‘সন্তান না থাকা নিয়ে যখন কথা শুনতে হয়, সেই যন্ত্রণা ও দহন বাড়তেই থাকে’

প্রতীকী ছবি

‘আমার সন্তান হচ্ছে না, বাসায় বিদ্যুতের কাজ যিনি করতে আসেন, তাঁরও এ নিয়ে চিন্তা। সন্তান না থাকলে বুড়ো বয়সে আমাকে কে খাওয়াবে, কে দেখবে? কবিরাজের কাছে যাওয়ারও পরামর্শ দিয়ে যান তিনি। অনেক শিক্ষিত ব্যক্তিও সরাসরি জানতে চান বাচ্চা হয় না, কী সমস্যা অথবা কার সমস্যা? মা হতে না পারার বিষয়টি নিয়ে মাথাব্যথা হয় অন্যদের।’ কথাগুলো বলছিলেন আমরাই পারি পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোট-উই ক্যানের প্রধান নির্বাহী জিনাত আরা হক।

৮ মে ছিল বিশ্ব মা দিবস। এই দিবসে সন্তানেরা মায়ের ছবি, মাকে নিয়ে না বলা কথাগুলো ফেসবুকে শেয়ার করেছেন। মায়েরাও সন্তানের পাশাপাশি নিজের মা ও শাশুড়ির ছবি শেয়ার করেছেন। আর মা হতে না পারা জিনাত আরা হক বা সন্তানের জন্ম দেবেন না বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া নারীরা ফেসবুকে লিখেছেন নিজেদের ক্ষোভের কথা। শুধু তা–ই নয়, কর্মজীবী মায়ের সন্তানেরা মায়ের আঁচলের তলে বড় হতে পারছে না বলে এই সন্তানেরা আসলেই মানুষ হতে পারবে কি না, তা নিয়েও অনেকে ফেসবুকে কথা বলেন। প্রতিবন্ধী ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন সন্তানের মায়েদের কথা শোনানো তো আছেই। এসব তর্কবিতর্কের পাশাপাশি মা দিবসে সাগরের তীর থেকে ঢালিউডের আলোচিত নায়িকা পরীমনির গর্ভাবস্থার পেটের ছবিও ফেসবুকে তুমুল আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তিনি তাঁর মাতৃত্বকে কেন এভাবে উদ্‌যাপন করছেন, তা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন।

সেদিন পরিচিত একজন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার মরে যেতে ইচ্ছা করে না? আমি জানতে চাইলাম, কেন ইচ্ছা করবে? জীবন তো একটাই। উনি বললেন, এই যে আপনার কোনো বাচ্চাকাচ্চা নেই, তাই বললাম আরকি! বাচ্চা না থাকলে নাকি একটা মেয়ের বেঁচে থাকার কারণ শেষ হয়ে যায়।
তানিয়া ওয়াহাব, ব্যবস্থাপনা অংশীদার, কারিগর

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রজননস্বাস্থ্যের যে সংজ্ঞা দিয়েছে, তাতে স্পষ্ট করেই বলা আছে—একজন নারীর স্বেচ্ছায় গর্ভধারণ, গর্ভকালীন সেবা নেওয়া ও সুস্থ সন্তানের জন্ম দেওয়ার অধিকার আছে। অর্থাৎ বিষয়টিকে নারীর অধিকার হিসেবেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। নারীর এ অধিকারে কেউ মাথা ঘামাচ্ছেন বুঝে বা না বুঝে অথবা শুধুই নারীকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলার জন্য। অনেকে বিষয়টিতে কথা বলে বিকৃত আনন্দও পাচ্ছেন। আবার অনেকেই মাথা ঘামান সহানুভূতি থেকে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মজীবী নারী জানালেন, তিনি একবার মা হওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গেছেন। গর্ভপাত ঘটায় মাতৃত্ব স্থায়ী হয়েছিল চার মাস। চল্লিশোর্ধ্ব এই নারী জানালেন, গর্ভপাতের সেই সময় স্বামীর যে আচরণ ছিল, যে রূঢ়তা ছিল, তা দেখে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আর কোনো দিন সন্তানের মা হবেন না। তিনি চাননি, তাঁর স্বামীর মতো সন্তানও অমানবিক হোক। এই নারী বলেন, ‘আমি চাইনি খারাপ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সন্তান পৃথিবীতে আসুক।’

