সংকটের সময়েও বিদেশ ভ্রমণের বিলাসিতা

করোনা পরিস্থিতিতে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ রয়েছে। কিন্তু প্রকল্প প্রস্তাবগুলোতে কৌশলে বিদেশ সফরের জন্য টাকা রাখা হচ্ছে।

ফাইল ছবি।

২০১৮ সালে ভারতের মুম্বাই, দিল্লি, আহমেদাবাদ ও গুজরাটে অবস্থিত মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র দেখে আসেন পাঁচ সরকারি কর্মকর্তা। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ঢাকার তেজগাঁওয়ের কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রকে আধুনিকায়নের উদ্যোগ নেয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। কিন্তু বিদেশের মাটিতে এতগুলো নিরাময় কেন্দ্র দেখেও মন ভরেনি কর্মকর্তাদের। বিশ্বের আরও যেখানে যেখানে নিরাময় কেন্দ্র আছে, সেগুলোও দেখতে চান তাঁরা। করোনা প্রকোপের মধ্যেই দেশও চূড়ান্ত হয়েছে। কারা কারা বিদেশ ভ্রমণে যাবেন, সেটিও চূড়ান্ত।

‘ঢাকা কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়ন’ প্রকল্পটি এ মাসের শুরুতে পরিকল্পনা কমিশনে অনুমোদনের জন্য পাঠিয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৬৭ কোটি টাকা। প্রকল্পটি ঘেঁটে দেখা গেছে, সেখানে বিদেশ ভ্রমণ বাবদ ২ কোটি ৪৬ লাখ টাকা রাখা হয়েছে। ভবিষ্যতে বিদেশ সফরে যাবেন প্রকল্প পরিচালক (পিডি), গণপূর্ত অধিদপ্তরের একজন, স্থাপত্য অধিদপ্তরের একজন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন, পরিকল্পনা কমিশনের একজন কর্মকর্তা। দেশ হিসেবে বাছাই করা হয়েছে সিঙ্গাপুর ও ফিলিপাইন।

মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র দেখতে দুই দফা বিদেশে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) হামিমুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, প্রথম দফায় যাঁরা বিদেশ ভ্রমণে গেছেন, তাঁদের অভিজ্ঞতার আলোকেই প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছে। দ্বিতীয় দফায় বিদেশ সফরে তাঁরাই যাবেন, যাঁরা এই প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকবেন।

করোনার প্রকোপে সংকটে আছে অর্থনীতি। এ সময় সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর বন্ধ রেখেছে সরকার। তারপরেও করোনার সময়ে নেওয়া প্রকল্পগুলোতে ঠিকই প্রশিক্ষণের নামে বিদেশ ভ্রমণের জন্য টাকা রাখা হচ্ছে। চলতি মাসে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো অন্তত ১০টি প্রকল্পের নথি ঘেঁটে এমন তথ্য মিলেছে।

করোনার মধ্যেও বিদেশ ভ্রমণের প্রস্তাবে বিরক্ত পরিকল্পনা কমিশন। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় মহামারির মধ্যে কেন বিদেশ ভ্রমণের বিপরীতে টাকা বরাদ্দ রাখছে, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে কমিশন। পরিকল্পনা কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, অপ্রয়োজনীয় বিদেশ সফরের প্রস্তাব তাঁরা কেটে দিচ্ছেন।

■ মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র দেখতে বিদেশ সফর দুই দফায়। ■ স্মার্ট প্রি-পেইড মিটার বসানো দেখতে বিদেশে যাবেন ৫২ জন। ■ সাক্ষাৎকার নেওয়া শিখতেও বিদেশ সফর।

জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সচিব) শরিফা খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনার সময়ে আমার কাছে বিদেশ সফরের যতগুলো প্রস্তাব এসেছে, আমি প্রায় সবগুলোই কেটে দিয়েছি।’ মহামারির মধ্যে বিদেশ সফরের প্রস্তাবকে কীভাবে দেখছেন এমন প্রশ্নের জবাবে শরিফা খান বলেন, ‘কর্মকর্তাদের জন্য বিদেশ সফর একটা প্রথা হয়ে গেছে। তাই হয়তো প্রস্তাব দিচ্ছে। আমরা খুব শক্তভাবে বিদেশ ভ্রমণের বিষয়টি দেখছি। আবার বিদেশ ভ্রমণ একেবারেই বন্ধ করা যাবে না। যেখানে লাগবে, সেখানে দেব।’

সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন সরকারপ্রধানও। ২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর উদ্ধৃতি দিয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পে বিদেশ ভ্রমণের খাতটি কেটে দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী, কিন্তু বিদেশ ভ্রমণের খাত কেটে দেওয়ার কারণে সেই প্রকল্প একনেক সভায় আনা হয়নি। পরে যখন বিদেশ ভ্রমণের প্রস্তাবটি সংযোজন করা হয়, তখন প্রকল্পটি দ্রুত একনেক সভায় আনা হয়।

