শুঁটকি পেতে নির্বিচার হাঙর নিধন

হাঙরের শুঁটকি বিদেশে রপ্তানি হয়। মাছ ধরার ট্রলারের জালে আটকা পড়ে দেশ থেকে হাঙর বিলুপ্ত হচ্ছে।

দক্ষিণ উপকূলের জেলেরা বঙ্গোপসাগরে হাঙর শিকারে ঝুঁকে পড়ছেন। গভীর সাগরে বড়শি ও ইলিশের জাল দিয়ে বড় হাঙর এবং ছোট ফাঁসের জাল দিয়ে নির্বিচার ঝাঁকে ঝাঁকে বাচ্চা হাঙর শিকার করছেন জেলেরা। এসব হাঙর দিয়ে শুঁটকি তৈরি করা হচ্ছে, পাঠানো হচ্ছে বিদেশে।

ব্যাপকভাবে হাঙর নিধনের কারণে সামুদ্রিক প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, সামুদ্রিক মাছের ডিম থেকে লক্ষ-কোটি পোনা হলেও হাঙর ব্যতিক্রম। ১০ থেকে ১২ বছরে হাঙর পূর্ণবয়স্ক হয় এবং ২ থেকে ১৬টি বাচ্চা দেয়। এ কারণে হাঙরের সংখ্যা দ্রুত বাড়ে না। কিন্তু মাছ ধরার ট্রলারের জালে আটকা পড়ে হাঙর বিলুপ্ত হচ্ছে। যা পরিবেশ প্রতিবেশের জন্যও ক্ষতিকর।

বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন-২০১২ অনুযায়ী, হাঙর ও শাপলাপাতা মাছ হত্যা ও কেনাবেচা দণ্ডনীয় অপরাধ। এতে সর্বোচ্চ এক বছর কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।

বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে হাঙর ও শাপলাপাতা মাছের অর্ধেকের বেশি প্রজাতি অতিরিক্ত আহরণ ও নিধনের ফলে বর্তমানে হুমকির সম্মুখীন। ফলে বন্যপ্রাণী আইনে এ ধরনের বিপন্ন প্রজাতিগুলোকে সুরক্ষা দিতে হালনাগাদ তালিকায় হাঙর ও শাপলাপাতা মাছ অর্ন্তভুক্ত করা হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপকূলীয় জেলা বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার লালদিয়া, লাঠিমারা, রূপনগর; তালতলীর ফকিরহাট, সখিনা, লালুয়ারচর, নিশানবাড়িয়া খেয়াঘাটের এপার-ওপার; পটুয়াখালীর মহীপুর খালের গোড়াঘাটলা বালিরচর; বাগেরহাটের সুন্দরবনের দুবলার চর, কচিখালীসহ বিভিন্ন চরে ২০টির বেশি শুঁটকিপল্লিতে হাঙরের শুঁটকি তৈরি করা হচ্ছে।

জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শীত মৌসুমের শুরুতে বিশেষ করে নভেম্বরের শেষ দিকে বঙ্গোপসাগরে জেলেরা শীতকালে মাছ ধরার জন্য বড়শি ও বড় ফাঁসের (১২ ইঞ্চি ব্যাস) জাল নিয়ে শীতকালীন মাছ ভোল, মেদ, মোচন ধরতে সাগরে নামেন। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে হাঙরের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় জেলেরা হাঙর ধরার দিকে ঝুঁকে পড়েছেন।

জেলেরা বলছেন, মাছের চেয়ে হাঙরের ভালো দাম পাওয়ায় জেলেরা অধিক উৎসাহ নিয়ে হাঙর শিকার করছেন। জেলে ও শুঁটকি ব্যবসায়ীরা জানান, বিদেশে হাঙরের শুঁটকি, তেল, চামড়া, দাঁত, কান, পাখা, হাড়সহ অন্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চড়া মূল্যে বিক্রি হয়।

নাম প্রকাশ না করার শতে৴ পাথরঘাটা ও মহীপুরের অন্তত চারজন ব্যবসায়ী জানান, এ বছর বড় হাঙরের চেয়ে ছোট হাঙর বেশি ধরা পড়ছে। হাঙরের শুঁটকি চট্টগ্রাম হয়ে অস্ট্রেলিয়া, কোরিয়া, জাপান, তাইওয়ান, হংকংসহ বিশ্বের প্রায় ১০টি দেশ ও নগরে রপ্তানি হয়। তিনি আরও জানান, ‘এ’ গ্রেডের হাঙর (যে হাঙরের পাখনা ২১ ইঞ্চি লম্বা) প্রতিটি ২৮ থেকে ৩০ হাজার টাকা এবং ‘বি’ গ্রেডের হাঙর (পাখনার দৈর্ঘ্য ২১ ইঞ্চির নিচে) একেকটি ১৫ থেকে ১৮ হাজার টাকায় তাঁরা কেনেন।

