সংগ্রামী এক জীবনগাথা

সরদার ফজলুল করিম
ফাইল ছবি

সরদার ফজলুল করিম (১৯২৫-২০১৪) তাঁর আত্মজীবনী ও অন্যান্য বইয়ের ( বইটি শিগগির প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হবে) শুরুতেই বলেছেন, ‘বর্তমানে বাংলাদেশে জিজ্ঞাসু যে প্রজন্ম, তাকে আমি কী দিতে পারি? আমি বড় পণ্ডিত নই, বড় প্রফেসর নই, বড় গবেষক নই। এমন আমি, কী দিতে পারি আমার পরবর্তী প্রজন্মকে? আমি দিতে পারি আমার জীবনটাকে।’

এক অসাধারণ সংগ্রামী জীবনের নাম সরদার ফজলুল করিম। নিজেকে অতিসাধারণ ‘কৃষকের পোলা’ আখ্যা দিতেন সব সময়, আমৃত্যু জ্ঞানসাধক, জাতীয় অধ্যাপক, বিশিষ্ট অনুবাদক, প্রাবন্ধিক, রাজনীতিক, ভাষা আন্দোলন থেকে জনমুক্তির সব আন্দোলনের সাহসী এই সংগ্রামী একেকটি মানুষকে বিবেচনা করতেন একেকটি বই। সেই বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টে জীবনবোধের শিক্ষা লাভ করাই ছিল তাঁর ব্যক্তিগত দর্শন।

২.

বরিশালের আটিপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়, রহমতপুর বয়েজ হাইস্কুলে পড়াশোনা এবং বরিশাল জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস এবং ঢাকায় আগমন তাঁর। বরিশালে থাকতেই বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দলের সংস্পর্শে আসা, শরৎচন্দ্রের পথের দাবীর রেঙ্গুনবাসী নায়ক সব্যসাচীর সঙ্গে বরিশালবাসী নিজেকে মিলিয়ে দেখা আর উচ্চমাধ্যমিক পড়তে ঢাকায় এসে যেন পৃথিবীর পাঠশালায় নাম লেখানো। বিয়াল্লিশের দাঙ্গা, বিশ্বযুদ্ধ, ফ্যাসিবাদীদের হাতে তরুণ লেখক সোমেন চন্দের হত্যাকাণ্ড তাঁকে ভেতর থেকে নাড়া দিয়ে যায়। উত্তাল সে চল্লিশের দশকে ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৪২ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন, আর এরই সমান্তরালে কলকাতার মোহাম্মদী পত্রিকায় ‘ফায়ারম্যান’ নামের গল্প, দুর্ভিক্ষের দিনলিপি আর প্রতিরোধ পত্রিকার সোমেন চন্দ স্মৃতিসংখ্যায় (১৯৪৩) আঠারো বছরের তরুণ সরদারের প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। প্রত্যয়দীপ্ত তাঁর অক্ষর ফুটিয়ে তুলে যেন আসন্ন এক সংগ্রামীর আভা:
‘জীবনের যে ইঙ্গিত সোমেন তাহার জীবনে পাইয়াছিল—আজ যাহার সুস্পষ্ট আভাস সোমেনের ও হাজার লক্ষ জনগণের রক্তের মধ্য দিয়ে আমাদের দৃষ্টিপথে ভাসিয়া উঠিয়াছে, তাহার প্রতিষ্ঠা যেন আমরা করিতে পারি, কেননা একমাত্র তাহার প্রতিষ্ঠাতেই হইবে সোমেনের জীবনের নবপ্রতিষ্ঠা।’

প্রথমা প্রকাশন

৩.

সরদার ফজলুল করিম প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। পরে দর্শন বিভাগের শিক্ষক হরিদাস ভট্টাচার্যের লেকচারে মুগ্ধ হয়ে ভর্তি হন দর্শনশাস্ত্রে। একদিকে যেমন দর্শনের পাঠ নিয়েছেন, তেমনি ছাড়েননি জনগণের মাঠ। আত্মজীবনীতে বলেছেন দার্শনিক হেগেল পাঠ ছেড়ে কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী হিসেবে দুর্ভিক্ষকালীন ত্রাণকাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা:
‘আমি আমার হেগেলের কাছে থাকতে পারলাম না। পরদিন আমাকে যেতে হল নয়াবাজারে সিরাজদৌল্লা পার্কে। ৪৩-এর দুর্ভিক্ষের সময় আমি বন্ধুদের সঙ্গে গ্রামেও গিয়েছি রিলিফের কাজে।’

১৯৪৫ সালে স্নাতক এবং ১৯৪৬ সালে স্নাতকোত্তর উভয় পরীক্ষায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন। ভালো ছাত্রের প্রথাগত ধারণা ভেঙেচুরে সাম্যবাদী উত্থানপ্রত্যাশায় নিজেকে যুক্ত করেন নানামুখী তৎপরতায়। প্রগতি লেখক সঙ্ঘের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে নতুন দিনের সাহিত্যের স্ফুলিঙ্গের সঙ্গেও পরিচিত হতে থাকেন। অনুবাদ করেন সোভিয়েত গল্প, বছর কুড়িতে লেখেন অসাধারণ এক প্রবন্ধ ‘সাহিত্যের সমস্যাটা কী?’

