শ্বেতীর ‘লজ্জা’ দূরে ঠেলে তাহিয়ার পথচলা

তাহিয়াতুল জান্নাত
ছবি: সংগৃহীত

‘প্রচণ্ড গরমেও ফুলহাতা জামা পরতাম, আমার হাতগুলো তো অন্যদের হাতের মতো ছিল না। ছোটবেলায় নিজেকে নিজে দেখতেও বাজে লাগত। আমার স্কুলজীবনের কোনো ছবি নেই, একটা-দুইটা যাও ছিল, তা অনেক আগেই ছিঁড়ে ফেলেছি। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় অনেকে আমাকে দেখে ভূত ভূত বলে চিৎকার করত। এতে আমি লজ্জা পেতাম। তবে আমি যে লজ্জা পেতাম, তা প্রকাশ করতাম না। শুধু ভেতরে-ভেতরে ভেঙে পড়তাম।’

কথাগুলো স্নাতক (সম্মান) পড়ুয়া শিক্ষার্থী তাহিয়াতুল জান্নাতের। ছোটবেলা থেকেই তাহিয়ার সারা শরীর ধবধবে সাদা, মুখের কিছু জায়গা শুধু কালো বা তা অন্যদের মতো কালচে রঙের। তাহিয়ার চামড়ায় যে সমস্যা হয়েছে, চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় তাকে শ্বেতী রোগ বলা হয়। শ্বেতী ছোঁয়াচে রোগ নয়। এই রোগ সম্পর্কে কুসংস্কার ও ভুল ধারণা আছে মানুষের মধ্যে।

তাহিয়া বললেন, ‘এখন সব সয়ে গেছে। অনেকের মধ্যে সচেতনতাও বেড়েছে। তারপরও রোগটি ছোঁয়াচে কি না এ ভয়ে অনেকে কাছে আসতে চান না। আমার সঙ্গে ছবি তুলতে চান না। আমাকে এড়িয়ে চলেন। মেয়েকে বিয়ে দিতে পারবে না—এ নিয়ে মাকে কথা শোনায়।’

চারপাশের সব ধরনের প্রতিকূলতা দূরে ঠেলে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন তাহিয়া। নিজেই মাঠে নেমেছেন এ অচলায়তন ভাঙতে। দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, ‘এখন আমি ঘুরে দাঁড়িয়েছি। গায়ের রঙের তারতম্যের হিসাব, মোটা না শুকনা—এগুলো নিয়ে কথা বলা যত দিন বন্ধ না হবে, তত দিন আমাদের মুক্তি মিলবে না—এ তথ্য প্রচার করে সচেতনতা তৈরি করছি। আমি নিজেকে লুকিয়ে না রেখে মাঠঘাট দাপিয়ে কাজ করছি।’

তাহিয়া নন্দিতা সুরক্ষা নামক একটি সংগঠন গড়ে তুলেছেন। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকেই সাবান ও মাস্ক বিতরণ, স্যানিটারি ন্যাপকিন ও অন্তর্বাস, ওষুধ বিতরণসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন আয়োজিত দেশসেরা ১০ জনের মধ্যে একজন হিসেবে করোনাকালীন মানবিক যোদ্ধা পদক পেয়েছেন।

আরভি ফাউন্ডেশনের ‘হিরো অ্যাওয়ার্ড’সহ পেয়েছেন অন্যান্য সম্মাননা। তিন বছর ধরে ‘হাসি মুখ পাঠশালা’ নামে একটি পাঠশালা পরিচালনা করেছেন। এতে হরিজনপল্লির শিশুরা বিনা মূল্যে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। অনলাইনেও বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।

নারী ও শিশুদের মধ্যে স্যানিটারি ন্যাপকিন বিতরণ করছেন তাহিয়াতুল জান্নাত
ছবি: সংগৃহীত

