সংসদে নষ্ট সময়ের আর্থিক মূল্য ১০৪ কোটি টাকা

রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে গতকাল সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। ডানে টিআইবির ট্রাস্টি এম হাফিজউদ্দিন খান । প্রথম আলো
রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে গতকাল সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। ডানে টিআইবির ট্রাস্টি এম হাফিজউদ্দিন খান । প্রথম আলো

নবম সংসদে কোরাম-সংকটের কারণে ২২২ ঘণ্টা ৩৬ মিনিট সময় নষ্ট হয়েছে। এর আর্থিক মূল্য প্রায় ১০৪ কোটি টাকা। তা ছাড়া বিরোধী দলের ৩৪২ দিন সংসদ বর্জনের আর্থিক মূল্য চার কোটি ৮৭ লাখ টাকা। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ‘পার্লামেন্ট ওয়াচ’ প্রতিবেদনে এ তথ্য দেওয়া হয়েছে। এতে সংসদের কার্যক্রম পরিচালনায় প্রতি মিনিটে ব্যয় কমপক্ষে ৭৮ হাজার টাকা বলে উল্লেখ করা হয়। তবে এ প্রতিবেদন ‘পক্ষপাতমূলক’ বলে মন্তব্য করেছেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক।
টিআইবি নবম সংসদের ১৯টি অধিবেশনের কার্যদিবসের কার্যক্রম ও স্থায়ী কমিটির কাজের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে। গতকাল মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।
প্রতিবেদনে অষ্টম সংসদের তুলনায় নবম সংসদে বেশ কিছু ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়; পাশাপাশি নেতিবাচক কয়েকটি দিকও তুলে ধরা হয়। টিআইবি সময় নষ্টের আর্থিক মূল্যকে ‘অপচয়’ বা ‘দুর্নীতি’ বলে চিহ্নিত করেনি। সময় নষ্ট না করতে সাংসদদের সঠিক সময়ে অধিবেশনে যোগ দেওয়ার তাগিদ দিয়েছে দুর্নীতির বিরুদ্ধে নজরদারি করা সংস্থাটি।
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এই প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য সংসদকে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ করা। দশম সংসদের সমালোচনা করে তিনি বলেন, এটা বিরোধী দলবিহীন সংসদ। আক্ষরিক অর্থে সংসদে বিরোধী দল থাকলেও বাস্তবতার নিরিখে সংসদে কোনো বিরোধী দল নেই। জাতীয় পার্টিকে তার ভূমিকা পরিষ্কার করতে হবে—তারা সরকারে থাকবে, নাকি বিরোধী দলে থাকবে।
ইফতেখারুজ্জামান ‘বিরোধী দলবিহীন’ এ সংসদকে সাময়িক আখ্যা দেন। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, শিগগিরই সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদীয় গণতন্ত্রের মূল কাঠামো অনুযায়ী একটি সংসদ প্রতিষ্ঠা হবে। তিনি আরও বলেন, সরকার বলেছিল, ভোটের পর দ্রুত আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে আবার নির্বাচন হবে। যত শিগগির তারা সেটা করবে, ততই জনগণের কাছে তাদের দায়বদ্ধতার বিষয়টি ফুটে উঠবে। ইফতেখারুজ্জামান সংসদ বর্জনের জন্য সাবেক বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সমালোচনা করেন।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন টিআইবির ট্রাস্ট্রি এম হাফিজউদ্দিন খান।
নষ্ট সময়ের খতিয়ান: প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নবম সংসদের ১৯টি অধিবেশনে মোট কার্যদিবস ছিল ৪১৮ দিন। ঘণ্টার হিসাবে এক হাজার ৩৩১ ঘণ্টা ৫৪ মিনিট। কোরাম-সংকটের কারণে নষ্ট হয় শতকরা প্রায় ১৭ ভাগ সময়। প্রতিদিন সাংসদদের গড় উপস্থিতি প্রায় ২২১ জন।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, সংসদ নেতা শেখ হাসিনা শতকরা ৮০ ভাগের বেশি দিন (৩৩৬ দিন) সংসদে উপস্থিত ছিলেন। আর বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া শতকরা মাত্র ২ দশমিক ৩৯ ভাগ দিনে (১০ দিন) উপস্থিত ছিলেন। বিএনপির সাংসদেরা উপস্থিত ছিলেন মাত্র ৭৬ দিন। উল্লেখ্য, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনাসহ বিভিন্ন দাবিতে বিএনপি গত মেয়াদে টানা সংসদ বর্জন করে।
নবম সংসদে নানা কারণে মোট ৫৪ বার ওয়াকআউট করা হয়েছে। এর মধ্যে বিএনপি করেছে ৪১ বার। একমাত্র স্বতন্ত্র সাংসদ ফজলুল আজিম করেছেন ১৩ বার।
