সদরে করোনা, অন্দরে রাজনীতি

করোনাকালে জাতীয় সংসদের উপনির্বাচনের সময় ভোটারশূন্য কেন্দ্র।ছবি: সাজিদ হোসেন

বাংলাদেশ সরকারিভাবে করোনায় আক্রান্ত হয়েছে এ বছরের মার্চে। তখন থেকেই শাটডাউন, লকডাউন, সাধারণ ছুটি—এসব কথাবার্তা। ইতিমধ্যে পেরিয়ে গেছে সাত মাসের বেশি সময়। জনজীবন অনেকটাই বদলে গেছে। ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’—সেই দিন শিগগিরই ফিরে আসবে না।

এ দেশের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ‘রাজনীতি’। এটি কারও কাছে ঝামেলা, কারও কাছে বিনোদন, কারও কাছে রুটি-রুজির অস্ত্র। একসময় রাজনীতি ছিল পথেঘাটে, সব জায়গায়। মানুষ যে পলিটিক্যাল অ্যানিমেল, এটা বুঝতে শাস্ত্রপাঠের দরকার হয় না। বিদ্বজ্জনেরা এটাকে বানিয়েছেন জীবনের অপরিহার্য অনুষঙ্গ। রাজনীতি যদি মুহূর্তের জন্যও গরহাজির হয়, সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যায় চেঁচামেচি—দেখো দেখো, বিরাজনীতিকরণ শুরু হয়ে গেছে! খুবই লজ্জার কথা! না খেয়ে থাকা যায়। তাই বলে রাজনীতি থাকবে না?

মহিউদ্দিন আহমদ

করোনাঝড়ে সবচেয়ে বেশি লন্ডভন্ড হয়েছে দুটি জিনিস—সাধারণ মানুষের আয়-রোজগার ও রাজনীতি। রাজনীতি মানেই রাস্তা আটকে মিছিল, মাঠে লোকভর্তি করে সভা-সমাবেশ। ইদানীং রাজনীতিতে চলছিল ভাটার টান। কয়েক বছর ধরেই রাজনীতি হয়ে গেছে একপক্ষীয়, একঘেয়ে ও বিরক্তিকর। যেটুকু ছিল, করোনা এসে তা তছনছ করে দিয়েছে। এখন তো সবার মুখে মুখে কোভিড-১৯। দেখা যায় না, ধরা যায় না—এমন এক গজব নেমে এসেছে। চারদিকে শুধু আতঙ্ক।

আগে কারও সঙ্গে দেখা হলে কুশল বিনিময়ের পর অবধারিতভাবে একটা প্রশ্ন উঠত—দেশের অবস্থা কী? দেশ নিয়ে কথা উঠলেই রাজনীতির আলাপ হতো। এখন চালচিত্র বদলে গেছে। শহুরে মধ্যবিত্ত এখন প্রয়োজন না হলে ঘরের বাইরে পা ফেলে না। কদাচিৎ কারও সঙ্গে দেখা হলে কিংবা ফোনে কথা হলে প্রথম জিজ্ঞাসাটাই হলো, তবিয়ত ঠিক আছে তো? প্রশ্নকর্তা নিশ্চিত হতে চান—করোনা হানা দিয়েছে কি না। জ্বর-কাশি-শ্বাসকষ্ট আছে কি না। কোনো রকম শারীরিক অসুবিধা না থাকলে জবাব দিই, এখনো ভালো আছি। নিখরচায় নিশ্বাস নিতে পারছি।

এ দেশে রাজনীতি মানেই দল। কেউ বড়, কেউ ছোট। কেউ ডান, কেউ বাম। যাঁদের ট্যাঁকের জোর কম, তাঁদের অফিস দলের নেতার বৈঠকখানায়। যাঁরা বেশি চাঁদা তুলতে পারেন, তাঁরা অফিসপাড়ায় কিংবা আবাসিক এলাকায় সাইনবোর্ড লাগিয়ে বসেন। এখন চলছে কৃষ্ণপক্ষ। অফিসে বাতি জ্বলে না। ভয়ে কেউ অফিসমুখী হতে চান না। দলের অফিস বেশির ভাগই সুনসান। নেতার মুখে রাজনীতির বয়ান শোনার জন্য জানের ঝুঁকি নেওয়ার গরজ আছে কার? সুতরাং বিকেল হলেই পার্টি অফিসে আসর গুলজার করে রাজা-উজির মারার দিন আর নেই।

