সন্ত্রাসবিরোধী আইন প্রয়োগের চিন্তা

ছয় বছর আগে জামিন অযোগ্য, কম সময়ে বিচার এবং মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবনের বিধান রেখে প্রণয়ন করা সন্ত্রাসবিরোধী আইন এখন কার্যকরভাবে প্রয়োগ করতে চায় সরকার। এর লক্ষ্য চলমান সহিংস পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা, সন্ত্রাসীদের মনে ভীতি সৃষ্টি করা। 
এত দিন পর ওই আইনকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার কারণ অনুসন্ধানে জানা যায়, বিরোধী জোটের হরতাল-অবরোধ চলাকালে একের পর এক নাশকতা ঠেকাতে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ ব্যর্থ হচ্ছে। এরই মধ্যে আলোচনায় এসেছে বিভিন্ন অভিযোগে যাঁরা গ্রেপ্তার হচ্ছেন, তাঁদের জামিনে ছাড়া পাওয়ার প্রসঙ্গ।
মন্ত্রিসভার সর্বশেষ বৈঠকে গত সোমবার এ বিষয় নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি নতুন আইন প্রণয়নের কথা বলেন কয়েকজন মন্ত্রী। তখন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সন্ত্রাসবিরোধী আইনের কথা উল্লেখ করে জানান, আইনটি খুবই শক্ত এবং এ আইনে দায়ের হওয়া মামলা জামিন অযোগ্য। তাই নতুন আইন প্রণয়ন না করে পুরোনো ওই আইনটি প্রয়োগের কথা বলেন তিনি। এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে সন্ত্রাসবিরোধী আইনটি প্রয়োগের কথা জানান।
মন্ত্রিসভা ও সংসদে ওই আলোচনার পর থেকে আইনটি নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা জোরদার হয়েছে। আইন মন্ত্রণালয় গতকাল জরুরি ভিত্তিতে সরকারি মুদ্রণালয় (বিজি প্রেস) থেকে আইনটির আড়াই শ কপি গেজেট সংগ্রহ করে তা র্যাব ও পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কর্মকর্তার কাছে পাঠিয়েছে। বাংলাদেশ টেলিভিশনে আইনটির বিভিন্ন দিক প্রচার করা হচ্ছে জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য। সরকারের তথ্য অধিদপ্তর গতকাল বৃহস্পতিবার তথ্য বিবরণী দিয়ে আইনটির সংজ্ঞা ও শাস্তির প্রসঙ্গ উল্লেখ করে গণমাধ্যমকে তা প্রচারের অনুরোধ করেছে।
মাঠপর্যায়ে অনুসন্ধান করে জানা গেছে, সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা ও বিচার করতে এখন পর্যন্ত সম্পূর্ণ প্রস্তুত নয় পুলিশ ও বিচার প্রশাসন। কারণ, এ আইনে মামলা দায়ের থেকে বিচার শেষ করা পর্যন্ত আইনি নজরদারি ও কিছু বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এটা নিয়ে পুলিশের অনীহা যেমন আছে, তেমনি আইনটি সম্পর্কে মানুষ সচেতন নয়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী প্রথম আলোকে বলেন, এ আইনসহ অন্যান্য আইনের সঠিক ও কার্যকর প্রয়োগ সম্পর্কে তিনি মাঠপর্যায়ে কথা বলছেন। কোনো সন্ত্রাসী যাতে ছাড় না পায় এবং কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি যাতে হয়রানির শিকার না হন, সেটি মাথায় রেখেই এর প্রয়োগ করা হবে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মাঠপর্যায়ে যেনতেনভাবে অন্য আইনের মতোই এর প্রয়োগ ও ব্যবহার করা হচ্ছে। আইনে প্রতিটি জেলায় একটি ট্রাইব্যুনাল গঠনের কথা থাকলেও অর্ধযুগেও সরকার সেই উদ্যোগ নেয়নি। জেলা, সেশন বা অতিরিক্ত জজরা বাড়তি দায়িত্ব হিসেবে এ আইনে বিচার করছেন।