বিদেশে যাবেন ৫২ কর্মকর্তা

পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, স্মার্ট প্রি-পেইড মিটার কীভাবে বসাতে হবে, সেই অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য বিদেশ সফরের প্রস্তাব করেছে বাস্তবায়নকারী সংস্থা ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি)। ‘সাড়ে আট লাখ গ্রাহককে প্রি-পেইড মিটার’ প্রকল্পের আওতায় বিদেশ সফরের জন্য ৪ কোটি ২৩ লাখ টাকা রাখা হয়েছে। ৫২ জন কর্মকর্তার বিদেশ সফরে যাওয়ার কথা রয়েছে। তবে কোন কোন দেশে যাওয়া হবে, সেটি প্রকল্পে উল্লেখ করা হয়নি।

গত ৫ এপ্রিল ভার্চ্যুয়াল প্ল্যাটফর্মে ডিপিডিসির এই প্রকল্প নিয়ে আন্তমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ৫২ জন কর্মকর্তার বিদেশ সফর এবং ৪ কোটি ২৩ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখার বিষয়ে জানতে চান পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য শরিফা খান। কিন্তু ডিপিডিসির কর্মকর্তারা সদুত্তর দিতে পারেননি। সেই সভায় বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য রাখা টাকা কেটে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

সরকারি কর্মকর্তারা সদলবলে বিদেশ সফরে যাচ্ছেন। এর অর্থ হলো, এখানে দেশের স্বার্থ নয়, বরং ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল হচ্ছে।
জাহিদ হোসেন, অর্থনীতিবিদ

সাক্ষাৎকার নেওয়া শিখতেও বিদেশ সফর

৮০ হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎকার নিতে ‘বীরের কণ্ঠে বীর গাঁথা’ নামে একটি প্রকল্পেও বিদেশ ভ্রমণের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ জন্য প্রকল্পে ১৬ লাখ টাকা রাখা হয়েছে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী যে বীর মুক্তিযোদ্ধারা এখনো জীবিত আছেন, আগামী প্রজন্মের কাছে তাঁদের স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য প্রকল্পটি হাতে নিয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। প্রকল্পটির আওতায় কীভাবে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হবে, সেই অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য বিদেশ সফরের প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে এখানেও কোন দেশে যাওয়া হবে, সেটা প্রকল্পে উল্লেখ করা হয়নি।

জানা গেছে, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) সাভারে একটি ও ধামরাইয়ে একটি চামড়াশিল্প নগর করতে চায়। চামড়াশিল্প নগর করতেও বিদেশ সফরের প্রস্তাব করেছে বিসিক। বিদেশ সফরের জন্য মোট ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। অথচ সাভারে এরই মধ্যে একটি চামড়াশিল্প নগর করার অভিজ্ঞতা রয়েছে বিসিকের। চামড়াশিল্প নগর করতে বিদেশ সফরের প্রয়োজনীয়তা নেই বলে মনে করে পরিকল্পনা কমিশন।

‘ডিজিটাল সংযোগ স্থাপন’ শিরোনামের একটি প্রকল্পে বৈদেশিক প্রশিক্ষণ বাবদ ৩৬ কোটি টাকা রাখা হয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় কর্মকর্তাদের চীন সফরের কথা রয়েছে। আবার আগর চাষ শিখতেও আট কর্মকর্তার বিদেশ ভ্রমণের প্রস্তাব করা হয়েছে। ‘সম্পূর্ণ বৃক্ষে উন্নত মানের আগর সঞ্চয়ন প্রযুক্তি উদ্ভাবন’ প্রকল্পে ৬০ লাখ টাকা রাখা হয়েছে কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণের জন্য।

অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিদেশ থেকে আপনি এমন যন্ত্রপাতি কিনতে যাচ্ছেন, যে কারণে আপনাকে সেখানে সশরীর উপস্থিত থাকা জরুরি। সে ক্ষেত্রে আপনার বিদেশে যাওয়ার যৌক্তিকতা থাকতে পারে। কিন্তু ভবন নির্মাণ, পুকুর নির্মাণের মতো প্রকল্পে বিদেশ সফরের কোনো যৌক্তিকতা থাকতে পারে না। এটা সরকারি টাকার অপচয় ছাড়া কিছুই নয়। আমরা দেখছি, সরকারি কর্মকর্তারা সদলবলে বিদেশ সফরে যাচ্ছেন। এর অর্থ হলো, এখানে দেশের স্বার্থ নয়, বরং ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল হচ্ছে।’