তবে মা হতে না পারা, মা হতে না চাওয়া বা সন্তানের মায়েরা বলছেন, মাতৃত্ব নিয়ে অযাচিত প্রশ্ন করা শোভন নয়। শিক্ষিত ব্যক্তিদের কাছ থেকে অযাচিত প্রশ্ন একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাই এ বিষয়ে সামাজিক সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। নিঃসন্তান দম্পতিকে সন্তান নিয়ে প্রশ্ন করার আগে ১০০ বার ভাবতে হবে।

যেভাবে হয়রানি

উদ্যোক্তা হিসেবে ট্যানের স্বত্বাধিকারী এবং কারিগরের ব্যবস্থাপনা অংশীদার তানিয়া ওয়াহাব দেশ–বিদেশে বেশ সুনাম কুড়িয়েছেন। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন নানা পুরস্কার। অর্থাৎ নিজের একটি অবস্থান তৈরি করে নিয়েছেন। তবে সন্তান না হওয়া নিয়ে তাঁকেও বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। বললেন, ‘পারিবারিক কোনো অনুষ্ঠান নয়, পেশাগত কাজে যাচ্ছি, যখনই শোনে সন্তান নেই, তখন কার সমস্যা, প্রবলেম হলে আছি, এমন কথা বলেন শিক্ষিত মানুষজন, তাঁদের কেউ কেউ পিএইচডি করা।’

তানিয়া ওয়াহাব তাঁর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘সেদিন পরিচিত একজন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার মরে যেতে ইচ্ছা করে না? আমি জানতে চাইলাম, কেন ইচ্ছা করবে? জীবন তো একটাই। উনি বললেন, এই যে আপনার কোনো বাচ্চাকাচ্চা নেই, তাই বললাম আরকি! বাচ্চা না থাকলে নাকি একটা মেয়ের বেঁচে থাকার কারণ শেষ হয়ে যায়। একটা মেয়ে নাকি অসম্পূর্ণ বাচ্চা ছাড়া। অনেকেই আবার এক ধাপ বাড়িয়ে বলে যে ক্যারিয়ার করা মেয়েরা বাচ্চা নিতে চায় না।’

তানিয়া লিখেছেন, ‘আমি প্রথম কনসিভ করি ২০১২ সালে। প্রথম যখন হার্টবিট শুনলাম মেডিনোভাতে, আমার নিজের বিট থেমে গিয়েছিল প্রায়। আমার মনে হলো, হার্টবিটের শব্দটা এই জগতের কোনো শব্দ নয়, সেটা অন্য জগতের। মনে হচ্ছিল শব্দটা আমাকে ডাকছে, মা...।’

তানিয়া ফেসবুকেই জানিয়েছেন, অনেক সাবধান থাকার পরও ওই সন্তান পৃথিবীর আলো দেখতে পায়নি। গর্ভপাত হয়। এরপর ছয় মাস প্রায় পাগলের মতো কেটেছে তানিয়ার। একা থাকলেই সন্তানের হার্টবিটের শব্দ শুনতেন। পরে আস্তে আস্তে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে শুরু করেন। তখনো মানুষ শুনিয়েছে যে নিজের ক্যারিয়ারের জন্য তিনি নাকি গর্ভপাত করিয়েছিলেন।

তানিয়া চেয়েছিলেন সন্তানের মা হতে। তাই ক্ষতিকর ওষুধ হাসিমুখে খেয়েছেন। অস্ট্রেলিয়াতে বিশেষ চিকিৎসা আইভিএফ করতে গিয়েছেন। ইনজেকশন ভয় পাওয়া তানিয়া দিনে দু–তিনটা ইনজেকশন দিতেন। চিকিৎসক জানিয়েছিলেন, সন্তান নিতে চাইলে তাঁর জীবনের ঝুঁকি আছে, সেই ঝুঁকি নিয়েই আবার অন্তঃসত্ত্বা হয়েছিলেন, তবে আবারও গর্ভপাত হয়। তারপর তিনি তাঁর ভাগ্যকে মেনে নিয়েছেন।