আইন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০০৯ সালে প্রণীত এই আইনে আন্তর্জাতিক বিধিবিধান অনুযায়ী এবং দেশের বাস্তবতা মেনে নতুন ও বিশেষ কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আন্তর্জাতিক বিধানগুলোর মধ্যে রয়েছে সন্ত্রাসী বোমা হামলা, অবৈধভাবে বিমান আটক, জিম্মিদশা, পারমাণবিক বস্তুর ভৌত সুরক্ষা, সামুদ্রিক নৌযানের নিরাপত্তা প্রভৃতি।
২০১৩ সালে আইনটি সংশোধন করে (২০০৯ সালের ১৬ নম্বর আইনের ধারা ৬ প্রতিস্থাপন) সন্ত্রাসী কাজের সংজ্ঞা ও শাস্তি নির্দিষ্ট করা হয়। এতে কোনো ব্যক্তিকে হত্যা, গুরুতর আঘাত, আটক বা অপহরণ করা বা করার চেষ্টার জন্য ব্যক্তি বা বিদেশি নাগরিকের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড আরোপের কথা বলা হয়। এ ছাড়া বিস্ফোরক দ্রব্য, দাহ্য পদার্থ ও আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার বা কাছে রাখার সর্বোচ্চ শাস্তি নির্ধারণ করা হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
বর্তমান সহিংস ঘটনার প্রেক্ষাপটে অপরাধের ধরন ও শাস্তি সময়োপযোগী বলে বিবেচনা করছে সরকার। তবে এক মাস ধরে সহিংস ও বড় কয়েকটি ঘটনা ঘটলেও ওই আইনে দায়ের হওয়া কোনো মামলা গতকাল পর্যন্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আসেনি। মন্ত্রণালয়ের একজন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, যেসব মামলা অনুমোদনের জন্য এসেছে, সেগুলো গত জাতীয় নির্বাচনের আগে বিভিন্ন সন্ত্রাসী ঘটনার।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, মন্ত্রিসভায় আলোচনার পর আইনটির প্রয়োগ নিয়ে সবার সঙ্গে কথা বলা হচ্ছে। মূলত আইন মন্ত্রণালয় বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। পুলিশ সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী মামলা ও তদন্ত পরিচালনা করবে।
আইনটি এত দিনেও তেমন প্রয়োগ না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা দায়ের করতে হলে প্রাথমিক অভিযোগপত্রসহ মামলাটি প্রথমে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে (জেলা প্রশাসক) অবহিত করতে হয়। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট প্রাথমিক অভিযোগপত্রের ওপর মন্তব্য করে তা অনুমোদনের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠান। তাঁর মতে, এই আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ছাড়াও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মামলার তদন্ত ও বিচার শেষ করা, সময়মতো কাজ শেষ না করতে পারলে বিভাগীয় শাস্তির প্রসঙ্গ থাকায় বাধ্য না হলে কেউ ওই আইনে মামলা করতে চান না।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, এত দিন ধরে পুলিশ যেসব আইনে মামলা ও তদন্ত করে আসছে, সেখানে আইনের নজরদারি তুলনামূলক কম। কিন্তু এ আইনে মামলার অনুমোদনের জন্য জেলা প্রশাসক থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পর্যন্ত যেতে হয়। মামলা তদন্তের মেয়াদ আইন দিয়ে নির্দিষ্ট করা আছে প্রথমে ১৫ দিন, এরপর ৩০ দিন। সুনির্দিষ্ট কারণে এটা ৭৫ দিন পর্যন্ত হতে পারে। আবার এ মামলার বিচার ১৮০ দিনের মধ্যে শেষ করতে হবে।
