এত দিন সরকার কওমি মাদ্রাসার শিক্ষাব্যবস্থাকে সংস্কার ও আধুনিক করে মূলধারায় আনার কথা বলে এলেও এখন তা হচ্ছে না। পাঠ্যক্রম আধুনিকায়ন ছাড়াই কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদিসকে স্নাতকোত্তর (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি) সমমানের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এখানে সরকারের কোনো রকম নিয়ন্ত্রণ থাকছে না।
যুগোপযোগী করার জন্য সরকার পাঁচ বছর আগে ‘কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কমিশন’ গঠন করে। সেই কমিশন প্রতিবেদনও দিয়েছিল। তাতে ওই শিক্ষাব্যবস্থার স্বীকৃতির জন্য ‘বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কর্তৃপক্ষ’ গঠনের প্রস্তাব করা হয়। মন্ত্রিসভায় প্রস্তাবটি উত্থাপনও করা হয়েছিল। এই কর্তৃপক্ষে সরকারের প্রতিনিধি থাকার কথা ছিল। কিন্তু এসবের কিছুই এখন আর মানা হচ্ছে না।
মাদ্রাসা শিক্ষাকেন্দ্রিক ব্যক্তি ও স্নাতকোত্তর স্তরের ডিগ্রি দেওয়ার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সরকার যে প্রক্রিয়ায় দাওরায়ে হাদিসকে স্নাতকোত্তর সমমান দিয়েছে, তাতে অসংগতি ও বিভ্রান্তি রয়ে গেছে। তাঁরা বলছেন, নিচের স্তর বাদ রেখে একবারে সর্বোচ্চ স্তরের স্বীকৃতি দেওয়ায় পদ্ধতিগত ত্রুটি রয়েছে। স্নাতকোত্তর ডিগ্রি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে হয়। কিন্তু দাওরায়ে হাদিসের সমমান বাস্তবায়নে কমিটি করা হলেও কোন কর্তৃপক্ষ সনদ দেবে, তা স্পষ্ট করা হয়নি।
সরকারি মাদ্রাসা ই আলিয়া, ঢাকার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ্দিন আহমাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্নাতকোত্তর ডিগ্রি দিতে হলে অ্যাফিলিয়েটিং কর্তৃপক্ষ থাকতে হবে। যেমন কলেজগুলোর স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি দেয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। সাধারণ ধারার মাদ্রাসার স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি দেয় ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়।’
জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ প্রথম আলোকে বলেন, ওই কমিটিকেই সব দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা যেভাবে বলবে, সেভাবেই সরকার স্বীকৃতি দেবে। কমিটির সঙ্গে এ নিয়ে আরও আলোচনা হবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা, শিক্ষাবিদ ও কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাকে মূলধারায় আনার বিষয়ে কারও আপত্তি নেই। তবে ‘রাজনৈতিক বিবেচনায়’ স্বীকৃতি দিতে গিয়ে প্রক্রিয়াটি সঠিকভাবে মানা হয়নি।
২০১২ সালে সরকার গঠিত কওমি মাদ্রাসা কমিশনের কো-চেয়ারম্যান ছিলেন ইকরা বাংলাদেশের পরিচালক মাওলানা ফরিদ উদ্দীন মাসউদ। গত মঙ্গলবার কওমি শিক্ষা সনদের স্বীকৃতি ঘোষণার দিন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে তিনি অংশ নিয়েছিলেন। যোগাযোগ করা হলে গতকাল প্রথম আলোকে মাওলানা মাসউদ বলেন, ‘আমি অস্বীকার করি না যে কিছু অসংগতি রয়েছে। তবে আগে তো অস্তিত্বই ছিল না। এখন যা হয়েছে, তা পরিচর্যা করা যাবে।’ তবে ব্যক্তিগতভাবে তিনি মনে করেন, নিচের স্তরেরও স্বীকৃতি থাকা উচিত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরাও বুঝতে পারছেন, যেভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হলো সেটা পদ্ধতিগতভাবে ঠিক হয়নি। সরকারের উচ্চপর্যায়ের হস্তক্ষেপে এটা হওয়ার ফলে তাঁদের করণীয় কিছু নেই।
সনদ দেবে কে?
