শিশু ধর্ষণ ৩১ শতাংশ বেড়েছে, ৪৫,৪৮০ শিশু ক্ষতিগ্রস্ত

প্রতীকী ছবি

২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮১৮টি শিশু ধর্ষণের খবর প্রকাশিত হয়েছে। ২০২০ সালের তুলনায় যা ৩১ শতাংশ বেশি। বেশির ভাগ শিশু ধর্ষণ পারিবারিক পরিবেশে পরিচিতদের মাধ্যমেই হয়েছে। এক বছরে ধর্ষণচেষ্টা ১৫৪ শতাংশ এবং যৌন নির্যাতনের খবর প্রকাশিত হয়েছে ৫৮৮ শতাংশ বেশি। ওই এক বছরে বাল্যবিবাহের খবরে ৪২৬ গুণ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর তথ্য উঠে এসেছে। আটটি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত খবর সংকলিত করে এ তথ্য প্রকাশ করেছে বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ)।

আজ মঙ্গলবার সকালে ভার্চ্যুয়াল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ‘শিশু পরিস্থিতি প্রতিবেদন ২০২১’ প্রকাশ করে এমজেএফ। অনুষ্ঠানে বলা হয়, শিশু ধর্ষণ, হত্যা, যৌন নির্যাতন ও বাল্যবিবাহের হার উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। প্রকাশিত খবর অনুসারে, যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টা, সড়ক দুর্ঘটনা, অন্যান্য দুর্ঘটনা, অপহরণ, হত্যা, নির্যাতন, আত্মহত্যা, অপরাধে সংশ্লিষ্ট শিশু, নিখোঁজ ও পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু—মোট ১২টি শ্রেণিতে ২০২১ সালে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২ হাজার ৪২৬টি শিশু। ২০২০ সালে এ সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৪২০।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ৩৮ গৃহকর্মী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া চার গৃহকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে।

২০২১ সালে সারা দেশে ৮১৮টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে এবং ৯৪টি শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। ধর্ষণের শিকার হয়ে নিহত হয়েছে ১৪টি মেয়েশিশু। নানা কারণে হত্যার শিকার হয়েছে ১৮৩টি শিশু। যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১১০টি শিশু। ২০২০ সালে শিশু ধর্ষণের সংখ্যা ছিল ৬২৬, হত্যার শিকার হয়েছিল ১৪৫ শিশু। এ ছাড়া ২০২১ সালে ৪৩ হাজার ৫৪ শিশুর বাল্যবিবাহের খবর প্রকাশিত হয়েছে, যা ২০২০ সালে ছিল ১০১টি। সব মিলিয়ে ২০২১ সালে ১ হাজার ৮৮২টি প্রকাশিত খবরে বাল্যবিবাহসহ ৪৫ হাজার ৪৮০ শিশুর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার তথ্য উঠে এসেছে।
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন এমজেএফের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম। প্রতিবেদন তুলে ধরেন এমজেএফের সমন্বয়ক রাফেজা শাহীন।

২০২০ সালের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সব ধরনের শিশু নির্যাতন বেড়েছে। সব ধরনের পরিবারের শিশুরা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
শাহানা হুদা, এমজেএফের জ্যেষ্ঠ সমন্বয়ক (গণমাধ্যম ও যোগাযোগ)

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. মুহিবুজ্জামান বলেন, করোনার কারণে সরকারের সচেতনতা সৃষ্টিমূলক কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। অপরাধের বিপক্ষে সমাজকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রত্যেককে সম্মিলিতভাবে সচেতনতা সৃষ্টির কাজ করতে হবে। মানুষকে সচেতন করতে সরকারের ইতিবাচক কার্যক্রমও সমান গুরুত্ব দিয়ে পরিবেশনের জন্য সংবাদপত্রের প্রতি তিনি আহ্বান জানান। তিনি নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে মন্ত্রণালয়ের বহু খাতভিত্তিক প্রকল্পের তথ্য তুলে ধরে জানান, ১৫টি পত্রিকার খবর সংকলিত করে দেখা গেছে, ২০২১ সালে যৌন নির্যাতনের ১ হাজার ৯৪১টি এবং ১ হাজার ৯৪৭টি শারীরিক নির্যাতনের সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। যৌন নির্যাতনের ঘটনায় ৫২টি ও শারীরিক নির্যাতনের ঘটনায় ১ হাজার ৩২টি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরিবারের পরিচিত লোকদের মাধ্যমে ধর্ষণের শিকার হওয়া ছাড়াও প্রতিবেশীদের হাতে শিশুদের একটি বড় অংশ ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিশুর সর্বনিম্ন বয়স দুই বছর। বেশির ভাগ শিশু খেলতে গেলে খাবার বা অন্য কিছুর লোভ দেখিয়ে পরিচিত ব্যক্তিরাই ধর্ষণ করছে। কিশোরীরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে। স্কুল ও মাদ্রাসার ছাত্রীরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে শিক্ষক ও মাদ্রাসার হুজুরদের মাধ্যমে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ৩৮ গৃহকর্মী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া চার গৃহকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে।

অনুষ্ঠানে অতিথির বক্তব্যে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মাহবুবা বিলকিস বলেন, ২০১৫ সালে গৃহকর্মীদের সুরক্ষায় নীতিমালা করা হয়েছে। তবে সামাজিক সচেতনতা না থাকায় দুঃখজনকভাবে এ ধরনের নির্যাতন ঘটে চলছে। শিশুশ্রম নিরসনে সরকারের জাতীয় কর্মপরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বন্ধে সরকারের কর্মকাণ্ডে বিভিন্ন সংস্থাকেও যুক্ত হয়ে কাজ করতে হবে।

এমজেএফের জ্যেষ্ঠ সমন্বয়ক (গণমাধ্যম ও যোগাযোগ) শাহানা হুদা বলেন, ২০২০ সালের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সব ধরনের শিশু নির্যাতন বেড়েছে। সব ধরনের পরিবারের শিশুরা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। অনেক শিশু বুঝতেই পারে না যে তারা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।

এমজেএফের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, শিশুদের সুরক্ষায় অনেক ভালো ভালো আইন থাকলেও সরকারের পর্যবেক্ষণের ঘাটতি রয়েছে। পর্নোগ্রাফির কারণে সামাজিক অবক্ষয় বাড়ছে। এটা সার্বিকভাবে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলে। তিনি শিশু অধিকার রক্ষায় সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করার আহ্বান জানান।

আত্মহত্যা: পরীক্ষায় ফল বিপর্যয়, পরিবারের ওপর রাগ, ধর্ষণ বা শ্লীলতাহানির বিচার না পাওয়া

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আত্মহত্যার খবর প্রকাশিত হয়েছে ৭৮টি শিশুর। এর মধ্যে ৫৭টি ছেলেশিশু ও ২১টি মেয়েশিশু। মূলত পরীক্ষায় ফল বিপর্যয়, পরিবারের ওপর রাগ, প্রেম, উত্ত্যক্ত হয়ে, ধর্ষণ বা ধর্ষণচেষ্টার শিকার, ধর্ষণ বা শ্লীলতাহানির বিচার না পাওয়া এবং সাইবার অপরাধ ও প্রতারণার শিকার হয়েও আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। নবজাতক ফেলে যাওয়ার ৭৪টি খবর প্রকাশিত হয়েছে। পানিতে ডুবে মারা গেছে ৫৭০ শিশু। নিখোঁজ হয়েছে ৩৮ শিশু। ২০২০ সালে নিখোঁজ ও অপহরণের শিকার হয়েছে ২২টি শিশু।