সচেতনতা বাড়ানো জরুরি

আজ ২৬ সেপ্টেম্বর বিভিন্ন দেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব জন্মনিরোধ দিবস। ২০০৭ সাল থেকে দিবসটি পালিত হচ্ছে।

চতুর্থ প্রজন্মের জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি জনপ্রিয় হচ্ছে
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

দেশে প্রজননসক্ষম দম্পতির অর্ধেক এখনো আধুনিক জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করেন না। জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারে অনিয়মিত হয়ে পড়ার হারও বাড়ছে। বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস) ২০১৭-১৮ অনুসারে, ৫২ শতাংশ নারী-পুরুষ আধুনিক জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করছেন। ২০১৪ সালে তা ছিল ৫৪ শতাংশ। অনিয়মিত হয়ে পড়ার হার ২০১৪ সালে ৩০ শতাংশ ছিল। ২০১৭ সালে এ হার বেড়ে ৩৭ শতাংশ হয়।

জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রচারের অভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণের আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহারে দম্পতিদের সচেতন করা যাচ্ছে না। ঘরে ঘরে প্রচারের ফলে আশির দশকে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে যে সাফল্য এসেছিল, সরকারের মনোযোগের অভাবে সেটি ব্যাহত হচ্ছে। ভবিষ্যতের জনবিস্ফোরণ ঠেকাতে এখন থেকেই সচেতনতামূলক প্রচার বাড়ানো উচিত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

১৫-৪৯ বছর বয়সী নারীরা যত সন্তানের জন্ম দেন, তা হচ্ছে মোট প্রজনন হার (টোটাল ফার্টিলিটি রেট—টিএফআর)। ২০১১ সাল থেকে দেশে টিএফআর ২ দশমিক ৩-এ আটকে আছে। অথচ ২০১৫ সালে টিএফআর ২ দশমিক ১-এ নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা ছিল।

আজ ২৬ সেপ্টেম্বর বিভিন্ন দেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব জন্মনিরোধ দিবস। জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী ব্যবহারে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ২০০৭ সাল থেকে দিবসটি পালিত হচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম বলেন, অপরিকল্পিত গর্ভধারণে মাতৃস্বাস্থ্য ঝুঁকি ও জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ঠেকাতে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণ জরুরি। তবে অনেক দিন থেকেই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে একধরনের স্থবিরতা দেখা যাচ্ছে। দম্পতিদের সচেতন করতে ঘরে ঘরে গিয়ে প্রচার চালানোর কোনো বিকল্প নেই। প্রশিক্ষিত, দক্ষ কর্মী নিয়োগ করতে হবে, যাঁরা দম্পতিদের আধুনিক জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারে আগ্রহী করে তুলতে পারবেন।

বিডিএইচএসের জরিপ অনুসারে, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারকারীদের মধ্যে খাওয়ার বড়ি ব্যবহারের হার বেশি, ২৫ শতাংশ। এ ছাড়া জন্মনিয়ন্ত্রণের অন্যান্য পদ্ধতির মধ্যে ইনজেকটেবল ব্যবস্থা নেন ১১ শতাংশ, কনডম ৭ শতাংশ, নারী বন্ধ্যাকরণ হয় ৫ শতাংশ, পুরুষ বন্ধ্যকরণ ১ শতাংশ, ইমপ্ল্যান্ট ২ শতাংশ ও জরায়ুতে স্থাপন উপযোগী ইন্ট্রা-ইউটেরিন ডিভাইস (আইইউডি, যা কপার টি নামেও পরিচিত) শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ। এর মধ্যে কনডম, নারী বন্ধ্যাকরণ, ইমপ্ল্যান্ট ছাড়া বাকি চারটি পদ্ধতি ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২০১৪ সালের তুলনায় কমেছে।

করোনাকালের শুরুর দিকে লকডাউনের কারণে জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী সরবরাহে যথেষ্ট ঘাটতি ছিল বলে জানিয়েছেন জ্যেষ্ঠ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আবু জামিল ফয়সাল। তিনি বলেন, করোনাকালে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ কার্যক্রম বেশ ব্যাহত হয়েছে। এ সময়ে ইমপ্ল্যান্ট কমেছে সবচেয়ে বেশি। কারণ, সেবা পাওয়া যাচ্ছিল না। জন্মনিয়ন্ত্রণে অন্যতম পদ্ধতি ইনজেকটেবল ক্ষেত্রে তিন মাস মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়ার পর অনেকেই দিতে পারেননি। আইইউডি এমনিতেই জনপ্রিয় নয়, এটা করোনাকালে সবচেয়ে কম হয়েছে। তাঁর মতে, দম্পতিদের সচেতন করতে প্রচার কার্যক্রমে গতি বাড়াতে হবে, সরকারকে আরও মনোযোগী হতে হবে।