নেসেসিটি ইজ দ্য মাদার অব ইনভেনশন। দলগুলোর পালে লেগেছে নতুন প্রযুক্তির হাওয়া—জুম। ঘরে বসেই অডিও-ভিডিওতে কথা চালাচালি হয়। তবে এ ব্যবস্থায় বেশি লোক যুক্ত হতে পারেন না। এ হলো দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো। তাতে তৃষ্ণা মেটে না।

আগে দলের নানান কর্মকাণ্ড ছিল। রাজনৈতিক দলের নিজস্ব ভাষা আছে। যেমন বলা হতো, প্রোগ্রাম থ্রো করো। প্রোগ্রাম মানে বিক্ষোভ মিছিল কিংবা জনসভা। দেয়ালজুড়ে পোস্টার আর কর্ণবিদারী মাইকিং। এটি এখন আর তেমন নেই। মাঝেমধ্যে দু-একটা মানববন্ধন হয়।

একসময় তো প্রেসক্লাবের দোতলায় ঘর ভাড়া নিয়ে নিয়মিত মতবিনিময় সভা, গোলটেবিল বৈঠক আর সংবাদ সম্মেলন হতো। গণমাধ্যমে খবর যাবে, এই আশায় প্রেসক্লাবটাই ছিল সবচেয়ে মোক্ষম। সেখানে সংবাদ ও চিত্রগ্রাহকদের চটজলদি পাওয়া যায়। করোনাকালে এতেও ছেদ পড়েছে। তারপরও ভরসা দৈনিক পত্রিকা আর টেলিভিশন চ্যানেলগুলো।

তো করোনাকালে পত্রিকাগুলো মুখ থুবড়ে পড়েছে। শুরুর দিকে এতটাই আতঙ্ক ছড়িয়েছিল যে অনেকেই বাড়িতে ছাপা কাগজ রাখা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। অনেক হকার গ্রামে চলে গিয়েছিলেন। গ্রাহকের সংখ্যা কমে গিয়েছিল প্রায় ৮০ শতাংশ। ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিজ্ঞাপন পাওয়াও প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বিজ্ঞাপন ছাড়া ছাপা কাগজ চিন্তা করা যায় না। পত্রিকাগুলো সাশ্রয়ের জন্য পৃষ্ঠাসংখ্যা কমিয়ে দিল। কাগজের সিংহভাগজুড়ে থাকে করোনার সংবাদ আর স্বাস্থ্য বার্তা। অন্যান্য খবরের জায়গা গেছে কমে। রাজনীতির খবর হয়েছে আরও কোণঠাসা। সব মিলিয়ে রাজনীতির কৃষ্ণপক্ষ চলছে।

দেশে আছে বহুদলীয় রাজনীতি।একটি দল তার পাত্র-মিত্র-অমাত্যদের নিয়ে ক্ষমতায়। ক্ষমতায় থাকলে একটু কর্তৃত্বপরায়ণ হবে, এটাই ধর্ম।ক্ষমতা আর কর্তৃত্ব তো পরস্পরের ভূষণ।

দেশে আছে বহুদলীয় রাজনীতি। একটি দল তার পাত্র-মিত্র-অমাত্যদের নিয়ে ক্ষমতায়। ক্ষমতায় থাকলে একটু কর্তৃত্বপরায়ণ হবে, এটাই ধর্ম। ক্ষমতা আর কর্তৃত্ব তো পরস্পরের ভূষণ। স্বাভাবিক অবস্থায় ক্ষমতাসীনদের পাইকপেয়াদা আর লেঠেলদের এড়িয়ে গিয়ে কিংবা মোকাবিলা করে বিরোধীরা মাঝেমধ্যে একটু খোঁচা দেয়, হইচই করে। করোনা তাতেও বাদ সেধেছে। এখন চারদিকে শুধু শান্তি! এত শান্তি তো ভালো না! ক্ষমতাসীন দলের কোনো কোনো কর্তা কারণে-অকারণে অনুপস্থিত বিরোধীদের দিকে আঙুল উঁচিয়ে হুঁশিয়ারি দেন। মানুষ এটা টেলিভিশনে দেখে কিছুটা বিনোদন পায়।

এখন তো আর মিছিল কিংবা জনসভা হয় না। দলের নেতার জন্মদিন-মৃত্যুদিন, দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী, জেলে যাওয়া এবং জেল থেকে ছাড়া পাওয়া দিবস—এসব তিথি-পার্বণে একটু জমায়েত হওয়া, দু-চারটা স্লোগান দেওয়া, টিভি ক্যামেরার সামনে ঠেলাঠেলি করে দাঁড়ানো—এসবও ছিনতাই করে নিয়ে গেছে করোনা। টিভি সংবাদে ৩০-৪০ সেকেন্ডের ফুটেজে জায়গা পেয়ে যেটুকু কথা বলা যায়, তা-ই ভরসা। টিভি অবশ্য সরকারের কর্তাদের বয়ানই বেশি শোনায়। তাঁরা বলেন, ‘আমরা দেখছি, আমরা ভাবছি, আমরা শিগগিরই বিবেচনা করব’ ইত্যাদি।