আইন প্রণয়নে কম সময়: সংসদের প্রধান কাজ আইন প্রণয়ন হলেও টিআইবির প্রতিবেদন বলছে, গতবার মোট সময়ের শতকরা মাত্র ৮ দশমিক ২ ভাগ ব্যয় হয়েছে আইন প্রণয়নের জন্য। এতে বলা হয়, উন্নত বিশ্বের মধ্যে যুক্তরাজ্যে মোট সময়ের শতকরা ৫৫ ভাগ ও প্রতিবেশী ভারতে শতকরা ৫৩ ভাগ সময় আইন প্রণয়নে ব্যয় করা হয়। নবম সংসদে ২৬৮টি সরকারি বিল ও তিনটি বেসরকারি বিল পাস হয়েছে। প্রতিটি বিল পাসে গড়ে সময় ব্যয় করা হয়েছে প্রায় ১২ মিনিট। সর্বোচ্চ সময় ব্যয় হয়েছে পঞ্চদশ সংশোধনী বিলে—চার ঘণ্টা ছয় মিনিট। মাত্র তিন থেকে চার মিনিটের আলোচনায় বিল পাসের ঘটনাও ঘটেছে।
প্রতিবেদনে সাংসদদের গড় উপস্থিতি বৃদ্ধি, নারী সাংসদদের উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ ও প্রথম অধিবেশনেই সব স্থায়ী কমিটি গঠনকে নবম সংসদের ইতিবাচক বিষয় হিসেবে উল্লেখ করা হয়। আর নেতিবাচক দিক হলো প্রধান বিরোধী দলের সংসদ বর্জন ‘সংকটজনকভাবে’ বেড়ে যাওয়া, আইন প্রণয়নে গড় সময় কমা, আইন প্রণয়নে নারীদের কম অংশগ্রহণ, আন্তর্জাতিক চুক্তি নিয়ে সংসদে আলোচনা না হওয়া, অসংসদীয় ভাষার ব্যবহার বন্ধ না হওয়া ও বিরোধী দলের গঠনমূলক ভূমিকা না থাকা।
সুপারিশ: সংসদকে আরও কার্যকর করতে টিআইবি বেশ কয়েকটি সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে আছে সংসদ বর্জন ঠেকাতে আইন প্রণয়ন, সাংসদদের অনুপস্থিত থাকার সময় সর্বোচ্চ ৯০ দিনের পরিবর্তে ৩০ দিন করা, সাংসদদের আচরণবিধি আইনে পরিণত করা, নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়া কার্যত অসম্ভব করে তোলা, ৭০ অনুচ্ছেদে সংশোধন, প্রতি কার্যদিবস ছয় ঘণ্টা করা ও সংবিধান সংশোধনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গণভোটের আয়োজন করা।
আইনমন্ত্রী বললেন, পক্ষপাতমূলক: গতকাল সচিবালয়ের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী টিআইবির প্রতিবেদনকে পক্ষপাতমূলক আখ্যা দেন। এর আগে বাংলাদেশে নিযুক্ত নরওয়ের রাষ্ট্রদূত মেরিট লুন্ডেমো মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
প্রতিবেদনটি সম্পর্কে জানতে চাইলে আনিসুল হক বলেন, ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনের মতোই ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর সংসদ নির্বাচন হয়েছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে গঠিত জাতীয় সংসদে বিরোধী দল ৭০ দিনের জন্য সংসদে এসেছে। কাজেই টিআইবি প্রতিবেদনের এ বক্তব্য পক্ষপাতিত্বমূলক। টিআইবির কাছ থেকে এ ধরনের বক্তব্য অনাকাঙ্ক্ষিত।
নরওয়ের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, রাষ্ট্রদূত বলেছেন, অনেক বাংলাদেশি অবৈধ অভিবাসী নরওয়ে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় চান। তাঁদের বেশির ভাগ আশ্রয় পাওয়ার যোগ্য নন। নরওয়ে কর্তৃপক্ষ অবৈধ বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠাতে চুক্তি করতে চান। মন্ত্রী জানান, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে রাষ্ট্রদূতকে আশ্বস্ত করা হয়েছে।
বিরোধীদলীয় নেতার প্রতিবাদ: দশম জাতীয় সংসদে বাস্তবিক অর্থে বিরোধী দল নেই বলা যায় এবং জাতীয় পার্টি বিরোধী দল হলে সরকারের সঙ্গে আছে কীভাবে—টিআইবির এ বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছে বিরোধীদলীয় নেতার কার্যালয়।
বিরোধীদলীয় নেত্রী রওশন এরশাদের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ গতকাল রাতে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এই প্রতিবাদ করেন। বিবৃতিতে টিআইবির বক্তব্যকে ‘আংশিক পক্ষপাতদুষ্ট’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। এতে বলা হয়, ‘জাতীয় পার্টি সরকারে এবং বিরোধী দলে থাকবে, এটি একটি নতুন কনসেপ্ট এবং তা অনেক দেশে আছে। এ ক্ষেত্রে আমরা সরকারের ভালো কাজকে সমর্থন দেব, অন্যায় কাজের প্রতিবাদ জানাব।’