দাওরায়ে হাদিসের সনদকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রির সমমান দিয়ে গত বৃহস্পতিবার প্রজ্ঞাপন জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এই সমমান দেওয়ার লক্ষ্যে আল্লামা শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বে কমিটি করে দেওয়া হয়। ওই কমিটি সনদবিষয়ক যাবতীয় কার্যক্রমের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী বলে বিবেচিত হবে। কমিটির নিবন্ধিত মাদ্রাসাগুলোর দাওরায়ে হাদিসের সনদ স্নাতকোত্তর সমমান বলে বিবেচিত হবে। এ কমিটির অধীনে ও তত্ত্বাবধানে দাওরায়ে হাদিসের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু প্রজ্ঞাপনে বলা নেই, কারা দাওরায়ে হাদিসের সনদ দেবে।
বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য ও বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের (বেফাক) যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হক বলেন, এ বিষয়ে আজ (রোববার) চট্টগ্রামে কমিটির প্রথম বৈঠকে আলোচনা হবে। আর মাওলানা ফরিদ উদ্দীন মাসউদ বলেন, তিনি আশা করছেন গঠিত কমিটিই সনদ দেবে। তাঁর ভাষায়, বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্য নামে কোনো স্বীকৃতিতে বাধা থাকবে না। তিনি বলেন, প্রয়োজনে সরকার বিশ্ববিদ্যালয় করতে পারে।
নিচের স্তরের স্বীকৃতির বিরোধিতা
কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শিক্ষার্থী কমে যাওয়ার আশঙ্কা থেকেই তাঁরা কওমি মাদ্রাসার নিচের স্তরের স্বীকৃতি চান না। দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের সমমান দেওয়ার লক্ষ্যে গঠিত বাস্তবায়ন কমিটির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা পর্যবেক্ষণ করে দেখেছেন, সরকারি স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সাধারণ ধারার মাদ্রাসায় (আলিয়া) নিচের দিকে শিক্ষার্থী বেশি থাকলেও দাখিল ও আলিম পাসের পর একটি বড় অংশ সাধারণ শিক্ষায় চলে যায়। কওমি মাদ্রাসার ক্ষেত্রেও নিচের দিকে স্বীকৃতি দিলে একই ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে।
এর আগে ২০১২ সালে সরকারের কাছে জমা দেওয়া কওমি মাদ্রাসা শিক্ষানীতিতে কওমির প্রাথমিক থেকে শুরু করে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত সব স্তরের স্বীকৃতির সুপারিশ করা হয়েছিল। সরকারেরও পরিকল্পনা তেমনটাই ছিল। কিন্তু হেফাজতে ইসলামসহ কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক একটি অংশের আপত্তির কারণে তা হয়নি।
জানতে চাইলে মাওলানা মাহফুজুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা মনে করি, দেশে কোরআন-হাদিসে দক্ষ আলেম প্রয়োজন। আর কওমির পুরো শিক্ষাস্তরটাই একটা কোর্সের মতো। ফলে দক্ষ আলেম হওয়ার জন্য পুরো কোর্সটি শেষ করতে হয়। এ জন্য নিচের স্তরে স্বীকৃতির প্রয়োজন নেই।’
সাধারণ ধারার সঙ্গে মিল-অমিল
কওমি মাদ্রাসা-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে বেফাকসহ ছয়টি বোর্ডের অধীনে দাওরায়ে হাদিসসহ বিভিন্ন স্তরের পরীক্ষাগুলো হয়। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, দেশে ১৩ হাজার ৯০২টি কওমি মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, মোট মাদ্রাসার মধ্যে প্রায় এক হাজার মাদ্রাসায় দাওরায়ে হাদিস পড়ানো হয়। কওমির সর্বোচ্চ এই স্তরে মূলত হাদিসের প্রধান ছয়টি গ্রন্থ (সিহাহ সিত্তা) এবং হাদিস-সংক্রান্ত আরও দুটি কোর্স পড়ানো হয়। মূলত হাদিস হলেও এর ভেতরে কোরআনের বিভিন্ন অংশের তফসির, ফিকাহও চলে আসে। কোর্সটি এক বছরের।
সমমানের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের স্নাতকোত্তর সিলেবাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দুই সেমিস্টার মিলে ১০টি বিষয় শিক্ষার্থীদের পড়তে হয়। এখানে পবিত্র কোরআনের তাফসির, উলুমুল কোরআন (সায়েন্স অব দ্য কোরআন) ও হাদিস শরিফের বাইরে ‘টিচিং অ্যান্ড রিসার্চ মেথোডলজি’ এবং ‘ইভ্যালুয়েশন অ্যান্ড ফিলোসফি অব রিলিজিয়ন অ্যান্ড কমপ্যারেটিভ রিলিজিয়ন’ নামে দুটি কোর্স পড়ানো হয়।
অন্যদিকে সরকারি স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সাধারণ ধারার মাদ্রাসাগুলোতে কামিল হলো মাস্টার্স সমমানের। সরকারি মাদ্রাসা ই আলিয়া, ঢাকার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ্দীন আহমাদ বলেন, দাওরায়ে হাদিসে যা পড়ানো হয়, তাঁরাও কামিল শ্রেণিতে প্রায় একই ধরনের বিষয় পড়ান। তবে কিছু বইপত্র আলাদা। এর বাইরে কামিলে ইসলামের ইতিহাসও পড়ানো হয়।
কমিটিতে হেফাজতের প্রাধান্য
শিক্ষা মন্ত্রণালয় কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসের সনদের মান বাস্তবায়নে যে কমিটি গঠন করেছে, তার চেয়ারম্যান বেফাকের সভাপতি (পদাধিকারবলে) ও হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির শাহ আহমদ শফী। মন্ত্রণালয় ১৭ সদস্যের কমিটির কথা বললেও আরও ১৫ সদস্য অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ আছে। ইতিমধ্যে ৩২ সদস্যের কমিটি গঠনও হয়েছে। কমিটিতে হেফাজতে ইসলামের নেতা ও বেফাকের প্রাধান্য দেখা গেছে। কমিটির কো-চেয়ারম্যান মাওলানা আশরাফ আলী। তিনি বেফাকের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি। বেফাকের মনোনীত পাঁচ সদস্যের মধ্যে আছেন ঢাকা মহানগর হেফাজতে ইসলামের প্রধান মাওলানা নূর হোসেন কাসেমী।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের শরিক জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের নির্বাহী সভাপতি মুফতি মো. ওয়াক্কাসও এ কমিটিতে আছেন। নূর হোসেন কাসেমীও জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব। অন্তর্ভুক্ত করা ১৫ সদস্যের কমিটিতে শাহ আহমদ শফীর ছেলে মাওলানা আনাস মাদানীও আছেন। এ ছাড়া আছেন হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নেতা মুফতি ফয়জুল্লাহ, ঢাকা মহানগরের সহসভাপতি ও বেফাকের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হকসহ আরও কয়েকজন।