তবে করোনাকালে জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী সরবরাহের ঘাটতি কাটিয়ে ওঠা গেছে বলে জানিয়েছেন পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (মা ও শিশুস্বাস্থ্য) মোহাম্মদ শরীফ। তিনি বলেন, নানাভাবে দম্পতিদের সচেতন করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ঘরে ঘরে গিয়ে প্রচার চালানোর জন্য যে লোকবল প্রয়োজন, তা নেই। আশির দশকে গড়ে ৬০০ দম্পতির জন্য ১ জন কর্মী ছিলেন। এখন দেড় থেকে দুই হাজার দম্পতির জন্য একজন কর্মী।

সম্প্রতি মোহাম্মদপুর ফার্টিলিটি সার্ভিসেস অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার এবং ১০০ শয্যাবিশিষ্ট মা ও শিশুস্বাস্থ্য হাসপাতালে গিয়ে ২২০ নম্বর কক্ষের সামনে অপেক্ষা করতে দেখা যায় কয়েক দম্পতিকে। হাসপাতাল থেকে বিনা মূল্যে জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি নিতে এসেছিলেন মোহাম্মদপুরের নূরজাহান রোডের বাসিন্দা এক গৃহবধূ (৪০)। তিনি জানান, জন্মনিয়ন্ত্রণের আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহারে তিনি বেশ অনিয়মিত। কখনো কখনো সনাতন পদ্ধতিও অনুসরণ করেন।

২৩ বছরের এক নতুন মা এসেছিলেন দীর্ঘস্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ইমপ্ল্যান্টের ফলোআপের জন্য। তিনি জানালেন, ২৭ জুলাই এ হাসপাতালে তাঁর মেয়ে জন্মের পরপর স্বামীর সিদ্ধান্তে তাঁকে ‘ইমপ্ল্যান্ট’ পরানো হয়।

হাসপাতালে দুজন পরিবার কল্যাণ পরিদর্শক সুলতানা জামান ও আফসানা বেগম জানালেন, প্রতিদিন সকাল নয়টা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত তাঁদের কাছে জন্মনিয়ন্ত্রণের আধুনিক পদ্ধতির সাত ধরনের সেবা নিতে আসেন নারী-পুরুষেরা। হাসপাতালে বড়ি ও কনডমের জন্য দম্পতিরা কম আসেন। সেপ্টেম্বরের প্রথম ১৪ দিনে ইমপ্ল্যান্ট হয়েছে ৯৩টি, পুরুষ বন্ধ্যকরণ হয়েছে ৭৯টি, নারী বন্ধ্যাকরণ ২০টি, আইইউডি ২৭টি ও ইনজেকটেবল ব্যবস্থা দেওয়া হয়েছে ১৪টি। এ ছাড়া পিল নিতে ৮ জন ও কনডম নিতে ১০ জন এসেছেন।

বিডিএইচএসের জরিপে বলা হয়েছে, জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী সরবরাহে বেসরকারি খাত অনেক বেশি এগিয়ে। আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহারকারী ৪৯ শতাংশের চাহিদা মেটাচ্ছে তারা। ৪৫ শতাংশ জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী নেন ওষুধের দোকান থেকে। ৪৪ শতাংশ সরবরাহ পান সরকারি পর্যায় থেকে। সে ক্ষেত্রে বড়ি, কনডমের চেয়ে অন্য সেবাগুলো বেশি নেন ব্যবহারকারীরা। ৫ শতাংশ সেবা পান বেসরকারী সংস্থা (এনজিও) থেকে।

মোহাম্মদপুর ফার্টিলিটি সার্ভিসেস অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারের পরিচালক মো. মুনিরুজ্জামান সিদ্দিকী বলেন, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারে দম্পতিদের আগ্রহী করতে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।

সেন্টারের উপপরিচালক মাকসুদা বেগম বলেন, সচেতনতা ছাড়া জন্মনিয়ন্ত্রণে সাফল্য আসা সম্ভব নয়।