তানিয়া বলেন, ‘জীবনে যা পেয়েছি, তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকার মনমানসিকতা আমার আছে। অথচ আমি এমন কোনো অনুষ্ঠানের কথা মনে করতে পারি না, যেখানে মা না হওয়ার কারণে আমাকে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় না।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মজীবী নারী জানালেন, তিনি একবার মা হওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গেছেন। গর্ভপাত ঘটায় মাতৃত্ব স্থায়ী হয়েছিল চার মাস। চল্লিশোর্ধ্ব এই নারী জানালেন, গর্ভপাতের সেই সময় স্বামীর যে আচরণ ছিল, যে রূঢ়তা ছিল, তা দেখে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আর কোনো দিন সন্তানের মা হবেন না। তিনি চাননি, তাঁর স্বামীর মতো সন্তানও অমানবিক হোক। এই নারী বলেন, ‘আমি চাইনি খারাপ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সন্তান পৃথিবীতে আসুক।’

ওই নারী বলেন, মা না হওয়ার যন্ত্রণা তাঁরও আছে। আর এই সন্তান না থাকা নিয়ে যখন বারবার কথা শুনতে হয়, সেই যন্ত্রণা ও দহনের মাত্রা শুধু বাড়তেই থাকে। এ থেকে পালাতে যেখানেই যান, সেখানে এই বয়সেও এ নিয়ে কথা শুনতেই হয়।

এই নারী বললেন, ‘কেউ কেউ আমাকে কাছে না পেলে আমার মা–বাবাকে পরামর্শ দেন, আমাকে যাতে তাঁরা কবিরাজ-ফকিরের কাছে নিয়ে যান। অর্থাৎ যন্ত্রণাটা শুধু আমার থাকে না, তা পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। মা–বাবা আমার জন্য কষ্ট পান। যত বয়স হচ্ছে, হাহাকারটা বাড়ছে। কাজ শেষে ছোট ছোট ক্লিপ কিনে আমারও বাড়ি ফিরতে মন চায়। একইভাবে বাবা যাঁরা হতে চান, সংবেদনশীল মন যাঁদের, তাঁদেরও মন খারাপ হয়। তবে পুরুষেরা বাইরে সময় কাটিয়ে বা বিভিন্নভাবে মন খারাপ কাটানোর পথ খুঁজে নিতে পারেন, নারীরা তা অনেকটাই পারেন না।’

রাজধানীতে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করা এই নারী মনে করেন, নারীর সার্থকতা মা হতেই হবে, কথাটা ঠিক নয়। নারীর করার আরও অনেক কিছু আছে।

তিনি বলেন, ‘শারীরিকভাবে আমি মা হতে পারিনি, কিন্তু মা হওয়ার জন্য তো অনেক পথ আছে। আমি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কয়েকজন বাচ্চাকে পড়াচ্ছি, আমাকে তারা মা ডাকে, একটার বদলে চারটা বাচ্চা মানুষ হচ্ছে। গাছ ভালোবাসি, গাছ ধরলে মনে হয়, গাছের সঙ্গে আদান-প্রদান হচ্ছে। এক হাজার গাছ লাগাতে পারলে তা-ও তো একটা মাতৃত্ব। পড়ি, লিখি, অন্য কোনো বিষয়ে মনোযোগ দিই, যে জায়গায় গেলে কথা শুনতে হবে, সেসব জায়গা এড়িয়ে চলি। এভাবে ওই যন্ত্রণার জায়গাটা থেকে বের হয়ে আসি। মানুষের অনেক সীমাবদ্ধতা থাকে, হয়তো সেই জায়গা থেকেই তার সন্তান আছে অথচ আমার নেই, তা মনে করিয়ে দিয়ে আত্মতৃপ্তি পায়।’

এই নারীর মতে, সন্তান থাকা বা না থাকার মতো ব্যক্তিগত বিষয়ে হুট করে কথা বলা শোভন নয়, তা অনেকেই বুঝতে চান না বা মানতে চান না। তবে বিষয়টিতে পরিবর্তন আসছে। ছয় বছর আগে গ্রামে গেলে মানুষের কাছ থেকে যে আচরণ পাওয়া যেত, এখন আর তেমন পেতে হচ্ছে না।

