শিশু প্রকল্পে আগ্রহ কম সরকারের

প্রায় দুই বছর পর গত মাসে স্কুল খুলেছে। বইয়ের ব্যাগ কাঁধে স্কুলগামী শিশুদের চলাচলের স্বস্তিদায়ক দৃশ্য ফিরে এসেছে। তবে এই দৃশ্যে শামিল হয়নি রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কিশোরটি (১৪)। করোনার আগে ২০২০ সালে একটি বেসরকারি সংস্থা শিশুটিকে মোহাম্মদপুরে শিশুকল্যাণ প্রাথমিক বিদ্যালয়–৫–এ প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করিয়ে দিলে মাত্র তিন মাস পড়ার সুযোগ পায় সে। করোনাকালে রিকশাচালক বাবা গাড়ি সারাইয়ের দোকানে কাজে লাগিয়ে দেন ছেলেকে। দুই বছরের বিরতিতে স্কুল এখন আর টানে না কিশোরকে। বাবা বললেন, ‘ও কাজও করে না। বখাটে হইয়া গ্যাছে, সারা দিন আড্ডা মারে, নেশা খায়।’

করোনার আঘাতে আগের চেয়েও সংকটে পড়া দরিদ্র পরিবারের শিশুদের ন্যূনতম সামাজিক সুরক্ষা এখন ঝুঁকির মুখে। যেসব মন্ত্রণালয় শিশুবিষয়ক প্রকল্প নেয়, তাদের অগ্রাধিকারেও নেই শিশুরা। ২০১৫ সালে শুরু হওয়া শিশু বাজেট বন্ধ রয়েছে দুই বছর ধরে। এই পরিস্থিতির মধ্যে আজ ১৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে পালিত হচ্ছে জাতীয় শিশু দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ‘বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের অঙ্গীকার, সকল শিশুর সমান অধিকার’।

করোনাকালে রিকশাচালক বাবা গাড়ি সারাইয়ের দোকানে কাজে লাগিয়ে দেন ছেলেকে। দুই বছরের বিরতিতে স্কুল এখন আর টানে না কিশোরকে। বাবা বললেন, ‘ও কাজও করে না। বখাটে হইয়া গ্যাছে, সারা দিন আড্ডা মারে, নেশা খায়।’

শিশুরা মন্ত্রণালয়গুলোর ‘ফোকাসে’ নেই

২০১৫–১৬ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো শিশু বাজেট হয়। সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৮০ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১৫ শতাংশ। করোনাকালের দুই বছর শিশু বাজেট বন্ধ রয়েছে।

শিশু বাজেট প্রতিবেদন ২০১৯–২০২০ অনুসারে, দেশে শিশুর সংখ্যা প্রায় ৬ কোটি ৬০ লাখ। শিশুদের জন্য প্রকল্প নেয়, এমন ১৫টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে শিশু বাজেটের আওতায় নেওয়া হয়।

কোভিডের কারণে ফোকাস সরে যাওয়ায় আলাদাভাবে শিশু বাজেট করা হয়নি। এখন মূল ফোকাস শিক্ষা, কৃষি ও স্বাস্থ্য। জেন্ডার ও শিশুবিষয়ক কাজে সমন্বয়ের দায়িত্ব মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের। এই সময়ে ব্যয় সংকোচন করে শিশুদের চাহিদার ভিত্তিতে কী ধরনের প্রকল্প নেওয়া যেতে পারে, সেই প্রস্তাব ওই মন্ত্রণালয় থেকে আসার কথা। সেটি আসেনি।
অর্থ বিভাগের (বাজেট–১ শাখা) যুগ্ম সচিব সিরাজুন নূর চৌধুরী

এর মধ্যে ৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রকল্পের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে এই প্রতিবেদক দেখেছেন, ২০২১–২২ অর্থবছরে সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের মাত্র ২৫ শতাংশ শিশুদের জন্য রয়েছে। কোনো কোনো মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প মাত্র একটি–দুটি। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে শিশুদের জন্য প্রকল্প বেশি থাকলেও বেশির ভাগই নির্মাণ অবকাঠামোগত।

