শুধু মাছ থেকে বছরে আয় ১ কোটি ৯০ লাখ টাকা

বিশাল মাঠ। এর উত্তর পাশ থেকে শুরু হয়েছে একের পর এক পুকুর। এসব পুকুরে চাষ করা হচ্ছে নানা প্রজাতির মাছ। মাঠে হচ্ছে ধানের আবাদ। পুকুরের পাড়ে অসংখ্য টমেটো ও মিষ্টিকুমড়ার গাছ। গত বছর শুধু মাছ বিক্রি করে আয় হয়েছে ১ কোটি ৯০ লাখ টাকা।
নড়াইলের কালিয়া পৌরসভার ভক্তডাঙ্গা বিলে এই খামার করেছেন শিবনাথ রায়। তিনি ১৯৯৯ সাল থেকে টানা তিনবার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের নির্বাচিত কাউন্সিলর। বাড়ি উপজেলার ছোট কালিয়া গ্রামে। পৌরসভার গোবিন্দনগর এলাকায় ভক্তডাঙ্গা বিলে ২২৭ একর জমিতে চলছে এই চাষবাস। মাছ ও ধান চাষের পাশাপাশি উৎপাদিত হচ্ছে সবজি।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ সবে শুরু হয়েছে। একদিন তাঁর বাবা কুমুদ রায়কে স্থানীয় রাজাকারেরা ধরে নিয়ে যায়। পরে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে তুলে দেয়। সেনারা গুলি করে মেরে তাঁর বাবার লাশ নবগঙ্গা নদীতে ভাসিয়ে দেয়। শিবনাথের বয়স তখন মাত্র ১১ বছর ৮ মাস। দুই বোন ও মায়ের সঙ্গে পালিয়ে ভারতে যান। দেশ স্বাধীন হলে ১৯৭২ সালে ফিরে আসেন কালিয়ায়। শিবনাথের বাবা ছিলেন বর্গাচাষি। বাবার অবর্তমানে সংসারের হাল শিবনাথকে ধরতে হবে। কালিয়া-দৌলতপুর-খুলনা যাত্রাপথে লঞ্চে ফেরি করে কলা ও চানাচুর বিক্রি করতেন। একদিন শিশু শিবনাথকে দেখে লঞ্চের যাত্রী বড়দিয়ার নিত্যান সাহার মায়া হয়। বড়দিয়ায় নিয়ে শিবনাথকে স্কুলে ভর্তি করে দেন। বাড়িতে কাজ করার জন্য বেতনও দেন। এভাবে কাটে সাত বছর। সেখানে পড়াশোনা হয় অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। বেতনের টাকায় জমান ১৬ হাজার ৬০০ টাকা। এই পুঁজি নিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। শুরু করেন ভুসিমালের ব্যবসা। পাশাপাশি কিছুদিনের মধ্যেই দুই একর জমি ইজারা নিয়ে শুরু করেন চিংড়ি চাষ। চার বছর পর আট একর জমি কেনেন। সেখানেও চাষ করেন চিংড়ি। দুই বছর আগে ভক্তডাঙ্গা বিলে ২২৭ একর জমি ইজারা নেন। এ জন্য জমির মালিকদের প্রতিবছর ২৮ লাখ ৬০ হাজার টাকা দিতে হয়। এই বিলের জমি এক ফসলি। শুধু আমন ধানের আবাদ হয়। এ কারণে জমির মালিকেরাও খুশি।
এই খামারে গলদা চিংড়ি, রুই, কাতলা, তেলাপিয়া, পুঁটিসহ নানা প্রজাতির মাছের চাষ হয়। প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ মণ মাছ ট্রাকে করে নেওয়া হয় বাগেরহাটের ফকিরহাট আড়তে। স্থানীয়ভাবেও কিছু মাছ বিক্রি হয়। বর্তমানে প্রতিদিন প্রায় ৫০ মণ টমেটো ও ২০ মণ মিষ্টিকুমড়া তুলছেন। গ্রীষ্ম মৌসুমে খামারে চাষ হয় করলা, শসা, ঝিঙে ও লাউ। প্রতিদিন গড়ে ৫০ মণ করলা, ৫০ মণ শসা, ২০ মণ ঝিঙে এবং ১ হাজার লাউ তোলেন। এসব বিষমুক্ত সবজি স্থানীয় বাজার ছাড়াও নড়াইল, মাগুরা, যশোর, খুলনা, সাতক্ষীরা, গোপালগঞ্জ, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয়।
শিবনাথ বলেন, তিনি গত বছর ৬৬ লাখ টাকার সবজি বিক্রি করেছেন। মাছ বিক্রি করে আয় করেছেন ১ কোটি ৯০ লাখ টাকা। তিন ভাগের দুই ভাগ ধান বর্গাচাষিদের দিয়েছেন। বর্গা বাদ দিয়ে তিনি ২ হাজার মণ ধান পেয়েছেন। ৭০ থেকে ৮০টি পরিবার এই খামারে বর্গাদার। সার্বক্ষণিক মাছ ও সবজির পরিচর্যা করেন ২২ জন। যখন কাজের চাপ বাড়ে, তখন থাকেন ৪০-৫০ জন। এই খামারের মাছ ও সবজি নিয়ে সরাসরি বিক্রি করেন অনেকে। পরিবহনের কাজে সঙ্গে যুক্ত আছে আরও কয়েকটি পরিবার। এসব মিলিয়ে প্রায় দেড় শ পরিবার এই খামার থেকে নানাভাবে লাভবান হচ্ছে।
কৃষি বিভাগের নড়াইল কার্যালয়ের উপপরিচালক আমিনুল হক বলেন, শিবনাথের এই বিশাল কর্মযজ্ঞ দেখে এলাকার অনেকেই উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। তাঁরাও প্রস্তুতি নিচ্ছেন এ ধরনের খামার গড়ার।