সংকটময় করোনাকাল জয় হোক মানবতার

নতুন, ঝকঝকে, পরিছন্ন, প্রাণবন্ত কোনো কিছু দেখলে আমরা আবালবৃদ্ধবনিতা আকৃষ্ট হই। সে হতে পারে আজ জন্মগ্রহণ করা শিশুটি, শীতে জীর্ণ হয়ে যাওয়া বৃক্ষের নতুন কোমল পল্লব অথবা নতুন যেকোনো কিছু আমাদের মনকে-চিত্তকে প্রসন্ন করে। অন্ততপক্ষে কিছুক্ষণের জন্য হলেও আমাদের ক্লান্তি দূর করে দেয়। নিজের অলক্ষ্যে এই শেষ বসন্তে নবরূপে সজ্জিত প্রকৃতির নয়নাভিরাম রূপ দেখে পুলকিত হয়েছি। ক্ষণকালের জন্য হারিয়ে গিয়েছিলাম প্রকৃতির এ নরম কোমল পেলবতার মাঝে।

গাড় সবুজ কচি পল্লবে বৃক্ষশাখা নববধূর মতো ঘোমটা দিয়ে আছে সবুজ গালিচায় মোড়া দীর্ঘ আঙিনায়, তারই ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে কুঁড়ি আর সদ্য ফোটা ফুল। সেসব ফুলে আনাগোনা করছে মধুমক্ষীকা, ভ্রমরসহ নানা পতঙ্গ। নতুন ফোটা এসব ফুল থেকে প্রাণভরে মধু আহরণ করছে, একই ফুল থেকে আবার কেউ বিষ আহরণে ব্যস্ত। প্রকৃতির এ খেলা চলে আসছে যুগ যুগ ধরে।

বসন্তের এ নবসকালে নিজ ছাদের কাছে লকলক করে বেড়ে ওঠা পেয়ারাগাছের ডাগর কচি কিশলয় দেখে চিত্ত প্রশান্তির সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুই মনে হলো। আনন্দ-বেদনা, হারানো-প্রাপ্তি অনেক কিছুই। আজ যেখানে নতুন মনোমুগ্ধকর পত্র জন্মেছে। দুদিন আগেও সেখানে পুরোনো ও জীর্ণ পত্র ছিল।

সময়ের প্রয়োজনে নিজ দায়িত্ব পালন করে প্রকৃতি থেকে তারা বিদায় নিয়েছে। তাদের স্থান নিয়েছে নতুনেরা, নতুন কুঁড়ি অর্থাৎ আগামী প্রজন্মের সম্ভাবনা নিয়ে। এদেরও সহ্য করতে হবে নানা প্রতিকূল পরিবেশকে, খরা, ঝড়, পোকা, ব্যাকটেরিয়া কিংবা অজানা কোনো ভাইরাসের আক্রমণকে। সবকিছুর সঙ্গে সংগ্রাম করে টিকে থাকার কী প্রচেষ্টাই না এদের। নতুন জন্ম, সংগ্রাম, টিকে থাকা তারপর নিজ দায়িত্ব শেষে প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যাওয়া।

প্রকৃতির সঙ্গে মানবজীবনের কতই না সাদৃশ্য। নতুন ফুটফুটে মানবশিশু, ক্রমান্বয়ে তার বেড়ে ওঠা। পরিবার, সমাজ, জাতি ও দেশ গঠন। তারপর আবার প্রকৃতির মাঝে সমাহিত হওয়া। আর এ চিরবিদায়ের মধ্যে যেটুকু অমর হয়ে থাকে, তা হলো সমাজ, দেশ তথা জাতির কল্যাণের জন্য করে যাওয়া মহান কাজ। মৃত্যু তো অমোঘ সত্য। অন্ধ হলে যেমন প্রলয় বন্ধ থাকে না, তেমনি মৃত্যুর ভয়ে ভীত হয়ে বসে থাকলেই তার হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না।

আজ এ করোনাকালে (কোভিড-১৯) আমরা অনেকেই মৃত্যুর ভয়ে ভীত হচ্ছি। ভাবছি, আমার কী হবে? আগামীর বলিটা কি আমাকে দিয়েই হবে? এ রকম কত চিন্তা। এসব চিন্তার কারণ আর কিছুই নয়, নিজ মৃত্যুর ভয়, নিজ পরিবাকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করার ভয়।