তাহিয়া বললেন, ‘একদিকে আমার গায়ের সাদা চামড়া নিয়ে মানুষ একধরনের অস্বস্তিতে থাকে, অন্যদিকে আমি বিনা মূল্যে নারীদের আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণের আয়োজন করি। যৌন সহিংসতা প্রতিরোধে শিশুদের শরীরে অনিরাপদ স্পর্শ সম্পর্কে সচেতন করি। মাসিকের মতো বিষয় নিয়ে কথা বলি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাসিক সুরক্ষা ব্যাংক স্থাপনও করেছি। ফলে এখন আর মানুষ আমার সামনে আমাকে নিয়ে সরাসরি কোনো কথা বলার সাহস পায় না।’

তাহিয়া ঝালকাঠির মেয়ে। বর্তমানে মায়ের জন্মস্থান ফরিদপুরে থাকেন। দুই বোনের মধ্যে তাহিয়া বড়। ছোট বোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

তাহিয়া বললেন, ‘এ জীবনে অনেক অপমান আমি এবং আমার পরিবার সহ্য করেছি।

একজনের সঙ্গে দীর্ঘদিন সম্পর্ক এবং বিয়ের কথা প্রায় পাকাপাকি পর্যায়ে ওই ছেলে আমাকে জানিয়েছে, সে আমাকে বিয়ে করতে পারবে না। বিয়ে করে সবার সামনে আমাকে উপস্থাপন করতে পারবে না। তবে মনের জোরে খুব সামান্য হলেও সমাজে আমি আমার একটি অবস্থান তৈরি করতে পেরেছি। আর একটি জায়গা তৈরি করতে পেরেছি বলেই এখন আমাকে নিয়ে, আমার পরিবারকে নিয়ে সামনে এসে কেউ কথা বলার সাহস পায় না। আমি আমার অবস্থান তৈরি করতে না পারলে এ অবস্থায় আসা সম্ভব হতো না। আমি আমার মতো সমস্যা নিয়ে যারা আছে তাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। যাদের পাচ্ছি তাদের কাউন্সেলিং করি।’

তাহিয়া বললেন, ‘আমি মানুষকে বোঝাতে চাই বডি শেইমিং করে কাউকে দমিয়ে রাখা যায় না। প্রথমে কাজ করতে গিয়ে পরিবার থেকে শুরু করে সমাজের প্রায় প্রতি পদে পদে বাধা পেয়েছি। তবে আস্তে আস্তে পরিস্থিতি পাল্টাচ্ছে। এখন পরিবার থেকে সহায়তা পাই। জেলা প্রশাসকসহ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের অনেকেই আমার কাজ নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করছেন বা বিভিন্ন ভাবে সহায়তা করছেন। ২০১৯ সালে জেলা প্রশাসকের কাছে একটি প্রকল্পের প্রপোজাল জমা দিই। জেলা প্রশাসকের অনুমোদন পেয়ে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুযোগ পাই।’

তাহিয়া ২০১৬ সাল থেকে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছেন। এমনিতে শারীরিক কোনো সমস্যা না হলেও রোদে গেলে চামড়ায় ফোসকা পড়ে যায় বলে জানালেন।

বিভিন্ন কাজে আর্থিক সহায়তা কোথায় পাচ্ছেন এ প্রসঙ্গে তাহিয়া বললেন, ‘সচেতনতামূলক কার্যক্রমে তেমন কোনো টাকাপয়সা লাগে না। আর হাসিমুখ পাঠশালার কাজে সন্তুষ্ট হয়ে বন্ধু, স্বজনদের অনেকেই সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। এভাবেই একটু একটু করে সামনে আগাচ্ছি।’

বাংলাদেশে জাতীয় শ্বেতী ফাউন্ডেশন নামে একটি ফাউন্ডেশন শ্বেতী রোগ নিয়ে সামাজিক কুসংস্কার প্রতিরোধে কাজ করছে। চিকিৎসকদের মতে, রং তৈরি করার কোষ অকার্যকর হলে ত্বকের রং বিবর্ণ হয়ে যায়, এটাই শ্বেতী। শ্বেতী হলে তা শরীরের অন্য কোনো অঙ্গে বিরূপ প্রভাব ফেলে না। করমর্দন, আলিঙ্গন বা অন্য কোনোভাবে এই রোগ সংক্রমিত হয় না। তবে নারী মা হলে সন্তানের বেলায়ও এ রোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

