ি এখানে। সেই সূত্রে শিবচরে বঙ্গবন্ধুর নিয়মিত পদচারণ ছিল। চৌধুরী ফাতেমা বেগমের ছেলে ইলিয়াছ আহমেদ চৌধুরী ছিলেন মুজিব বাহিনীর কোষাধ্যক্ষ ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। দাদাভাই নামেই তিনি সমধিক পরিচিত। ইলিয়াছ আহমেদ চৌধুরীর নির্দেশনায় শিবচর থেকে পার্শ্ববর্তী ৯ উপজেলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করা হয়।

স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধারা জানান, ১৯৯৬ সালে ইলিয়াছ আহমেদ চৌধুরী দাদাভাইয়ের নামে তোরণ নির্মাণের মধ্য দিয়ে ভাস্কর্য ও ম্যুরাল নির্মাণের এ কর্মযজ্ঞ শুরু হয়। এরপর একে একে হয় তিনটি বড় ভাস্কর্য, ১০টি ম্যুরাল, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামে ১০টি সড়কের নামকরণ, বিপণিবিতান—লাল-সবুজে রাঙানো এসব কার্যক্রম। প্রত্যেকটি স্থাপনাই মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বহন করছে।

উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্র জানায়, ২০১১ সালে শিবচর উপজেলার কলেজ মোড় এলাকায় এলজিইডির অর্থায়নে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়। যার নাম দেওয়া হয় ‘স্বাধীনতা চত্বর’। প্রায় ৪৫ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই ভাস্কর্যটিতে অস্ত্র তাক করা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এর ভাস্কর মৃণাল হক।

এরপরের দুটি বড় ভাস্কর্য একই সময়ে নির্মাণ করা হয়। দুটিই হয় চিফ হুইপ ও মাদারীপুর-১ (শিবচর) আসনের সংসদ নূর-ই আলম চৌধুরীর ব্যক্তিগত অর্থে। ২০১৭-১৮ সালে উপজেলা পরিষদের সামনে নির্মাণ করা হয় ‘মুক্তবাংলা’ নামের একটি ভাস্কর্য। ৫৭ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই ভাস্কর্যেও অস্ত্র তাক করে পাহাড়ে যুদ্ধরত অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকা একদল বীর মুক্তিযোদ্ধাকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এর ভাস্কর মানিক বিশ্বাস। তিনি যশোরে থাকেন এবং ‘চারুস্পর্শ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী। এর কাছাকাছি সময়ে শহীদদের কবরের পাশে তৈরি করা হয়েছে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিস্তম্ভ। সেখানে স্থানীয় ১৩ জন শহীদের নামসহ যুদ্ধের ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে। পৌরবাজারে দীর্ঘ একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে ‘সড়ক-৭১’ নামে। সেখানে লাল-সবুজ রঙে সজ্জিত শতাধিক দোকানও রয়েছে। সড়কটির প্রবেশমুখেও প্রায় ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভ। সর্বশেষ ২০১৮ সালে চৌধুরী ফাতেমা বেগম পৌর অডিটোরিয়ামের সামনে প্রায় ৫৫ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্য ‘প্রবহমান ৭১’। ভাস্কর্যটিতে ফোয়ারার মধে৵ নৌকায় চড়তে থাকা একদল মুক্তিযোদ্ধাকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এই ভাস্কর্যে একজন নারী মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্র হাতে, সঙ্গে কয়েকজন তরুণ মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্র আর বিজয়ের পতাকা উঁচিয়ে দাঁড়ানো। এর ভাস্করও মানিক বিশ্বাস।

শিবচর উপজেলার অধিকাংশ সড়কের মোড় ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে স্থাপন করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের ১০টি ম্যুরাল। আরও কয়েকটির কাজ চলমান। ম্যুরালগুলো এলজিইডি, পৌরসভা ও সাংসদ নূর-ই আলম চৌধুরীর অর্থায়নে করা। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন, জাতীয় ও শোক দিবসগুলোতে এসব ম্যুরাল ঘিরে পালিত হয় নানা কর্মসূচি। এ ছাড়া শেখ ফজিলাতুন্নেছা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রায় সাত লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে শেখ ফজিলাতুন্নেছার এক অসাধারণ ভাস্কর্য। ৭১ চত্বর, বিজয় চত্বর, বরহামগঞ্জ চত্বর, মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নির্মাণ করা হয়েছে ম্যুরাল।

এই সময়ে শিবচর পৌরসভার ১০টি সড়কের নাম বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামে করা হয়েছে। এর মধ্যে বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. আবদুল লতিফ খান সড়ক, বীর মুক্তিযোদ্ধা সামসুউদ্দিন খান সড়ক, বীর মুক্তিযোদ্ধা লতিফ মোল্লা সড়ক, বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান মোল্লা সড়ক, বীর মুক্তিযোদ্ধা মান্নান খান সড়ক, বীর মুক্তিযোদ্ধা মোসলেম উদ্দিন সড়ক অন্যতম।

ইলিয়াছ আহমেদ চৌধুরী কলেজের স্নাতক চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী খালিদ জাহিদ খান বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আমরা বইতে পড়েছি। কিন্তু আমাদের উপজেলায় নির্মিত ভাস্কর্যগুলোর দিকে তাকালে মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চোখে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। ইতিহাস আমাদের যেমন চিন্তা–চেতনাকে জাগ্রত করে, ঠিক তেমনি দেশকে নিয়ে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ আমাদের অনুপ্রেরণা দেয়।’

শিবচর পৌর মেয়র আওলাদ হোসেন খান প্রথম আলোকে বলেন, শিবচর পৌর এলাকায় কেউ যেখান দিয়েই প্রবেশ করবেন, সেখানেই তাঁর নজরে পড়বে মহান মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ভাস্কর্য, ম্যুরাল ও লাল-সবুজের স্থাপনা। মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে আমাদের আরও পরিকল্পনা রয়েছে। সারা উপজেলাকেই মুক্তিযুদ্ধের আলোকে সাজাতে চাই। এর জন্য নতুন করে আরও কয়েকটি ভাস্কর্য নির্মাণের উদ্যোগও হাতে নেওয়া হয়েছে।’

শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিবচর অন্য ১০টি উপজেলা শহর থেকে ভিন্ন। উপজেলাটি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে ব্যতিক্রমভাবে সজ্জিত। এসব দেখে নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধকালীন ইতিহাস সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাবে।’

সাংসদ ও জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী বলেন, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে আমাদের ব্যাপক পরিকল্পনা রয়েছে। সারা উপজেলাকেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের আলোকে সাজাতে চাই। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর এখানে যুদ্ধাপরাধী ও মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি ক্ষমতায় ছিল। তারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে সম্পূর্ণরূপে বিকৃত করেছে। আমরা এমন কিছু করতে চাই যেন আগামী প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে পারে ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে চলতে পারে।’