সংসদে বিতর্ক

আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ (১৯০০—১৯৮৬)

ভাষা আন্দোলন প্রচণ্ডরূপ ধারণ করে ১৯৫২-র ফেব্রুয়ারিতে। খাজা-নাজিমুদ্দীন তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এবং নূরুল আমীন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। আমি ছিলাম সে সময় পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের সদস্য। ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে নাজিমুদ্দীন ফেডারেশন রাজধানী করাচি থেকে ঢাকা আগমন করেন। পল্টন ময়দানে একটি ছোট জনসভায় তিনি জিন্নাহর পদাঙ্ক অনুসরণ করে ‘উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে’ বলে ঘোষণা করেন। ঢাকায় ছাত্ররা এ বক্তব্যের প্রতিবাদ জানায়। তারা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দাবি করে। পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের সদস্যদের মধ্যে রাষ্ট্রভাষার বিতর্ক নিয়ে গ্রুপিং শুরু হয়। কে উর্দু ভাষার পক্ষে আর কে বাংলা ভাষার পক্ষে এ বিষয়ে ব্যাপক গ্রুপিং চলতে থাকে।

সদস্যদের মধ্যে একটি দল যাঁরা বিহারি ও পাঞ্জাবিদের সমর্থন করতেন তাঁরা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে সমর্থন করতেন। আর একটি দল ছিল বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে। উর্দুর সমর্থক বাঙালি সদস্যরা প্রকাশ্যে তাঁদের মতামত ব্যক্ত করতেন না। আমরা জিজ্ঞেস করলে তাঁরা বলতেন, তাঁরা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে আছেন, আর মন্ত্রী ও নেতারা জিজ্ঞেস করলে বলতেন, তাঁরা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে দেখতে চান। এমনিভাবে রাষ্ট্রভাষার ইস্যুকে কেন্দ্র করে পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদ সদস্যদের মধ্যে বিতর্ক শুরু হয়। ২১শে ফেব্রুয়ারি পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করা হয়। ঐদিন ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সভা করে এবং সভাশেষে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে পরিষদ ভবনের দিকে অগ্রসর হয়।

সে সময়ে পরিষদ ভবন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের বর্তমান অডিটরিয়াম। অধিবেশন বসার পূর্বে পরিষদ ভবনে মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির বৈঠক বসে। আমি ঐ সভায় যোগদান করি। সভা চলাকালে এক পর্যায়ে আমি হৈ-হট্টগোল ও রাইফেলের গুলির আওয়াজ শুনতে পাই। আমি সভা ত্যাগ করে মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণে যাই। সেখানে কিছুক্ষণ অবস্থান করে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করি। আমি আবার পরিষদ ভবনে ফিরে যাই। অধিবেশনে বসার বেল বাজানো হলে ভেতরে প্রবেশ করে আসন গ্রহণ করলাম। স্পিকারও তাঁর আসন গ্রহণ করেন, স্পিকার ছিলেন আবদুল করিম। আমি দাঁড়িয়ে তাঁকে উদ্দেশ করে বললাম, ‘জনাব স্পিকার, আপনার কাছে আমি একটি নিবেদন করছি, যখন আমাদের দেশের ছাত্ররা যারা আমাদের আশা ভরসার স্থল, পুলিশের গুলির আঘাতে তাদের জীবনলীলা সাঙ্গ হচ্ছে, সেই সময় আমরা এখানে বসে সভা করতে চাই না। প্রথমে এই মর্মান্তিক ঘটনার তদন্ত করতে হবে, তারপর হাউস চলবে।’

স্পিকার আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘Order, Order, I hope you will proceed according to the rules of business of the house.’ আমি উত্তর দিলাম, ‘Leader of the house ঘটনাস্থল দেখে এসে হাউসে বিবৃতি দেবেন। তা না হলে আমরা হাউস চলতে দেব না। সেখানে কী অবস্থা আগে জানতে চাই।’ স্পিকার আমাকে সম্বোধন করে বললেন, ‘I hope, honorable members will proceed in a regular way. If the members want to hear the leader of the house in the matter. I would ask him if he has got anything to say.’ ‘আপনার অর্ডার বুঝি না, আপনার অর্ডার মানব না।’ আমি পুনরাবৃত্তি করলাম, ‘Leader of the house প্রথমে গিয়ে দেখে এসে বিবৃতি দেবেন। তারপর Assembly বসবে।’

