শ্রীলঙ্কার পথে এগিয়ে দেওয়ার বাজেট: সংসদে রুমিন ফারহানা

রুমিন ফারহানা
ফাইল ছবি

প্রস্তাবিত বাজেট ‘বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কার পথে কয়েক ধাপ এগিয়ে দেওয়ার বাজেট’ আখ্যা দিয়েছেন বিএনপি থেকে সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা। অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে রুমিন বলেন, দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে শ্রীলঙ্কা হওয়ার মতো সব কটি ঝুঁকিপূর্ণ ফ্যাক্টর দেশে বিরাজমান। প্রস্তাবিত বাজেট সেগুলোকে আরও ত্বরান্বিত করবে।

আজ রোববার জাতীয় সংসদে ২০২২–২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে আলোচনায় অংশ নিয়ে রুমিন ফারহানা এসব কথা বলেন।

রুমিন ফারহানা বলেন, বিভিন্ন উপসর্গের পাশাপাশি শ্রীলঙ্কার আজকের অবস্থার মূল কারণ রাজাপক্ষে ভাইদের স্বৈরাচারী মানসিকতা। বাংলাদেশেও এখন সব কটি ঝুঁকি বিরাজমান। সবকিছুর সঙ্গে বিদ্যমান আছে আসল বিষয়টিও। জনগণের ভোটে নির্বাচিত না হয়েও একের পর এক টার্ম ক্ষমতায় থাকার ফলে বাংলাদেশে একটি চরম কর্তৃত্ববাদী অলিগার্কি বা গোষ্ঠীতন্ত্র কায়েম হয়েছে।

বাজেটের সমালোচনা করে রুমিন বলেন, ‘অর্থমন্ত্রী বাজেটের শিরোনাম করেছেন “কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবর্তন”; আর আমি মনে করছি এই বাজেট “শ্রীলঙ্কা হবার পথে কয়েক ধাপ এগিয়ে দেওয়ার বাজেট”।’
অর্থনীতিবিদদের বক্তব্য উদ্ধৃত করে রুমিন বলেন, বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার হওয়ার মতো ঝুঁকি অবশ্যই আছে। সতর্ক না হলে বাংলাদেশ দ্রুতই শ্রীলঙ্কা হবে। সেটি ঠেকানোর চেষ্টা দূরে থাকুক, বাজেটে মুদ্রাস্ফীতি, টাকার মানের অবমূল্যায়ন, রিজার্ভ কমতে থাকা, বিনিয়োগে স্থবিরতা, কর্মসংস্থান—এসব বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই।

বিএনপির এই সংসদ সদস্য আরও বলেন, শ্রীলঙ্কার পর্যালোচনায় যখন বাংলাদেশ প্রসঙ্গ এসেছে, তখন কয়েকজন অর্থনীতিবিদ তাঁদের স্বার্থের চিন্তায় বা স্রেফ ভয়ে বলেছেন, বাংলাদেশের শ্রীলঙ্কার মতো সমস্যায় পড়ার কোনো আশঙ্কাই নেই। তবে এই আকালেও হাতে গোনা কিছু অর্থনীতিবিদ জানিয়েছেন বাংলাদেশের অবশ্যই সেই ঝুঁকি আছে এবং বাংলাদেশ এখনই যদি খুব সতর্ক না হয়, তাহলে দ্রুতই বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতিতে পড়তে পারে।

অর্থমন্ত্রীর সমালোচনা করে রুমিন বলেন, অর্থমন্ত্রী বলেছেন, তিনি গরিব ছিলেন তাই গরিবের কষ্ট বুঝতে পারেন। আগে গরিব থাকলেও অর্থমন্ত্রী এখন যে শুধু ধনী হয়েছেন, তা নয়, তিনি এখন আওয়ামী লীগের অর্থমন্ত্রী। তাঁর গরিবের কষ্ট বুঝতে পারার কথা নয়।

রুমিন বলেন, অবৈধভাবে পাচার করা অর্থ প্রশ্নাতীতভাবে দেশে ফিরিয়ে আনার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কেউ দেশে টাকা ফিরিয়ে আনবে না। কিন্তু যদি কোনো দেশে ধরপাকড় শুরু হয় তখন যেন দেশে টাকা ফিরিয়ে আনতে পারেন, সে জন্য এই ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এটি পাচারকারীদের উৎসাহী করবে। দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, টাকা পাচারবিরোধী আইন ও সংবিধানে টাকা পাচার নিষিদ্ধ। অর্থমন্ত্রী এক বছর আগে সংসদে বলেছিলেন, কারা টাকা পাচার করে, তিনি জানেন না।