জানতে চাইলে বিশিষ্ট আইনজীবী এম আমীর-উল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইনটি সাধারণ অপরাধ ও সন্ত্রাসের পার্থক্য নির্ধারণ করেছে। এত ভালো, আধুনিক ও সময়োপযোগী আইনটি কেন যে প্রয়োগ করা হচ্ছে না, তা বোধগম্য নয়।’ তাঁর মতে, সন্ত্রাসবিরোধী আইনে ব্যক্তি, দল ও অর্থ জোগানদাতাকেও শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে এবং আইনটির অপব্যবহারের সুযোগ তুলনামূলকভাবে কম।
তবে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার জন্য আইনটি প্রয়োগ করা হলে সাময়িক সুফল মিলতে পারে, কিন্তু এর ভবিষ্যৎ হবে ভয়াবহ। এমনকি যাঁরা এর অপপ্রয়োগ করবেন, তাঁরাই এ আইনের শিকার হতে পারেন। তাঁর মতে, কঠোর আইন করলে এবং কঠোরতমভাবে তা প্রয়োগ করলেই অপরাধ দমন করা যায় না। যাঁরা প্রয়োগ করবেন, তাঁদের সততা ও নিষ্ঠা এ ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আইন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ৬৪ জেলায় এ আইনের আওতায় আদালত গঠন করতে চাইলে ৬৪ জন বিচারক, তাঁদের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ও আনুষঙ্গিক সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। এর চেয়েও বড় সমস্যা হচ্ছে আদালত প্রাঙ্গণে স্থান দেওয়া, যা অনেক জেলায় প্রায় অসম্ভব।
চট্টগ্রামেও এ আইনের আওতায় আলাদা ট্রাইব্যুনাল করা হয়নি। চট্টগ্রামের আদালত সূত্র জানায়, সন্ত্রাসবিরোধী আইনে সেখানে ছয়টি মামলার বিচার চলছে। আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে ৮ থেকে ১০টি মামলা।
চট্টগ্রাম মহানগর আদালতের সরকারি কৌঁসুলি মো. ফখরুদ্দিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা হলেও আর দশটি মামলার মতোই বিচার হচ্ছে। পৃথক ট্রাইব্যুনাল হলে মামলার তদন্ত ও বিচারে যে গতি বা দায়বদ্ধতা থাকে, তা অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে অন্যান্য আদালতের কাছে প্রত্যাশা করা যায় না।
আইন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এ আইনের জামিন অযোগ্য ধারা এবং কম সময়ে বিচারের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছে সরকার। আইন অনুযায়ী এ ধরনের মামলা জামিন অযোগ্য হলেও ট্রাইব্যুনাল সন্তুষ্ট হলে বিশেষ বিবেচনায় জামিন দিতে পারেন। তবে সে ক্ষেত্রেও শর্ত হচ্ছে, রাষ্ট্রপক্ষকে পর্যাপ্ত শুনানির সুযোগ দিতে হবে এবং রাষ্ট্রপক্ষ জামিনের বিষয়ে আপত্তি জানালে তা দেওয়া যাবে না। তবে নারী বা শিশুদের জামিনের বিবেচনায় নেওয়া যাবে। ওই সূত্রটির মতে, এ আইনে নারী ও শিশু আইনের জামিনের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করা হয়েছে।
মৌলিক অধিকার সুরক্ষা কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ও বেসরকারি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক শাহদীন মালিক বলেন, দেশে নৃশংস সব অপরাধ হচ্ছে এবং এসব অপরাধের সঙ্গে রাজনীতির প্রশ্ন জড়িত। তাঁর মতে, ‘এটি কেবল অপরাধ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নয়, যেটি রাজনৈতিক ইস্যু বাদ দিয়ে আইন প্রয়োগের মাধ্যমে সমাধান করা যায়। আর এমনটি করতে গেলে বিশ্বের বহু দেশের মতো আমাদের এখানেও হিতে বিপরীত হতে পারে।’