এ মাসে পরিকল্পনা কমিশন প্রকাশিত ‘সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি ২০২১–২২’ প্রতিবেদন অনুসারে, ১ হাজার ৮০৭ কোটি টাকার সামাজিক সুরক্ষা খাতে (বিনিয়োগ ও কারিগরি) চার মন্ত্রণালয়ের ৬৫টি প্রকল্পের মধ্যে ১৬টি শিশুদের জন্য। এর মধ্যে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ৩৪টি প্রকল্পের মধ্যে শিশুদের জন্য ১১টি নির্ধারিত এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ২৫টি প্রকল্পের মধ্যে ৫টি শিশুদের জন্য। শিক্ষা খাতের ১২৫টি প্রকল্পের মধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ১২টির সব কটি শিশুর জন্য, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের ৭৮টির মধ্যে ৫টি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসাশিক্ষা বিভাগের ১৫টি প্রকল্পের মধ্যে ১টি শিশুদের জন্য। স্বাস্থ্য খাতের ৭৪টি প্রকল্পের মধ্যে সরাসরি শিশুর জন্য প্রকল্প ১৭টি। তবে এ দুটি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বাকি প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে শিশুরাও উপকারভোগী।

অর্থ বিভাগের (বাজেট–১ শাখা) যুগ্ম সচিব সিরাজুন নূর চৌধুরী বলেন, কোভিডের কারণে ফোকাস সরে যাওয়ায় আলাদাভাবে শিশু বাজেট করা হয়নি। এখন মূল ফোকাস শিক্ষা, কৃষি ও স্বাস্থ্য। জেন্ডার ও শিশুবিষয়ক কাজে সমন্বয়ের দায়িত্ব মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের। এই সময়ে ব্যয় সংকোচন করে শিশুদের চাহিদার ভিত্তিতে কী ধরনের প্রকল্প নেওয়া যেতে পারে, সেই প্রস্তাব ওই মন্ত্রণালয় থেকে আসার কথা। সেটি আসেনি।

এগোয় না কাজ

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) তথ্য অনুসারে, ২০২১-২২ অর্থবছরে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পগুলোর জন্য এডিপি বরাদ্দ ছিল ৮১৩ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। এ বছরের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে প্রায় ৩৪ শতাংশ।

‘সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (আরএডিপি) ২০২১-২২ প্রতিবেদন অনুসারে, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ৫টি প্রকল্পের মধ্যে ‘কিশোর-কিশোরী ক্লাব স্থাপন (১ম সংশোধিত)’ প্রকল্পটি গত জুন মাস পর্যন্ত ব্যয় করেছে ১৩ শতাংশ। ৬৪ জেলার ৪ হাজার ৫৫৩ ইউনিয়ন এবং ৩৩০টি পৌরসভায় মোট ৪ হাজার ৮৮৩টি ক্লাব স্থাপনের মাধ্যমে সৃজনশীল ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত করে কিশোর–কিশোরীদের সচেতন করা প্রকল্পের উদ্দেশ্য।

ওই প্রকল্পটির প্রকল্প পরিচালক ছিলেন জয়ন্ত কুমার সিকদার। সদ্য অবসরে যাওয়া এই কর্মকর্তা বলেন, আর্থিক অগ্রগতি কম হলেও প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি ৬০–৭০ ভাগ। করোনায় কার্যক্রম বন্ধ থাকায় টাকা খরচ হয়নি। এখন কর্মকাণ্ড চলছে, টাকাও খরচ হচ্ছে।

প্রকল্পের ধীরগতির ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের গাফিলতি নেই বলে উল্লেখ করেছেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (শিশু ও সমন্বয় শাখা) মো. মুহিবুজ্জামান। তিনি বলেন, প্রকল্প পরিকল্পনা, পর্যালোচনা, নির্মাণ প্রকল্পের ক্ষেত্রে দরপত্র, কেনাকাটা ইত্যাদি কারণে প্রকল্প শুরু করতে দেরি হয়। আর সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয় মন্ত্রণালয়কে। তিনি বলেন, শিশু বাজেট এখন ফোকাসে নেই। যা বরাদ্দ আছে, তা থেকেই শিশুদের জন্য ব্যয় করা হচ্ছে।

নতুন কার্যক্রম প্রয়োজন

ইউনিসেফের সহায়তায় কোভিডে শিশু পরিস্থিতি নিয়ে গবেষণা করছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। এ গবেষণার সঙ্গে যুক্ত সিপিডির বিশেষ ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, কোভিডের কারণে বড় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে শিশুরা। নতুন কিছু মাত্রা যোগ হয়েছে, যেমন বাল্যবিবাহ ও স্কুল থেকে ঝরে পড়ার ঘটনা ঘটেছে, কোভিডের কারণে মা–বাবা হারিয়ে এতিম হয়েছে অনেক শিশু। এ বিষয়গুলো মাথায় রেখে শিশু কার্যক্রমে মনোযোগ বাড়াতে হবে। চাহিদা নিরূপণ করে নতুন কার্যক্রম নেওয়া ও অর্থায়নের ব্যবস্থা রাখা উচিত।