তারপরও মানুষের শেষ ভরসা গণমাধ্যম। অনুশাসনের ফাঁকফোকর গলে বিস্ময়কর সব খবর বেরিয়ে আসে—রূপপুরে বালিশকাণ্ড, মিরপুরে আবজালের সাতমহলা বাড়ি, ওসি প্রদীপের প্রাইভেট থানা, পি কে হালদারের হাজার কোটি টাকা নিয়ে চম্পট। স্বাস্থ্য খাত তো একেবারে উদোম হয়ে গেছে। সরকারের নানান দপ্তরে চুরিচামারির সংবাদ বেরোলে কর্তারা এত দিন বলতেন, ‘এই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করলাম, এসব ষড়যন্ত্র। ’ এই প্রত্যাখ্যানওয়ালাদের মুখে এখন রা নেই।

স্বাস্থ্য খাত তো একটা ‘টিপ অব দ্য আইসবাগ’। অন্যান্য খাতের খবরও সুখকর নয়। স্বাভাবিক অবস্থা থাকলে এ নিয়ে রাজনীতির মাঠে কিছুটা উত্তাপ ছড়াত। এখন সেটি হচ্ছে না।

করোনাকালে রাজপথে খানিকটা সক্রিয় ছিল বামপন্থী দলগুলো।
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

রাজনীতির সঙ্গে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার একটা সম্পর্ক আছে। বলা হয়, রাষ্ট্র হচ্ছে পছন্দের লোকদের সুবিধা বিলানোর প্রতিষ্ঠান। করোনাকালে তা থেমে নেই। সুবিধাজনক জায়গায় পৌঁছাতে সবাই মরিয়া। সম্প্রতি জাতীয় সংসদের কয়েকটি আসনে উপনির্বাচন হলো। একটি আসনে নাকি সরকারি দলের ৫৬ জন মনোনয়ন চেয়েছিলেন। ঢাকার একটি আসনে বিরোধী দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী দুই তালেবর প্রার্থীর সমর্থকেরা দলের অফিসের সামনে রীতিমতো কুরুক্ষেত্র বাধিয়ে দিয়েছিলেন। যতই দুর্দিন আসুক, মৌ-লোভীদের ভিড় কমে না।

এর মধ্যে একটা বড় খবর হলো, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারা হাসপাতাল থেকে নিজের বাসায় গেছেন। আইনি বাধ্যবাধকতার কারণে তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হতে পারছেন না। বর্তমান অবস্থায় তাঁর ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দ্য ও স্বস্তি বাড়লেও তাতে তাঁর দলের অবস্থায় কোনো হেরফের হয়নি। একজন ‘নিষ্ক্রিয়’ বিরোধী নেতাকে নিয়ে সরকারি মহলে কোনো অস্বস্তি নেই।

করোনাকাল যে প্রলম্বিত হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এর মধ্যে অনেক বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদের মৃত্যু হচ্ছে এবং হবে। কেউ করোনার শিকার, কেউ-বা অন্য কারণে। নাগরিকেরা করোনার সঙ্গে আপস করে জীবনযাত্রা ঢেলে সাজাচ্ছেন। তাঁদের কারও কারও পেশা বদল হচ্ছে, আয় কমছে, বেকার হয়ে পড়ছেন অনেকেই। যাঁর যেটুকু অবলম্বন, তাকে ধরেই সবাই টিকে থাকার চেষ্টা করছেন। তাঁদের কাছে রাজনীতির উপযোগিতা এখন তলানিতে ঠেকেছে। এ অবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের দৃশ্যমান রাখার উপায় খুঁজছে। কিন্তু কোনো সমাধান পাচ্ছে না। এত বিপদের মধ্যেই দেখা যায় অপছন্দের জমায়েতের ওপর লেঠেলদের হামলা, ভাঙচুর। এর মধ্যেই নিষ্ক্রিয় একটি দল ভেঙে দুই ভাগ হয়ে গেল। বহিষ্কার আর পাল্টাবহিষ্কার চলল। রাজনীতি সদর থেকে অন্দরে ঢুকে গেলে কী হবে, রাজনীতির সনাতন খাসলত এতটুকু বদলায়নি। এই একটি জায়গায় করোনা মার খেয়েছে।

মহিউদ্দিন আহমদ : লেখক ও গবেষক