করোনা ও রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে বিভিন্ন দ্রব্যের দাম বেড়েছে, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় পরিবহন খরচ বেড়েছে। দেশে আমদানি খরচ বাড়বে স্বাভাবিক। কিন্তু এক মাসে ৪ বিলিয়ন ডলার থেকে আমদানি ব্যয় ৭–৮ বিলিয়ন ডলারে বেড়ে যাওয়ার কোনো যুক্তি নেই। ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে বড় অঙ্কের টাকা পাচার হয়েছে। সরকারের অতিগুরুত্বপূর্ণ লোকজন এই পাচারের সঙ্গে জড়িত বলে রুমিন অভিযোগ করেন।

দেশের ঋণ বিপৎসীমা পেরিয়েছে। সরকারের বড় প্রকল্পগুলোর সমালোচনা করে রুমিন ফারহানা বলেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে সর্বোচ্চ বরাদ্দ। এই প্রকল্প নেওয়া কোনোভাবেই যৌক্তিক ছিল না। এটি ভয়ংকর ঝুঁকি তৈরি করছে।
এ ছাড়া পদ্মা রেল সেতু, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর, কক্সবাজার–রামু রেললাইন প্রকল্প, দ্বিতীয় পদ্মা সেতু, বুলেট ট্রেন, দ্বিতীয় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট প্রকল্প এগুলোকে অপ্রয়োজনীয় হিসেবে চিহ্নিত করেন তিনি।

রুমিন বলেন, বিদেশি ঋণের পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এবং আরও কিছু প্রয়োজনীয় প্রকল্পের সব কটিতে লুটপাট আর বাস্তবায়নের দীর্ঘসূত্রতার কারণে ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে অনেক বেশি। ফলে সেগুলো প্রত্যাশিত অর্থনৈতিক উপযোগিতা দেওয়া দূরে থাকুক, পরিণত হবে শ্বেতহস্তীতে। যেভাবে বিদেশি ঋণনির্ভর একের পর এক মেগা প্রকল্পের কাজ হাতে নেওয়া হচ্ছে, তাতে সামনের পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে। অনেকগুলো বড় ঋণের গ্রেস পিরিয়ড চলছে এখন। যা শেষ হলে ঋণ পরিশোধের চাপ আরও বাড়বে। সঙ্গে নতুন যুক্ত হতে থাকা সব ঋণের গ্রেস পিরিয়ড শেষে অনেক বেশি বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে হবে।

সরকার জিডিপির পরিমাণ বাড়িয়ে দেখায় দাবি করে রুমিন বলেন, জিডিপির আকার বাড়িয়ে দেখালে জিডিপির অনুপাতে ঋণের পরিমাণ কম দেখা যায়। বর্তমানে সরকারি হিসাবে দেখা যাচ্ছে, জিডিপির অনুপাতে ঋণ ৪৫ শতাংশ পার হয়েছে। জিডিপির সঠিক হিসাব হলে দেখা যাবে, এটা সম্ভবত ৭০ শতাংশে পৌঁছে গেছে। বাংলাদেশের ঋণ বিপৎসীমা পার হয়ে গেছে। এবারের বাজেটে জনগণের করের টাকার এক–পঞ্চমাংশই যাবে ঋণের সুদ পরিশোধের পেছনে।

পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনার প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য আহসান আদেলুর রহমান। তিনি বলেন, প্রস্তাবিত বাজেট অর্থ পাচারকারীবান্ধব। এটি জাতির আশা–আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। অর্থ পাচারকারীদের ‘ইজি এক্সিট’ দেওয়া ভুল হবে। এতে অর্থ পাচারকারীরা উৎসাহী হবে।

পাচার আরও বেড়ে যাবে। আগে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে লাভ হয়নি।
জাতীয় পার্টির এই সংসদ সদস্য আরও বলেন, রাজস্ব ঘাটতি পূরণে বাজেটে কিছু বলা নেই। করোনা, রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ, অর্থনৈতিক মন্দা, মুদ্রাস্ফীতি—এসব বিষয় বাজেটে বিবেচনা করা হয়েছে কি না সন্দেহ আছে। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে কোনো পরিকল্পনা নেই। সরকার ব্যাংক থেকে বিশাল ঋণ করবে, এতে বেকারত্ব বাড়বে, তারল্যসংকট বাড়বে। এ বাজেট ব্যবসাবান্ধব, জনবান্ধব নয়।