এ বিষয়ে জিনাত আরা হক ফেসবুকে এক পোস্টে লিখেছেন, ‘মাতৃত্ব নারীর জীবনের একটি পর্যায়মাত্র। নিঃসন্দেহে খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া। কিন্তু মা হওয়াটাই নারীর একমাত্র ব্রত হতে পারে না বা পরিচয়ও না বা গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার পথ নয়। আমরা তো সুলতান সুলেমানের হেরেমের বাঁদি নই যে পুত্রসন্তান দিয়ে রাজতন্ত্র টিকিয়ে রাখার দায় নিতে হবে। যেকোনো কারণে আপনি সন্তান জন্ম দিতে চাননি বা হয়নি, তাই আপনার সব সুখ, আনন্দ, বন্ধু-পরিজন ত্যাগ করে নির্বাসিত জীবন কাটানোর কোনো প্রয়োজন নেই।’ জিনাত আরা হকের মতে, একজন মানুষ হিসেবে দুনিয়ার রং-রস উপভোগ করতে হবে। প্রকৃতির যে গল্প সাজানো, তাতে নিজের গল্প বুনতে হবে।

এ ধরনের সংকট থেকে উত্তরণে হেলাল উদ্দিন আহমেদের পরামর্শ হচ্ছে, সন্তান বা প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে বিভিন্ন সংকটে থাকা নারী ও পুরুষের কাছের মানুষদের সংবেদনশীল হতে হবে। সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে, ব্যক্তিমানুষটির ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে।

যেখানে পরিবর্তন দরকার

এ বিষয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, মানুষের বয়সের সঙ্গে সঙ্গে পরিবারে-সমাজে তার ভূমিকা পরিবর্তিত হয়। একজন মানুষ মা, বাবা, দাদা হবেন কি না, তা তাঁর ব্যক্তিস্বাধীনতার অংশ। তাঁর ইচ্ছার অংশ। অন্যের ব্যক্তিগত বিষয়ে মতামত না দেওয়ার বোধটি জরুরি। এটি যে আদবের জায়গা, তা মানুষকে বুঝতে হবে, এ পরিবর্তন আসাটা জরুরি। সভ্য হওয়ার সূচক হচ্ছে অন্যের কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলা যাবে না, সেই বোধটুকু তৈরি হওয়া। একইভাবে কর্মজীবী মায়েদের বিভিন্ন কথা শুনতে হচ্ছে। এই নারীরাও কাজ করছেন সন্তানের ভালোর জন্য। আর সারা দিন সন্তানের পাশে থাকা জরুরি নয়, যতটুকু সময় দেওয়া হচ্ছে, তা গুণগত হচ্ছে কি না, সন্তানের সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদান হচ্ছে কি না, তা জরুরি; সেটা সবাইকে বুঝতে হবে।

জিনাত আরা হকও বলছিলেন, পারিবারিক নির্যাতনের পেছনে সন্তান লালন-পালনের বিষয়টিও ভূমিকা রাখছে। সন্তানকে দেখার কেউ নেই। তাই নারীকে বলা হচ্ছে চাকরি ছেড়ে দাও। সন্তান লেখাপড়া করে না, এটাও মায়ের ‘দোষ’। সন্তান কি নারীর একার? এতে বাবা, পরিবার, রাষ্ট্র ও সমাজের কোনো দায় নেই? মা যেন মেশিন, পেট থেকে বাচ্চা বের করবেন আর দাসির মতো তার যত্ন নেবেন? সম্পত্তির উত্তরাধিকার তৈরিতে পুত্রসন্তানের জন্ম দিতেই হবে। সন্তান না থাকলে শ্বশুরবাড়িতে নারীকে মূল্যহীন হয়ে পড়তে হবে। এ ধরনের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার যত দিন পরিবর্তন না হবে, তত দিন পরিস্থিতি পাল্টাবে না।

এ ধরনের সংকট থেকে উত্তরণে হেলাল উদ্দিন আহমেদের পরামর্শ হচ্ছে, সন্তান বা প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে বিভিন্ন সংকটে থাকা নারী ও পুরুষের কাছের মানুষদের সংবেদনশীল হতে হবে। সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে, ব্যক্তিমানুষটির ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে।