
‘ঢাকার কলেজিয়েট স্কুলটি অনেক কালের নামজাদা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমল থেকেই মর্যাদাবান। দাঁড়িয়ে আছে ঢাকার প্রধান নাগরিক অঞ্চলে সগৌরবে, গোল মোটা রোমক থামওলা উন্নতশির অট্টালিকা... সিঁড়ি, মেঝে, বারান্দা সব তকতকে পরিষ্কার; ক্লাসরুমগুলোতে আলো-হাওয়া প্রচুর খেলে, কিন্তু কম্পাউন্ড পেরিয়ে গাড়ি-ঘোড়ার শব্দ লেশমাত্র পৌঁছায় না।’
আমার ছেলেবেলা বইতে বুদ্ধদেব বসু এভাবেই ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের বর্ণনা দিয়েছেন। এই স্কুলের ছাত্র ছিলেন তিনি। এই স্কুলের বিখ্যাত ছাত্রদের মধ্যে আরও ছিলেন বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু, মেঘনাথ সাহা, অধ্যাপক কবির চৌধুরী, সৈয়দ শামসুল হকের মতো অনেকে। ১৮৩৫ সালে প্রতিষ্ঠিত অবিভক্ত বাংলার প্রথম সরকারি স্কুলটি ১৮১ বছর পূর্ণ করেছে। তবে বুদ্ধদেব বসুর বর্ণনার সঙ্গে আজকের কলেজিয়েট স্কুলের মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না।
ঢাকার সবচেয়ে পুরোনো স্কুলটি এখন নানা সমস্যায় জর্জরিত। শ্রেণিকক্ষ অপর্যাপ্ত। নেই খেলার মাঠ। পাঠাগারে আছে অনেক দুর্লভ বই, তবে নষ্ট হচ্ছে রক্ষাণাবেক্ষণের ভালো ব্যবস্থা না থাকায়। স্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. আবু সাইদ ভুঁইয়া বললেন, ‘আমরা এখন নানাভাবে অবহেলিত।’
গতকাল শনিবার পুরান ঢাকার সদরঘাটে স্কুল ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখা যায়, পুরোনো ভবনটি ব্যবহারের অনুপযোগী বলে পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। নতুন একটি পাঁচতলা ও একটি তিনতলা ভবনে পাঠদান ও দাপ্তরিক কাজ চলছে। শ্রেণিকক্ষ ২২টি। প্রভাতি ও দিবা দুই শাখায় বর্তমানে ছাত্রসংখ্যা ২ হাজার ২৫৩।
প্রধান শিক্ষক মো. আবু সাইদ ভুঁইয়া বললেন, ছাত্রসংখ্যার তুলনায় শ্রেণিকক্ষ পর্যাপ্ত নয়। স্কুলের মিলনায়তনটিও তাই শ্রেণিকক্ষ হিসেবে ব্যবহার করতে হচ্ছে। কক্ষ-সংকটের কারণেই বিজ্ঞান ক্লাব, ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাবের মতো সহশিক্ষামূলক নিয়মিত কার্যক্রম শুরু করা যাচ্ছে না। স্কুলের জন্য একটি দশতলা ভবন নির্মাণের প্রস্তাব ও নকশা প্রায় পাঁচ বছর আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
প্রাচীন এই স্কুলে খেলার মাঠ নেই। মূল ফটক দিয়ে ঢুকে উঠানের মতো একচিলতে ফাঁকা জায়গা। সেখানে গতকাল কাদা-পানি জমে থাকতে দেখা যায়। স্কুলের শারীরিক শিক্ষা বিষয়ের শিক্ষক আবদুল কাদের বলেন, মাঠ না থাকায় ক্লাসের ভেতরে ছাত্রদের অ্যাসেম্বলি করাতে হয়। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে কোনো মিলনায়তন নেই। বার্ষিক অনুষ্ঠান হয় পাশের গভ. মুসলিম হাইস্কুলের মাঠে। দুটি ক্লাসরুমকে একত্র করে যে হলঘর তৈরি হয়েছিল, শ্রেণিকক্ষের সংকটের কারণে সেটিও পাঠদানের কাজে ব্যবহার করা হয়।
স্কুল সূত্রে জানা গেল, স্কুলের মূল ভবনটি জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় ২০১৩ সালে এখান থেকে শ্রেণিকক্ষ ও প্রশাসনিক দপ্তর সরিয়ে ফেলা হয়। তবে জায়গার অভাবে পরিত্যক্ত ভবনেই পাঠাগারটি রয়ে যায়। পাঠাগারে বইয়ের সংখ্যা পাঁচ হাজারের বেশি। শিক্ষকেরা জানালেন, ১০০ বছর বা তারঁও আগে প্রকাশিত বেশ কিছু দুর্লভ বই আছে এই পাঠাগারে। কিন্তু স্যাঁতসেঁতে পুরোনো ভবনে তালাবদ্ধ থেকে বইগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
নানা অসুবিধা আর সীমাবদ্ধতার মধ্যেও প্রাচীন স্কুলটি তার ঐতিহ্যের অনেক নিদর্শন ধরে রেখেছে। ১৯২৬ সালে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্ররা সংবর্ধনা দেয়। সেই অনুষ্ঠানের মানপত্রের কপি সংরক্ষিত আছে স্কুল দপ্তরে। বাংলার গভর্নর লর্ড লিটনের উপহার দেওয়া প্রায় শতবর্ষী এক বুকশেলফ রাখা আছে প্রধান শিক্ষকের কক্ষে। আছে ‘হিজ মাস্টার্স ভয়েজ’ কোম্পানির একটি গ্রামোফোন, চাবি দিয়ে চালানো একটি পুরোনো পেন্ডুলাম ঘড়ি। স্কুলের ইতিহাসের মূল্যবান সম্পদ হিসেবে এগুলো সংরক্ষণ করা হচ্ছে।
স্কুলের মূল ফটকের দেয়ালে একটি স্মৃতিফলক চোখে পড়ে। ফলকের বর্ণনা থেকে জানা যায়, প্রধান শিক্ষক রত্নামণি গুপ্তের (১৮৮৮-১৮৯৬) নয় বছরের দায়িত্বকালে স্কুলটি আটবার প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম হয়েছে। ফলাফলের দিক দিয়ে পুরান ঢাকার স্কুলগুলোর মধ্যে কলেজিয়েটের অবস্থান এখনো বেশ ভালো বলে মন্তব্য করলেন স্কুলের গণিত বিষয়ের শিক্ষক তপন কুমার বিশ্বাস। ২০১৫ সালের পিএসসি ও জেএসসি পরীক্ষায় স্কুলের শতভাগ ছাত্র পাস করেছে। পিএসসিতে ১০ জন ও জেএসসিতে ৬ জন ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছে। ২০১৬ সালের এসএসসি পরীক্ষায় স্কুল থেকে পাসের হার প্রায় ৯৯ শতাংশ।