স্পিকার বললেন, ‘Order, Order, you have no right to disobey the chair. Please take your seat. Please take your seat.’ আমি আসন গ্রহণ করলাম না। স্পিকার আমার ওপর গরম হয়ে উঠলেন। আবার তিনি আমাকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘Please take your seat.’ আমি পুনরায় বললাম, ‘Leader of the house আগে গিয়ে দেখে এসে বিবৃতি দেবেন। তারপর হাউসের কাজ চলবে।’ স্পিকার আমাকে সম্বোধন করে বললেন, ‘Do you mean to say that you will not allow anybody else to speak? You are obstructing the proceedings of the house.’ আমি উত্তর দিলাম, ‘Leader of the house গিয়ে enquiry করে আসুন, তারপর হাউস বসবে, তার আগে নয়।’ স্পিকার আমার ওপর রেগে গেলেন, এবার তিনি আমাকে পূর্বের ন্যায় ‘মাওলানা সাহেব’ সম্বোধন না করে মি. তর্কবাগীশ বলে সম্বোধন করে বললেন, ‘Mr. Tarkabagish, I am very sorry, I may be compelled to take action under the rules 16 (2) of the East Bengal Legislative Assembly procedure rules, if you do not obey the chair.’ স্পিকারের এই কথার অর্থ হলো Assembly-র মেম্বার থেকে তিনি আমাকে বরখাস্ত ও দশ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারেন। আমি বিচলিত হলাম না। আমি তাঁকে বললাম, ‘যেকোনো ব্যবস্থা নিতে পারেন। আমার দাবি Leader of the house গিয়ে দেখে এসে বলুন পরিস্থিতি কী?’ এবার স্পিকার আমার প্রতি একটু নরম হলেন। তিনি আমাকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘Please take your seat, I request you not to prevent other speaking.’ এরপর হাউস ১৫ মিনিটের জন্য মুলতবি করা হয়। সদস্যরা হল ত্যাগ করে বাইরে চলে যান। আমি হাউস ছেড়ে বের হলাম না। ভাবলাম, বাইরে গেলে হয়তো পুলিশ আমাকে গ্রেপ্তার করবে। হাউসের ভেতরই বসে রইলাম। মুলতবি সভা আবার শুরু হলো। স্পিকার তাঁর আসন গ্রহণ করলেন। আমি দাঁড়িয়ে বললাম, ‘যখন আমাদের বক্ষের মানিক, আমাদের রাষ্ট্রের ভাবি নেতা ৬ জন ছাত্র রক্তশয্যায় শায়িত তখন আমরা পাখার নিচে বসে হাওয়া খাব এ আমি বরদাস্ত করতে পারি না। আমি জালেমের এই জুলুমের প্রতিবাদে পরিষদ গৃহ পরিত্যাগ করছি এবং মানবতার দোহাই দিয়ে আপনার মাধ্যমে সকল সদস্যকে পরিষদ গৃহ ত্যাগের আবেদন জানাচ্ছি।’

আমি পরিষদ গৃহ পরিত্যাগ করে সোজা মেডিকেল কলেজে চলে যাই। সেখানে অসংখ্য ছাত্র-জনতার উপস্থিতি দেখতে পাই। ছাত্ররা আমাকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করে। তারা আমাকে একটি সভামঞ্চে নিয়ে যায়। সেখানে মাইক ও লাউডস্পিকার লাগানো ছিল। আমি বক্তৃতা করলাম। আমার সেদিনের বক্তৃতা আবেগময় হয়েছিল এবং তা আন্দোলনকারীদের অনুপ্রাণিত করেছিল। বক্তৃতা শেষ করে গুলিতে নিহত ও আহতদের দেখার জন্য হাসপাতালে যাই। বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে ঘুরে দেখলাম। খালেক নেওয়াজ খান, কাজী গোলাম মাহবুব, এস এম নুরুল আলম প্রমুখ ছাত্রনেতার সাথে দেখা হলো। তাদের কাছ থেকে বহু অজানা ঘটনা জানলাম।

এস এম নূরুল আলম আমার জ্যেষ্ঠ পুত্র। সে সময়ে সে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএ
অনার্স (রাষ্ট্রবিজ্ঞান) পরীক্ষার্থী এবং একজন প্রভাবশালী ছাত্রনেতা। ভাষা আন্দোলনে সে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছিল। সন্ধ্যের পরে মেডিকেল কলেজ ত্যাগ করে আমি পার্টি হাউসে ফিরে আসি। মুসলিম লীগের সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক রাখলাম না। মুসলিম লীগের রাজনীতি ত্যাগ করে আমি আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত হই। (সংক্ষেপিত)

আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ: রাজনীতিবিদ। আওয়ামী মুসলিম লীগের দ্বিতীয় সভাপতি ও পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে আশির দশক পর্যন্ত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।

একুশের স্মৃতিচারণ, মহান একুশে সুবর্ণজয়ন্তী গ্রন্থ (উপদেষ্টা সম্পাদক আবদুল মান্নান সৈয়দ, সম্পাদক মাহবুব উল্লাহ, অ্যাডর্ন পাবলিকেশন, ২০০৮) গ্রন্থ থেকে