সম্প্রতি বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার লালদিয়া ও রূপনগর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, অনেক কটি মাচায় হাঙরের শুঁটকি করা হচ্ছে। সেখানে বড় হাঙরের পাশাপাশি অগুনতি হাঙরের বাচ্চাও শুঁটকি করা হচ্ছে।

পাথরঘাটার লঞ্চঘাট–সংলগ্ন বিষখালী নদীর তীরে শুঁটকিপল্লিতে ঢুকতেই দেখা গেল, ছোট ছোট চাপালি মাছের শুঁটকি রোদে শুকানো হচ্ছে। তবে ওই চটের অদূরে নদীর পাশে দেখা গেল হাঙরের শুঁটকি শুকানো হচ্ছে।

পাথরঘাটার রূপনগর এলাকায় মদিনা ফিশারিজ নামে শুঁটকি উৎপাদনের একটি প্রতিষ্ঠানে বিপুলসংখ্যক বাচ্চা হাঙর শুঁটকি করা হচ্ছে। একই সঙ্গে মাচায় শুকানো হচ্ছে বড় হাঙর। এই প্রতিষ্ঠানের মালিক সিকদার মো. মাহবুব বলেন, ‘আমরা শুঁটকি তৈরি করে বিক্রির জন্য

চট্টগ্রামে পাঠাই। বাচ্চা হাঙরের শুঁটকি প্রতি কেজি ৬০০ টাকায় এবং বড় হাঙরের শুঁটকি ৯০০ টাকায় বিক্রি হয়।’

পাথরঘাটা লঞ্চঘাট–সংলগ্ন বিষখালী নদীর তীরে গত ১ জানুয়ারি শুঁটকিপল্লি থেকে ১২ মণ হাঙর জব্দ করে পাথরঘাটা কোস্টগার্ড ও ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ ঘটনায় দুজনকে আটক করা হয়। পরে তিন হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

পাথরঘাটায় শুঁটকি পরিবহনের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ করলে তাঁরা জানান, বছর তিনেক আগে পাথরঘাটা উপজেলা থেকে ৭ থেকে ৮ মেট্রিক টন হাঙরের শুঁটকি চালান হতো। এখন সেটা বেড়ে ১৬ থেকে ২০ মেট্রিক টনে ঠেকেছে। এ ছাড়া সুন্দরবন, বরগুনা, পটুয়াখালীর মহীপুরে কয়েক গুণ বেশি শুঁটকি উৎপাদন করা হয়। বর্ষার আগে-পরে চার মাস ছাড়া বাকি আট মাসই হাঙরের শুঁটকি তৈরি হয় এ অঞ্চলে।

কোস্টগার্ডের দক্ষিণ অঞ্চলের গণমাধ্যম কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট শাফিউল ইকবাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রায় দুই মাস আগে নিষিদ্ধ হাঙরের বিরুদ্ধে আমরা একটি অভিযান চালিয়েছিলাম। তবে হাঙরের সুনির্দিষ্ট তথ্য পেলে আরও অভিযান করা হবে।’

মৎস্য ও প্রাণী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমুদ্রের বাস্তুসংস্থানে হাঙর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। হাঙর মূলত বড় আকারের শিকারি মাছ ও সিল খায়। যেসব মাছ খাদ্যের জন্য অপেক্ষাকৃত ছোট আকৃতির মাছ ও পোকার ওপর নির্ভরশীল। ওই ছোট মাছগুলোর খাদ্য বিভিন্ন উদ্ভিতকণা বা শেওলা। হাঙর না থাকলে বড় আকৃতির শিকারি মাছ ও সিলের সংখ্যা বেড়ে যাবে। এগুলো ছোট মাছ ও পোকা খাওয়া শুরু করবে, ফলে ছোট মাছ ও পোকার সংখ্যা কমে যাবে। সামুদ্রিক উদ্ভিদকণা বা শেওলার ওপর নির্ভরশীল মাছ ও পোকার সংখ্যা কমে গেলে শেওলার পরিমাণ বহু গুণ বেড়ে যাবে। এসব শেওলা সমুদ্রের তলদেশে সূর্যালোক প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করবে। ফলে ব্যাপক ভারসাম্যহীনতা দেখা দেবে সামুদ্রিক প্রতিবেশে।

হাঙ্গরের গুরুত্ব সম্পর্কে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ, অ্যাকুয়াকালচার অ্যান্ড মেরিন সায়েন্স অনুষদের প্রভাষক ও ওয়ার্ল্ড ফিশের সাবেক গবেষক মীর মোহাম্মদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, সামুদ্রিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় হাঙর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নির্বিচার হাঙর নিধন করা হচ্ছে। সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য অক্ষুণ্ন রাখতে আইনের যথাযথ প্রয়োগ করে হাঙর রক্ষায় উদ্যোগ প্রয়োজন।