মহান সৃষ্টিকর্তা কারও সঙ্গেই পক্ষপাতিত্ব করেন না। কি মহারাজা কি সহায়–সম্বলহীন প্রজা—সবাইকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতেই হবে। তাঁর হাত থেকে কেউই নিস্তার পাবে না। কিন্তু তিনি যে মহান জ্ঞান আমাদের দান করেছেন, তার প্রয়োগ সুনিশ্চিত করে আমরা নিজের সুরক্ষা করার চেষ্টা তো করতেই পারি। করোনা প্রতিরোধের নিয়মগুলো, যা আমরা এত দিনে ঠোঁটস্থ করে ফেলেছি, এখন তার প্রয়োগ অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। কেভিড-১৯ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে স্বাস্থ্যঝুঁকি পরিবার, সমাজ ও দেশের অর্থনীতি কতটা ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে। তাই নিজে সচেতন হতে হবে, প্রতিবেশীদের সচেতন করতে হবে। আর এ সচেতনতাই আমাদের এই মহামারি থেকে রক্ষা করতে পারে।

আমাদের সমাজে অনেক বিত্তবান লোক আছেন, যাঁদের পাহাড়সম সম্পদ সাত প্রজন্মও হয়তো শেষ করতে পারবে না। আপনাদের অনেকের সুইস ব্যাংকে টাকা আছে, কেউ কেউ অফশোর কোম্পানিতে টাকা ইনভেস্ট করেছেন, কেউ আবার কেসিনো থেকে অগাধ টাকার মালিক হয়েছেন, কেউ সরকারি বরাদ্দকৃত চাল গুদামজাত করছে, কারও আছে অস্ত্রের ব্যবসা, কেউ ভূমিদস্যু, কেউবা আবার রাজনৈতিক নেতা। আপনাদের অনেক টাকা। আপনাদের ক্ষমতা ও পেশিশক্তির কাছে সমাজ ভীতসন্ত্রস্ত থাকে, মাথা নুইয়ে কথা বলে। কিন্তু এ ভাইরাসটা ধনী-দরিদ্র দেখে দেখে আক্রমণ করছে না। আমরা সবাই তার শিকার। তার প্রমাণ ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী, কানাডার ফার্স্ট লেডি, জার্মানির চ্যান্সেলর, ইরানের আইনপ্রণেতারা, ইতালি, ফ্রান্স, চীন, ভারত, পাকিস্তান, ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র—কেউই বাদ যাচ্ছে না, এমনকি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, যাঁরা আমাদের জীবন বাঁচান, তাঁরাও করোনার মরণছোবলে প্রাণ ত্যাগ করছেন।

কিন্তু এই জাতীয় দুর্যোগের দিনে আপনারা ধনী সম্প্রদায় যদি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন, তাহলে অনেক দিনমজুর বেঁচে যাবেন কি না জানি না। তবে দুমুঠো খেতে পারবেন। কারণ, ক্ষুদার যন্ত্রণা মৃত্যুর যন্ত্রণা থেকে কোনো অংশে কম নয়।

আপনি, আমি সবাই জানি মৃত্যুর নিকশ কালো অন্ধকার আমাদের যেকোনো সময়ই গ্রাস করতে পারে। এখান থেকে অর্জিত সম্পদের একটি কড়িও আমরা নিয়ে যেতে পারব না। এমনকি করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হলে লাশ দাফনের জন্য পুলিশ ও সরকারের আইইডিসিআরের কয়েকজন কর্মী ছাড়া প্রিয় স্ত্রী, পুত্র, আত্মীয়স্বজন কেউই থাকছে না। কিন্তু আপনার সম্পদের কিছু অংশ এ দুর্দিনে দুস্থ পরিবারগুলোর মুখের আহার জোগাতে পারে। এই লকডাউনে তারাই সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত। তাদের পেটে খাবার নেই। আসুন, এই মহাসংকটময় পরিস্থিতিতে আমরা আমাদের প্রতিবেশী, সমাজ, দেশ তথা সব অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াই। একে অন্যকে ভালোবাসি, আমাদের সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নিই। ধর্মবর্ণ–নির্বিশেষে আমরা মানবিক হই। এই মহাযুদ্ধে জয় হোক মানবতার, জয় হোক মানবজাতির, শঙ্কামুক্ত হোক আগামীর মানবসমাজ, বৈষম্যহীন সমাজের বীজ রোপিত হোক সব মানবহৃদয়ে।

*লেখক: শিক্ষার্থী গণিত ডিসপ্লিন, খুলনা