বামপন্থী রাজনীতিতে যুক্ততার প্রয়োজনে বিলেতের আকর্ষণীয় স্কলারশিপ প্রত্যাখ্যান করেন।

১৯৪৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে লেকচারার হিসেবে ক্লাস নিতে শুরু করেন, যদিও ১৯৪৮ সালে রাজনীতির কারণে স্বেচ্ছামূলকভাবে শিক্ষকতা থেকে ইস্তফা দেন।

ইতিমধ্যে সদ্যপ্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের চরম রক্ষণশীল রূপ প্রকাশ পেতে শুরু করে। বিভিন্ন জায়গায় বামপন্থীদের সভা-সমাবেশে মুসলিম লীগের গুন্ডাদের হামলা ছিল প্রায় নিয়মিত ঘটনা। আর সরদারের মতো নিষ্ঠাবান রাজনৈতিক কর্মীরা গোয়েন্দা নজরদারিতেও পড়েন। এরই মধ্যে ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্বে সক্রিয় ভূমিকা পালন শেষে রাজনৈতিক প্রয়োজনে আত্মগোপন করেন কলকাতায়। তারপর আবার দেশে ফিরে আন্ডারগ্রাউন্ড জীবন কাটান চালাকচর, পীরপুর, শরীফপুর, পোড়াদিয়া, হাতিরদিয়া, মনোহরদীর মতো বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে।

৪.

১৯৪৯ সালে প্রথম কারাবরণ করেন। কারাজীবনকেও তিনি মনে করেন জীবনবোধের পাঠশালা। রাজবন্দীদের বিভিন্ন দাবিতে কারাগারে ৫৮ দিন অনশনে প্রাণ দিতে দেখেছেন কোনো কোনো সহযোদ্ধাকে আর শপথ নিয়েছেন গণমানুষের জন্য মুক্ত-স্বাধীন জীবনের। কারাগারে থাকতেই শুনতে পান ১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল রাজশাহী জেলে ‘খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ড’-এর কথা এবং ১৯৫২ সালের রক্তাক্ত একুশে ফেব্রুয়ারির কথা। জেলে থাকা অবস্থাতেই ১৯৫৪ সালে পাকিস্তান সংবিধান-সভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৫ সালে কারামুক্ত হয়ে জীবনের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দফায় দীর্ঘ ১১ বছর কারাবন্দী ছিলেন তিনি।

১৯৬৩ সালে বাংলা একাডেমিতে যোগ দেন; প্রথমে অনুবাদ বিভাগ এবং পরে সংস্কৃতি বিভাগের প্রায় এক দশকের কার্যকালে বিশ্বমনীষার সঙ্গে বাঙালি মননের যোগাযোগমূলক বই প্রকাশ এবং ষাটের দশকে বাঙালি জাগরণের সাংস্কৃতিক পাটাতন নির্মাণে তাঁর অবদান ছিল। হয়তো এ কারণেই একাডেমির সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যক্ষ সরদার ফজলুল করিম ১৯৭১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে ১৭ ডিসেম্বর আরও অনেকের সঙ্গে তিনিও মুক্ত হন।

৫.

পরবর্তীকালে ১৯৭২ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপনা করেন।

এ প্রসঙ্গে জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাকের আনুকূল্যের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন:
‘আমি রাজ্জাক স্যারকে বলেছিলাম, ‘স্যার, আমি তো দর্শনের লোক। পলিটিক্যাল সাইন্সে তো আমার এম এ নেই। আপনি আমাকে এখানে কেন নিয়ে এলেন?’ রাজ্জাক সাহেব আমাকে উত্তরে বলেছিলেন, ‘আপনি ফিলোসফির ওপর কী সব লেখালেখি করছিলেন না? ওইগুলো আমার দরকার।’


আমরাও মনে করি, সরদার ফজলুল করিম অনূদিত ও ভাষ্যদানকৃত দর্শনকোষ, প্লেটোর সংলাপ, প্লেটোর রিপাবলিক, অ্যারিস্টটলের পলিটিকস, এঙ্গেলসের অ্যান্টি ডুরিং, রুশোর সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট-এর মতো দর্শনরচনা যেমন আমাদের সামগ্রিক চিন্তাজগতের সম্পদ, তেমনি নানাকথা, রুমীর আম্মা, নূহের কিশতির মতো বইগুলো আমাদের সাহিত্যের ব্যতিক্রমী সংযোজন।

আত্মজীবনী ও অন্যান্যর শেষাংশে শান্তনু মজুমদারের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপনে এই জীবনসাধক বলেছেন, তিনি মৃত্যুময় পৃথিবীতে জীবনের অব্যাহত জয়যাত্রায় বিশ্বাসী।

বইয়ের ভূমিকায় মতিউর রহমান এমন এক সংগ্রামী জীবনের সাক্ষাৎ পাওয়ার কথা বলেছেন এভাবে, ‘এ বইয়ে বিংশ শতাব্দীর চার থেকে পাঁচটি দশকের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের এমন সব বিবরণ সরদার ফজলুল করিম তুলে ধরেছেন, এক অর্থে তা অতুলনীয়। গবেষক তো বটেই, এ বই অনুসন্ধিৎসু পাঠকের সামনে তুলে ধরবে অপার তথ্যের ভান্ডার।’