শিকদার মেডিকেল কলেজের চর্ম ও যৌনরোগ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মহসীনা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘শ্বেতী ছোঁয়াচে রোগ নয়। আর এখন পর্যন্ত এ রোগ কেন হচ্ছে তার নির্দিষ্ট কারণও নির্ণয় হয়নি। রোগী বিশেষ করে নারী রোগী হলে সমাজ ও পরিবারের বেশির ভাগ মানুষের মনমানসিকতার কারণে নানান ঝামেলা পোহাতে হয়।’

বেদে পরিবারের সঙ্গে তাহিয়াতুল জান্নাত
ছবি: সংগৃহীত

বিশ্বব্যাপী সামাজিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে কাজ করছে বৈশ্বিক সংগঠন হিউম্যান লাইব্রেরি। হিউম্যান লাইব্রেরি, ঢাকার ফেসবুক পেজে সমাজের প্রচলিত নেতিবাচক চিন্তাভাবনার অবসান ঘটিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলা নারীদের জীবনের গল্পে তাহিয়ার গল্পটিও তুলে ধরেছে।

তাহিয়া হাসি মুখেই বললেন, ‘আগে আমি নিজেও গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে নিজের জীবনের গল্প বলতে ভয় পেতাম। এখন মনে হয়, সবাই আমার সংগ্রামের গল্পটি জানুক। আমার গল্প থেকে একজনও যদি সচেতন হয়, সেটাই হবে বড় পাওয়া।’

বাংলাদেশে জাতীয় শ্বেতী ফাউন্ডেশন নামে একটি ফাউন্ডেশন শ্বেতী রোগ নিয়ে সামাজিক কুসংস্কার প্রতিরোধে কাজ করছে। চিকিৎসকদের মতে, রং তৈরি করার কোষ অকার্যকর হলে ত্বকের রং বিবর্ণ হয়ে যায়, এটাই শ্বেতী। শ্বেতী হলে তা শরীরের অন্য কোনো অঙ্গে বিরূপ প্রভাব ফেলে না। করমর্দন, আলিঙ্গন বা অন্য কোনোভাবে এই রোগ সংক্রমিত হয় না। তবে নারী মা হলে সন্তানের বেলায়ও এ রোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

শিকদার মেডিকেল কলেজের চর্ম ও যৌনরোগ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মহসীনা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘শ্বেতী ছোঁয়াচে রোগ নয়। আর এখন পর্যন্ত এ রোগ কেন হচ্ছে তার নির্দিষ্ট কারণও নির্ণয় হয়নি। রোগী বিশেষ করে নারী রোগী হলে সমাজ ও পরিবারের বেশির ভাগ মানুষের মনমানসিকতার কারণে নানান ঝামেলা পোহাতে হয়।’

বিশ্বব্যাপী সামাজিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে কাজ করছে বৈশ্বিক সংগঠন হিউম্যান লাইব্রেরি। হিউম্যান লাইব্রেরি, ঢাকার ফেসবুক পেজে সমাজের প্রচলিত নেতিবাচক চিন্তাভাবনার অবসান ঘটিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলা নারীদের জীবনের গল্পে তাহিয়ার গল্পটিও তুলে ধরেছে।

তাহিয়া হাসি মুখেই বললেন, ‘আগে আমি নিজেও গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে নিজের জীবনের গল্প বলতে ভয় পেতাম। এখন মনে হয়, সবাই আমার সংগ্রামের গল্পটি জানুক। আমার গল্প থেকে একজনও যদি সচেতন হয়, সেটাই হবে বড় পাওয়া।’